Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপমহাদশের স্বাধীনতা সংগ্রামী লেখক ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী

৬৮তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

উপমহাদশের মহান বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, সাহিত্যিক দার্শনিক, লেখক-গবেষক, রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। অবিস্মরণীয় এই মনীষার ৬৮তম ইন্তেকাল বার্ষিকী আজ (বুধবার)। তিনি ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুনশী মুহাম্মদ মতিউল্লাহ আরবী-ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন। মাতার নাম রহিমা বিবি। চট্টগ্রামের অপর নাম ‘ইসলামাবাদ’। সেই প্রেক্ষিতে মনিরুজ্জামান নামের শেষে ইসলামাবাদী যোগ করেন। তিনি মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন। ১৮৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। রংপুর হারাগাছি সিনিয়র মাদরাসায় সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
এখান থেকেই তিনি সাহিত্য, সমাজসেবা ও শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করেন। এক পর্যায়ে তিনি সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সাংবাদিকতার সূচনা হয় সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’-এর মাধ্যমে। সাপ্তাহিক ‘ছোলতান’ পরে ‘দৈনিক ছোলতান’-এ উন্নীত হয়। তিনি ছিলেন এ পত্রিকার সম্পাদক। পরে আঞ্জুমানে ওলামায়ে ইসলাম বাংলা ও আসামের মুখপাত্র ‘আল-ইসলামে’র সম্পাদক হন। এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মাঝে আত্মজাগরণের প্রেরণা ছড়িয়ে দেন। তিনি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের অগ্রসর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বাঙালী মুসলমানের জাতিগত ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক।
তৎকালীন দুনিয়াজোড়া খ্যাতির শীর্ষে ছিল ফারসী ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র ‘হাবলুল মতিন’। প্রাচ্যের নেতা আল্লামা জামালুদ্দিন আফগানীর শিয্য ইরানের নির্যাতীত ত্যাগীনেতা আগা মঈদুল ইসলামের সম্পাদনায় কলকাতায় ইংরেজীতে ‘মিল্লাত’ ও উর্দু-ফারসীতে, দৈনিক ‘হাবলুল মতিন’ প্রকাশিত হতো। মাওলানা ইসলামাবাদী ‘হাবলুল মতিনে’র বাংলা সংস্করণের সম্পাদক ছিলেন। এরজন্য মাওলানা ইসলামাবাদীকে বলা হয় বাংলায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক পত্রিকার প্রথম মুসলমান সম্পাদক। সংবাদপত্র জগত ও মুসলিম সাংবাদিকতায় মাওলানা ইসলামাবাদীর অবদান অপরিসীম।
চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চাকেন্দ্রের সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লেখক-ইতিহাস গবেষক সোহেল মো. ফখরুদ্দীন বলেছেন, মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আমাদের ইতিহাসের এক অমর নাম। তাঁর মৌলিক চিন্তার ফসল আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে নতুন দিক-নিদের্শনা প্রদান করে। গদ্য সাহিত্যের আধুনিকায়নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের জাতিসত্তা বিনির্মাণে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর অবদান ইতিহাসের সোনালী পাতায় খচিত হয়ে থাকবে। ‘ভারতের মুসলমান সভ্যতা’ গ্রন্থে মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তুলে ধরেছেন ভারতবর্ষে ইসলামী সভ্যতার উৎকর্ষ এবং বিকাশের তাত্তি¡ক ও তথ্যপূর্ণ বিবরণ। ভারতের সভ্যতার বিশাল আঙ্গিনা জুড়ে মুসলমানদের যে প্রভূত অবদান তার বর্ণনা আছে এ গ্রন্থে। গ্রন্থটির আবেদন আজও রয়েছে সমভাবে। মুসলমানদের ঐক্যে সচেতন করে তোলাই ছিল মাওলানা ইসলমাবাদীর কর্মপ্রয়াস। তিনি বিশ্বাস করতেন খেলাফতের পতনের কারণেই মুসলিম সমাজে নেমে আসে অন্ধকার। খেলাফত পুনর্জীবত করার মাধ্যমেই বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ-সমৃদ্ধি, সমৃদ্ধি সম্ভব। তিনি খেলাফত আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মাওলানা ইসলামাবাদীর অসামান্য অবদানের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম শহরে ভিকটোরিয়া মুসলিম হোস্টেল পাকাকরণ যেটি সেকালে এই শহরে মুসলিম ছাত্রদের অন্যতম প্রসিদ্ধ ছাত্রাবাস ছিল। সীতাকুন্ডে তিনি গড়ে তোলেন হাই স্কুল ও মাদরাসা। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম কনফারেন্স আহ্বান, কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠনে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। চট্টগ্রামে টাউন ব্যাংক ও কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। একজন আলেমের আইনসভায় সদস্য পদ লাভ একটি ইতিহাস। তিনি স্বদেশের জন্য কারাবরণ করেছেন। আজাদ হিন্দু ফৌজের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৪ সালের ১৩ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। আটক রাখা হয় লাহোরের মিয়ানওয়ারী দুর্গে। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান।
উপমহাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিশিষ্ট বাগ্মী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি (১৯১১) প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ও জাতীয়তাবাদী মুসলমান নেতা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী লাহোর জেলের নির্জন-কক্ষে নানা নির্যাতন সহ্য করে শারীরিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন। তবে মানবিক শক্তি ছিলো অটুট।
শেষবার কারামুক্ত হয়েই মওলানা ইসলামাবাদী বর্মায় (মিয়ানমার) যান দ্বীনের কাজে। শরীর তখন ক্রমেই ভেঙে পড়ছে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন। আর্থিকভাবেও তখন তিনি দৈন্যদশায় পতিত। সে সময় মাওলানা ইসলামাবাদী চন্দনাইশে পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস করেন। অনেকটা নীরবে, অবহেলায়-অনাদরে তিনি মারা গেলেন জন্মস্থান বাইনজুড়ি আড়ালিয়ার চর গ্রামে ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর।
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বাংলা সাহিত্যে এক নব দিগন্তের উন্মেষ ঘটান। ইসলামের ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ওপর তিনি প্রচুর প্রবন্ধ রচনা করেন। যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাতীয় জাগরণের বাণীতে ভরপুর তাঁর রচনাবলী মুসলিম সমাজের জন্য উজ্জীবনী শক্তি। তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। এরমধ্যে তুরস্কের সুলতান, কনস্টান্টিনোপল, ভারতে মুসলমান সভ্যতা, ভারতে ইসলাম প্রচার, খাজা নেজামুদ্দীন আওলিয়া, সমাজ সংস্কার, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের জাতীয় উন্নতির উপায়, কোরআনে স্বাধীনতার বাণী, ইসলামের শিক্ষা, সুদ সমস্যা ও মুসলমান সমাজ, ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান, আওরঙ্গজেব, মোসলেম বীরাঙ্গনা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
মৃত্যুর পূর্বে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সমাধিলিপি লিখে গেছেন-
“পথিক : ক্ষণেকের তরে বস মোর শিরে
ফাতেহা পড়িয়া যাও নিজ নিজ ঘরে
যে জন আসিবে মোর সমাধি পাশে।
ফাতেহা পড়িয়া যাবে মম মুক্তির আশে।
অধম মনিরুজ্জামান নাম আমার।
এছলামাবাদী বলে সর্বত্র প্রচার।”



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যুবার্ষিকী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ