বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
‘অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছল, তখন আমি ওই জনপদের উপরকে নিচে করে দিলাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে কাঁকর-পাথর বর্ষণ করলাম, যার প্রতিটি তোমার পালনকর্তার নিকট চিহ্নিত ছিল। আর পাপিষ্ঠদের থেকে খুব দূরেও নয়।’ সূরা হুদ : ৮২-৮৩।
হজরত লুত আ. এর সম্প্রদায়কে কীভাবে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, এই আয়াত দু’য়ে সে কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত লুত আ. এর সম্প্রদায় নানা পাপাচারে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। সমকামিতা ছিল সেই সব পাপাচারের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও বড় পাপ। সমকামিতা শুধু ঘৃণ্য অনাচার ও কুরুচিপূর্ণ নয়, সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরুদ্ধও। হজরত লুত আ. এর সম্পদায়ের লোকেরা নারীদের পরিহার করে পুরুষদের কাছে গমন করত। এ ক্ষেত্রে তারা রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। হজরত লুত আ. এর কোনো নিষেধ-বারণ তারা শুনত না। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মতে, মানব জাতির ইতিহাসে হজরত লুত আ. এর সম্প্রদায়ই সর্বপ্রথম সমকামিতায় অভ্যস্ত হয় এবং তাতে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে ভাসিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনের সূরা আরাফের ৮১-৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং আমি লুতকে প্রেরণ করেছি। যখন তিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ যা তোমাদের পূর্বে সারা বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামবশত পুরুষদের কাছে গমন করো নারীদের ছেড়ে। বরং তোমরা সীমা অতিক্রম করছো।’ শরিয়ত বৈধ নারী পুরুষ ছাড়া অন্য সব ধরনের বিকৃত যৌনাচার, সমলিঙ্গে বা অন্য কোনো প্রকারের যৌনতা, যৌন নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা হারাম করেছে। এসবের জন্য শাস্তিও নির্ধারণ করেছে। উপরন্তু দুনিয়ার সাজা, প্রকৃতির প্রতিশোধ ও আখেরাতের আজাব তো আছেই।
হজরত লুত আ. এর সতর্কবাণী, সদুপদেশ ও নিষেধ-বারণ যখন সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর নজিরবিহীন শাস্তি নেমে আসে। বর্ণিত আছে, হজরত লুত আ. এর সম্প্রদায় চারটি শহরে বা জনপদে বসবাস করত। এই চারটি শহরে আল্লাহপাক তার ফেরেশতাদের মাধ্যমে সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে জমিনে নিক্ষেপ করেন। এরপর আসমান থেকে চলে অবিরাম কাঁকর-পাথর বর্ষণ। এভাবেই তার সম্প্রদায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আল্লাহপাকের বিধানকে যারা উল্টে দিয়েছিল, ভেঙে ছিল, সে রকমই তাদের জনপদকে তিনি উল্টে দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
আল্লাহ তায়ালা এ ঘটনার কথা পবিত্র কোরআনে এ জন্য উল্লেখ করেছেন যে, তার বিধান ও প্রাকৃতিক অনুশাসন ভঙ্গ করে যারা সমকামিতার মতো গর্হিত অপকর্মে লিপ্ত হবে, তাদের জন্যও অনুরূপ শাস্তিই অপেক্ষমান রয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমকামিতার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অনেক দেশই সমকামিতাকে মানবাধিকারের সাথে গুলিয়ে ফেলে তার বৈধতা প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত ২০টি দেশ সমকামীদের ‘অধিকার’ রক্ষায় আইন করেছে। এই তালিকায় এশিয়ার কোনো দেশের নাম না থাকলেও সম্প্রতি ভারত সমকামিতাকে বৈধতা দিয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সে দেশের দন্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল ঘোষণা করেছে। ১৮৬২ সালে প্রণীত দন্ডবিধির ওই ধারায় অস্বাভাবিক যৌন আচরণকে অপরাধ হিসেব গণ্য করে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদন্ডের বিধান ছিল। ধারাটি বাতিল করায় সমকামিতা আর কোনো অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে ভারতে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।
ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। প্রকৃতি বিরুদ্ধ কেনো কিছু ইসলাম সমর্থন করে না। মানুষ কীভাবে যৌন আচরণ করবে তা শুধু ইসলামেই নয়, সকল ধর্মেই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধিবদ্ধ যৌন আচরণের প্রথম লক্ষ্য হলো মানুষের বংশ বৃদ্ধি করা। তার জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীও বিদ্যমান রয়েছে। সমলিঙ্গের মধ্যে যে কোনো যৌন সংসর্গ বংশ বিস্তার করতে পারে না। বরং এটি বিকৃত রুচির পরিচায়ক, ঘৃণ্য আচরণ হিসাবেই পরিগণিত। সমকামিতাকে কোনোভাবেই মানবাধিকারের পর্যায়ভ‚ক্ত করা যায় না। একে যদি মানবাধিকার বলা হয়, তাহলে মাদক গ্রহণ, অভাবে সন্তান হত্যা, তদারকে অক্ষমদের জন্য বয়স্ক ও রোগী হত্যা, আত্মহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডকেও মানবাধিকার বলে স্বীকার করে নিতে হবে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, সাধারণত মানবেতর কোনো জীবের মধ্যে সমকামিতার লেশমাত্র লক্ষ্য করা যায় না। মানবেতর জীবের জন্য যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ, যা তারা পরিহার করে চলে, মানুষের জন্য তা বৈধ হতে পারে কিভাবে?
সমকামিতা অমানবিক, অসামাজিক এবং রুচি বিকৃতির পরিচায়কই শুধু নয়, নানাবিধ রোগব্যাধিরও উৎস। সমকামে অভ্যস্ত ব্যক্তিদের দেহে নানা রোগ জীবাণু সহজেই অনুপ্রবেশ করে রোগব্যাধির বিস্তার ঘটায়। ঘাতক ব্যাধি এইডসের একটি বড় কারণ সমকামিতা। যে যুক্তরাষ্ট্র সমকামিতাকে বৈধ করে আইন করেছে, সেই যুক্তরাষ্ট্রের ২১টি বড় শহরে প্রতি পাঁচজন সমকামী বা উভকামী পুরুষের একজন এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। এ তথ্য সম্প্রতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিছু করলে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে মোটেই পিছপা হয় না, এটি তারই প্রমাণ। বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ লোক মুসলমান হওয়া সত্তে¡ও সমকামীদের উঁকি ঝুঁকি এখানেও লক্ষ করা যায়। ভারতে সমকামিতা বৈধ হওয়ায় তার ঢেউ এখানেও লাগতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দৃঢ়তা ও সামাজিক প্রতিরোধের বিকল্প নেই।
হজরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘অভিশপ্ত সে যে কিনা কোনো পশুর সঙ্গে কামাচার করে, আর অভিশপ্ত সে, যে কি না সেটা করে যা লুতের সম্প্রদায় করত।’ রাসূলুল্লাহ সা. আরেকটি হাদিসে সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক কওমে লুতের অপকর্মে লিপ্ত হবে। যখন এরূপ হতে দেখবে, তখন তাদের ওপরও অনুরূপ আজাব আসার অপেক্ষা করো।’
অতএব, সাবধান। সমকামিতার নিকটবর্তী হওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে এই ‘ব্যাধি’ প্রতিরোধে সতর্ক ও সক্রিয় হতে হবে। আল্লাহর কঠিন-কঠোর আজাব থেকে রেহাই পেতে আল্লাহর বিধান একনিষ্ঠভাবে অনুসরণের বিকল্প নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।