বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হজরত সুলায়মান (আ:) তার পিতা হজরত দাউদ (আ:)-এর ইচ্ছানুযায়ী ‘ছায়হুন’ পর্বতে এক আজিমুশশান বিশাল হায়কল নির্মাণ করেন, ইতিহাসে যা ‘হায়কালে সুলায়মানি’ নামে প্রসিদ্ধ। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬৬ সালে নির্মিত হয়।
সৈয়দ নাছের উদ্দীন মোহাম্মদ আবুল মনসুর তার ‘দওলাতে ফারুকি’ নামক পুস্তকে এই হায়কাল সম্পর্কে লিখেছেন, হজরত সুলায়মান (আ:) জীবন্ত খোদার মাহাত্ম্য প্রকাশের জন্য একটি ইবাদতগৃহ (হায়কল-মন্দির) অত্যন্ত সুন্দর করে নির্মাণের ইচ্ছা পোষণ করেন, যা হবে এমন শানদার, দুনিয়াতে যা কেউ কখনো দেখেনি। এই প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তিনি ‘ছুরের’ বাদশাহ হিরামের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং সেই বাদশাহ লেবানন পর্বত থেকে শমশাদ (এক প্রকারের বৃক্ষ বিশেষ) এবং দেবদারু বৃক্ষ ইত্যাদির কাঠ হজরত সুলায়মান (আ:)-এর নিকট প্রেরণ করেন। হজরত সুলায়মান (আ:) নিজের লোকদের মধ্য থেকে ৬০০ জনকে কাজ তদারকির জন্য, ৭০ হাজার বোঝা বহনকারী, ৩০ হাজার কর্মী এবং ৮০ হাজার প্রস্তর কর্তনকারী নিয়োগ করেন। তাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয় পর্বতমালায় গিয়ে প্রস্তর কেটে আনার। এসব লোক প্রত্যেক কাজ অনুযায়ী পূর্বাহ্নে প্রস্তর সংগ্রহ করে রাখবে এবং সতর্ক থাকবে যেন কুড়াল ও হাতুড়ি ইত্যাদির শব্দ হায়কাল নির্মাণের সময় শুনা না যায়। আরো হাজার হাজার শ্রমিক অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার জন্য নিয়োজিত ছিল। হায়কালটির দৈর্ঘ্য ছিল ৬০ হাত, চওড়া ২০ হাত এবং উচ্চতা ছিল ৩০ হাত।
আজিমুশশান বিশাল হায়কাল নির্মিত হয়ে যাওয়ার পর বনি ইসরাইল সেখানে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে থাকে। হজরত সুলায়মান (আ:)-এর ওফাতের পর তার পুত্র রাজাম ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু তার সরকার সুলায়মানি শান, শওকত ও ঐতিহ্য গৌরব অক্ষুন্ন রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে মিসরের বাদশাহ বাইতুল মোকাদ্দাস আক্রমণ চালিয়ে তা দখল করে নেন এবং সেখানে লুটপাট ও অরাজকতা চালানো হয়। তা ছাড়া বনি ইসরাইলের পরস্পরবিরোধ কোন্দল ও বিশ্বাসঘাতকতার ফলে তাদের সুবিশাল সাম্রাজ্য দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এই দুইটি সাম্রাজ্য পরস্পর শত্রু হয়ে যায়। একটি সাম্রাজ্য ছিল বনি ইসরাইলের দশটি গোত্রের, যর রাজধানী ছিল বাইতুল মোকাদ্দাস। এই সাম্রাজ্য ইহুদা ও বিন ইয়ামিন এই গোত্রদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণত সবাই ইহুদি নামে খ্যাত হয়।
পবিত্র কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, বনি ইসলাইলের এই বিশ্বাসঘাতকরা তাদের সকল অপকর্ম ও আল্লাহর বিধি-বিধানগুলো হতে দূরে সরে যাওয়ার পরিণতি ভোগ করে। এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি হয় অত্যন্ত ভয়াবহ এবং শিক্ষণীয়। তাদের ওপর আল্লাহর এমন ধ্বংসাত্মক অভিশাপ পতিত হয়, যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে, ৫৯৯ সালে এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে তারা শাসক দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত হতে থাকে এবং গোলাম জাতিতে পরিণত হয়।
অবশ্য পরে একসময় তাদের শুভ দিন ফিরে আসতে থাকে, তারা নিজেদের অন্যায়-পাপাচারের পরিণতির কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়। একশ’ বছর পর্যন্ত আল্লাহর কঠিন শাস্তি, ভোগ ও নানা বিপর্যয়ের পর হজরত দানিয়াল, হজরত উজায়ের প্রমুখ নবীগণের দোয়ার বরকতে তাদের বিপদাপদ দূর হতে থাকে এবং ব্যাবিলিয়নদের অত্যাচার, নির্যাতন ও গোলামি হতে মুক্তি লাভ করে। তারা বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রত্যাবর্তন করার এবং হায়কালে সুলায়মানি পুন:নির্মাণের অনুমতি প্রাপ্ত হয়।
ইহুদিরা এমন এক জাতি যাদের ধ্বংসের ইতিহাসের কোনো শেষ নেই। তারা ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় হায়কাল পুন:নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে বায়তুল মোকাদ্দাস ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে বসবাসের সুযোগ লাভ করে এবং সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করলেও দীর্ঘ দিন তা অব্যাহত থাকেনি। তাদের দুষ্কর্মের ফলে আবারও তাদের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০ সালে বিতলিমুস মিশর হতে এসে বায়তুল মোকাদ্দাস অধিকার করে এবং ইহুদিদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। গ্রিকদের পর খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬ সালে তারা রোমানদের কবলে পতিত হয়। তারা বায়তুল মোকাদ্দাস অধিকার করে ১২ হাজার ইহুদিকে হত্যা করে। তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৫১ সালে পুনরায় আগ্রাসন চালিয়ে ৩০ হাজার ইহুদিকে গোলাম জাতিতে পরিণত করার পর পশুর মত বিক্রি করে।
আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আরেকবার সুযোগ দিলেন, অর্থাৎ তাদের মধ্যে হজরত ঈসা (আ:) আবিভর্‚ত হন। কিন্তু ইহুদিরা তার বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকে। ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা ইহুদিদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়। এভাবে চলতে থাকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ ফারুকি খেলাফত পর্যন্ত। বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলিম অধিকারে আসার পর সেখানে শুরু হয় এক নতুন যুগ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।