Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাড়িভাড়া বাড়ছে

২৭ বছরেও আইনের প্রয়োগ নেই

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় চলছে বাড়িভাড়া বাড়ানোর হিড়িক। সরকারিভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ধুয়া তুলে বাড়িভাড়া বাড়ানোর এ প্রবণতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সরে এসে এ খাতে তিন হাজার ১০০ কোটি টাকার ভর্তুকি ঘোষণা করা হলেও রাজধানীতে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা থেমে থাকেনি। প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে বাড়িভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা থাকলেও এ বছর তা আগে থেকেই শুরু হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর অজুহাতে বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক দফা বাড়িভাড়া বাড়ানোর পর নতুন বছরের শুরুতে আবারও বাড়ানো হবে বলে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এদিকে গত বছরও গ্যাসের দাম বাড়ানো ও রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স সমতায়নের কারণে বড় অংকে বাড়িভাড়া বাড়িয়েছিল ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাড়ি মালিকরা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মোহাম্মদ জামাল মোস্তফা ইনকিলাবকে বলেন, বছরের এ সময় বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে এমন কোনো খবর আমার জানা নেই। আপনার মাধ্যমে বিষয়টি আমি জানতে পরলাম। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়ে তেমন কোনো আইন না থাকায় তেমন কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারি না। সরকার কিংবা আদালত থেকে যদি এ বিষয়ে নির্দেশনা দিত তা হলে আমাদের পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হতো।
রাজধানীতে প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে স্রোতের মত মানুষ আসছে। শহরের বাইরে থেকে আসা এ মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল ভাড়াবাসা। আর এ সুযোগে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাড়ি মালিকরা বাড়িভাড়া বাড়িয়েই চলেছে। এছাড়া বাড়িভাড়া কেমন হবে, কখন ভাড়া বাড়বে, ভাড়াটিয়াকে কখন উচ্ছেদ করা যাবে, অগ্রিম জামানত গ্রহণ, ভাড়া আদায়ের রশিদ প্রদান, লিখিত চুক্তি, বাড়ি মেরামত ও বসবাস যোগ্য কিনা- বিষয়গুলো নিয়ে কোনো ধরণের আইনের তোয়াক্কা করেন না বাড়ি মালিকরা। অন্যদিকে, বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া বিষয়গুলো না জানায় সব অনিয়ম মুখ বুজে সহ্য করেন।
রাজধানীর বনশ্রীর এফ ব্লকের একটি বাড়ির ভাড়াটে বেসরকারি চাকুরে এনায়েত আলী বলেন, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি বাড়িভাড়া নিয়েছিলেন ১৬ হাজার টাকায়। গত জানুয়ারি থেকে তাঁকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। চলতি মাসে তাকে বাড়ির মালিক নোটিশ করেছেন নভেম্বর থেকে আরও দুই হাজার টাকা বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। কি কারণে ভাড়া বাড়ানো হলো তার কৈফিয়ত বাড়ি মালিক দিতে বাধ্য নয় বলে জানিয়েছেন। সে সাথে বাড়ি মালিক এনায়েত আলীকে বলেছেন, যদি এ ভাড়া দিতে তার সমস্যা হয় তা হলে তিনি যেন বাসা ছেড়ে দেন।
গত তিন বছরে চার হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি জানিয়ে এনায়েত আলী আরো বলেন, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাড়িওয়ালা আমাকে বলেন, এবার কিন্তু ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না, শুধু সার্ভিস চার্জ বাড়বে দুই হাজার টাকা। আর গত মাসে ডেকে বলেছেন, গত বছরতো ভাড়া বাড়াইনি, এবার দুই হাজার টাকা বাড়ানো হলো।
এসব কারণেই ঢাকার মানুষের কাছে বাড়িভাড়া এখন এক আতঙ্ক ও যন্ত্রণার আরেক নাম। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর এলেই আতঙ্কে থাকেন ভাড়াটেরা। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে ‘জানুয়ারি মাসে ভাড়া বাড়ছে না’ বাড়িওয়ালার কাছ থেকে এমন কথা কোনো ভাড়াটিয়া শুনেছেন কি না, তা হয়তো খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে রাজধানীজুড়েই যেন চলছে বাড়িভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য। বাড়িওয়ালারা যখন ইচ্ছা তখন বাড়িভাড়া বাড়াচ্ছেন। আর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়িভাড়া নৈরাজ্য ভাড়াটিয়া জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
জাতীয় ভাড়াটিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক হোসেন বলেন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রনয়নের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই হার পুননির্ধারণ করে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতরে দিয়েছি। আইনটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। কিন্তু কেউই তা আমলে নিচ্ছে না। এ সুযোগে বাড়িওয়ালারা ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে।
এক জরিফ থেকে জানা গেছে, ঢাকার ৮৩ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকেন। তথ্যমতে ৮৩ শতাংশ মানুষ ১৭ শতাংশ বাড়ি মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ঐ জরিফ সূত্রে আরও জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত গুলশান এলাকার প্রতি বর্গফুট বাড়িভাড়া ১৫ থেকে ১৮ টাকা, বনানীতে ১৪ থেকে ১৬, মহাখালীতে ১১ থেকে ১২, নাখালপাড়ায় ৬ থেকে ৭, উত্তরায় ৫ থেকে ৯, শান্তিবাগে ৫ থেকে ৬ টাকা, নয়াপল্টনে ৯ টাকা, শান্তিনগরে ৮ থেকে ৯ টাকা, কল্যাণপুর-পল্লবীতে ৬ টাকা, জিগাতলায় ৮ টাকা ও ধানমন্ডিতে ১১ দশমিক ২৫ টাকা নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু বাড়ি মালিকরা ভাড়া আদায় করছেন এর দ্বিগুণ থেকে তিনগুণেরও বেশি।
মিরপুর ১ এর বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, আমি এখন যে বাসায় আছি সেখানে তিন বছরে ভাড়া বেড়েছে ৫ হাজার টাকা। ১২ হাজার টাকা ভাড়ায় উঠেছি। এখন দিতে হচ্ছে ১৭ হাজার টাকা। এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে গেলে বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেন।
মোহাম্মদপুরের নিয়ামুল ইসলাম নামের আরেক ভাড়াটিয়া বলেন, জানুয়ারি হচ্ছে ভাড়া বৃদ্ধির মাস। কিন্তু এ বছর জুলাই আগস্টেই আমরা সে ভাড়া বৃদ্ধির ভোগান্তিতে পড়লাম। প্রতি বছর বাড়িভাড়ার সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে উঠেছে।
সরকার ১৯৯১ সালে ‘বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করে। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ-নিয়ন্ত্রক নিয়োগেরও বিধান রাখা হয়েছে আইনে। আইন প্রণয়নের পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকা ও অবস্থানভেদে ভাড়ার হারও নির্ধারণ করে। কিন্তু পরে এসব কিছুই আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য ২৭ বছর আগে আইন করা হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায়নি কোনোদিন। বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধের কারণ চিহ্নিত করতে ২০১৫ সালের ১ জুলাই উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে বলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু এ বিষয়েও সরকারের কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
দুই সিটি কর্পোরেশনের মতে, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব তাদের না। এটা মূলত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ। তাছাড়া এ নিয়ে সরকারের আলাদা একটা আইন তৈরি করার কথা রয়েছে। এখনও এ ব্যপারে কোনো আইন বা নীতিমালা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, আসলে লোকেশন অনুপাতে ভাড়া নির্ভর করে। আর বাড়িওয়ালাও বিভিন্ন অজুহাত খোঁজেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। ভাড়া নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সরকারের একটা আইন করার কথা রয়েছে। ওটা এখনও তৈরি হয়নি। আইনটি দ্রুত তৈরি হওয়া উচিত। অন্তত একটা নীতিমালা হলেও অনেক ভালো হয়। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন যেহেতু ঢাকাবাসীর সেবা দিচ্ছে সেহেতু বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিৎ। আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলবো। বিষয়টি আমরা দেখছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ