বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও মজলিশে শূরার সদস্য নির্বাচনকল্পে বিশ্ব নবী রাসূলুল্লাহ (সা.) উদার কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন ঈমানদার বান্দার দাঁড়িপাল্লায় উত্তম চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী বস্তু আর কিছুই হবে না। আর যে সকল লোক নিরর্থক, অশ্লীল ও নিকৃষ্ট ধরনের বাক্যালাপ করে আল্লাহপাক তাদের মোটেই পছন্দ করেন না, বরং তাদের প্রতি আল্লাহর ঘৃণা বর্ষিত হয়।’ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, উত্তম নৈতিক চরিত্র যেমন ঈমানের পরিচায়ক, তেমনি ঈমানের অনিবার্যফলও হচ্ছে নৈতিক চরিত্র। সুতরাং ঈমান ও নৈতিক চরিত্রের মাঝে যে একটি অবিচ্ছেদ্য সেতুবন্ধন বিরাজমান তা সহজেই অনুমান করা যায়। মানুষের মাঝে সুপ্রবৃত্তির ফল্গুধারা যেমন তর তর গতিতে বয়ে চলেছে, তেমনি কুপ্রবৃত্তির কূটিল ঘূর্ণাবর্তও প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তম নৈতিক চরিত্রের সুষ্ঠু বিকাশের ফলে সুপ্রবৃত্তি সতেজ হয়, বেগবান ও সুদৃঢ় হয়। অপরদিকে কুপ্রবৃত্তির অবলুপ্তি ঘটেও তা অপসৃয়মান ছায়ার মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এমনি করেই প্রকৃত মনুষ্যত্ব আপন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। এজন্য রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে জড়িত রাষ্ট্রপ্রধান ও মজলিশে শূরার সদস্যদের নির্বাচনকালে তাদের মাঝে নিম্বলিখত গুণাবলীর বিকাশ আছে কিনা, তা ভালোভাবে অবলোকন করতে হবে।
ধর্মভীরু হওয়া: ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও মজলিশে শূরার সদস্যদের মুত্তাকী বা ধর্মভীরু হতে হবে। যারা মুত্তাকী ও ধর্মভীরু, তারা আল্লাপাকের প্রিয় পাত্র ও সম্মানিত। বস্তুময় জগতের বুকে রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি সর্বোচ্চ পদ হিসাবে চিহ্নিত। এরই সাথে সর্বোচ্চ পদ-মর্যাদার অধিকারী হচ্ছে মজলিশে শূরার সদস্যবৃন্দ। তাই এহেন সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ পদে বরিত হতে হলে সর্বপ্রথম যে নৈতিক গুণটি অর্জন করতে হবে, তা হলো তাকওয়া, পরেহজাগরী এবং ধর্মভীরুতা। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘(আল্লাহ কর্তৃক পছন্দীয়) সুলতান হচ্ছে আল্লাহর প্রতিবিম্বস্বরূপ। যে ব্যক্তি আল্লাহর সুলতানকে হেয় জ্ঞান করল, আল্লাহপাকও তাকে হেয় জ্ঞান করবেন।’ এ জন্য ধর্মভীরু লোক রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অথবা মজলিশে শূরার সদস্য পদে অধিষ্ঠিত না হলে সমাজের সর্বস্তরে ধর্মহীনতা এবং অন্যায়-অত্যাচার মাথা চাড়া দিয়ে উঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এ কারণে রাষ্ট্রপ্রধান ও পরামর্শ সভার সদস্যদের মাঝে ধর্মভীরুতা গুণটি পরিপূর্ণ মাত্রায় থাকতে হবে। কোরআনুল কারীমে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি অধিক ধর্মভীরু, সে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।’ রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ও পরামর্শ সভার সদস্যপদ যে অধিক সম্মানের পরিচায়ক, তা সহজেই অনুমান করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘বান্দা মুত্তাকী লোকদের মধ্যে ততক্ষণ পর্যন্ত শামিল হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো দোষের কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কায় সে সকল জিনিসও পরিত্যাগ না করবে, যাতে বাহ্যত: কোনো দোষই নেই।’ অন্যত্র তিনি আরও ইরশাদ করেছেন, ‘হে আয়েশা, ছোট ছোট ও নগণ্য গুনাহ হতেও দূরে সরে থাকা বাঞ্চনীয়। কেননা সে সব সম্পর্কেও আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ প্রকৃতপক্ষে ধর্মভীরু হওয়াই হচ্ছে ইসলামী নৈতিকতার আসল বুনিয়াদ।
আমানতদার হওয়া: ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান ও পরামর্শ সভার সদস্যদের আমানতদার হতে হবে। রাষ্ট্রীয় যাবতীয় কর্মকান্ড এবং রাষ্ট্রের অধিবাসীদের সকল প্রকার নিরাপত্তার আমানত রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তার সহযোগী সংগঠনের ওপরই ন্যস্ত থাকে। তাদের এই হক ও আমানত যথাযথভাবে তাদের নিকট প্রত্যার্পণ করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব। মহান আল্লাহপাক আল কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের নিকট গচ্ছিত আমানত এর হকদারকে পরিপূর্ণরূপে প্রত্যার্পণ কর।’ রাষ্ট্রপ্রধানের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে দেশকে, জাতিকে, তাদের জান-মাল, সহায়-সম্পদ, ইজ্জত-হুরমতকে রক্ষা করা, হেফাজত করা। এ সকল রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজত এমনভাবে করতে হবে, যেভাবে আমানতকে হেফাজত করা হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
‘যার মাঝে আমানত রক্ষার ও প্রত্যার্পণের গুণ না থাকে, সে ঈমানদার হতে পারে না।’ সুতরাং আমানতদার হওয়া পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার পরিচায়ক।
রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্বের আমানতদার হওয়ার পর এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করা, অবহেলা ও অবজ্ঞা এবং দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় বহন করা ইসলাম কোনোক্রমেই অনুমোদন করে না। রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যদি সে দেশ ও জনগণের কল্যাণ ও উন্নয়নের স্বার্থে প্রাণপণ চেষ্টা না করে, তাহলে সে ইহকাল ও পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবে এবং কোনোক্রমেই আল্লাহর রহমত লাভে সমর্থ হবে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহপাকের নিকট দোয়া করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার উম্মতের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় কর্মকান্ডের যে জিম্মাদার হবে, যে যদি জনগণকে ভয়ানক অশান্তি ও দুঃখ-কষ্টে নিক্ষেপ করে, তবে হে আল্লাহ, তুমিও তার জীবনকে সংকীর্ণ ও কষ্টপূর্ণ করে দাও এবং যে ব্যক্তি আমার উম্মতের সামগ্রিক বিষয়াদি কাজ-কর্মের দায়িত্বশীল হবে এবং তারপর সে যদি জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং অনুগ্রহ প্রদর্শন করে, তবে হে আল্লাহ, তুমিও তার প্রতি অনুগ্রহ দান কর।’ এখানে মুক্তি, সফলতা ও কামিয়াবী অর্জনের মূল মানদন্ড হিসাবে স্থিরীকৃত করা হয়েছে দায়িত্ব পালনকে। এজন্য আমানতের প্রতি উদাসীন হওয়া যাবে না। আমানতের হক আদায় করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।