Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মজলুমের দোয়ায় আল্লাহর প্রতিশোধ

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

এক শাইখ বিকাল বেলা আল্লাহর তাসবিহ তাহলিল করছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে গেলেন বন পেরিয়ে এক নদীর পাশে। দেখতে পেলেন ছেলেরা খেলা করছে। খেলাটিও অভিনব, আর দৃশ্যটিও অমানবিক। তারা একটি কঙ্কালের মুন্ডুকে বল বানিয়ে খেলছে। শাইখ তাদের কাছে গিয়ে বললেন, এটি তোমরা কোথায় পেয়েছ? ছেলেরা জবাব দিলো, নদীতে ভেসে এসেছে। শাইখ তখন ছেলেদের খেলা বন্ধ করতে বলে, মাগরিবের নামাজে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। নিজে নামাজ পড়ে এসে মুন্ডুটিকে বনের এক কোণে দাফন করে দিলেন। তার মন উথাল-পাতাল। ভাবলেন, রাতে অনেকটা সময় নদীর পাড়ে বনেই আল্লাহর ধ্যানে ও স্মরণে মশগুল থাকবেন। এক সময় তিনি মোরাকাবায় বসলেন। মোরাকাবাতুল মউত, পাশাপাশি মোরাকাবাতু আসহাবিল কুবুর। উঁচু পর্যায়ের আধ্যাত্মিক সাধক হওয়ায় একসময় এই মুন্ডু ও এর পূর্ণ কঙ্কাল অতিক্রম করে শাইখের সংযোগ স্থাপিত হলো এর রূহের সাথে। হাদিস শরিফে আছে, যখন কোনো মুমিন বান্দা আরেক মুমিনের কবর পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেন, তখন আল্লাহ রূহের অবস্থানস্থল থেকে একপলকে এই কবরবাসীর রূহকে কবরে ফিরিয়ে দেন, সালামের জবাব দেয়ার জন্য। যদি জিয়ারতকারী মৃত ব্যক্তির পূর্ব পরিচিত হয়, তাহলে সে তাকে চিনতে পারে। এর আদব হলো, মৃত ব্যক্তির চেহারা ও বুকের দিকে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করা। (কিতাবুর রূহ: ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওজিয়্যাহ)। অনেক শাইখ এমনও আছেন, যারা কবরের পাশে মোরাকাবা করে মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক অবস্থা সম্পর্কেও জানতে পারেন। যেমন, তাবলীগের কাজ শুরু করার আগে মাওলানা ইলিয়াস রহ. দিল্লির প্রখ্যাত বুজুর্গগণের মাকবাবায় গিয়ে মোরাকাবা ও ধ্যান করতেন। (রাহে ই’তেদাল)। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. কেউ দেখেছি ঢাকা সোনারগাঁয়ে শাইখ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা রহ. এর কবরে মোরাকাবা করতে। আল্লামা নদভী রহ. এমন মোরাকাবা হজরত ইমাম আজম আবু হানিফা রহ., শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী রহ. সহ অসংখ্য মনীষীর কবরে করেছেন এবং তিনি তাদের পারলৌকিক উচ্চ মর্যাদার উপলব্ধিও হাসিল করেছেন।
প্রথমোক্ত শাইখ মোরাকাবায় পেলেন, আল্লাহর তরফ থেকে তার ক্বলবে ইলকা হলো যে, মুন্ডুটি একজন পরম প্রতাপাদিত্য শাসকের। যিনি নিজের পিতার পর তার আসনে বসেই রাজ্য চালাতেন। জুলুমের কোনো সীমা ছিল না। কথায় কথায় মানুষের গর্দান নিতেন। মজলুমের আর্তনাদ, এতিমের কান্না, বিধবার দীর্ঘশ্বাস বা মায়ের হাহাকার কিছুই তার কানে পৌঁছত না। বিরোধী মতের কাউকে সহ্য করতেন না। বিশেষ করে উপদেশদাতা জ্ঞানী ব্যক্তি ও পীর আউলিয়াদের বেশি নির্যাতন করতেন। একদিন এক দরিদ্র যুবককে তার নির্দেশে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার লোকেরা গর্বভরে তার কাটা মুন্ডু নিয়ে খেলা করে। তখন যুবকের মা ঘরে জায়নামাজে সেজদায় পড়েছিলেন। পুত্র হত্যার বিশদ সংবাদ পাওয়ার পরপরই মা দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। যদিও আমি চরম অসহায়, বাদশাহ সীমাহীন শক্তিশালী, কিন্তু পবিত্র কোরআনে তুমি বলেছ, ‘ওয়ামাল্লাহু বিগাফিলিন, আম্মা ইয়া’মালুজ জালিমুন।’ অর্থাৎ জালিমদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর ও উদাস নন। তোমার প্রিয় হাবিব বলেছেন, আল্লাহ বলেন, ‘যার কোনো উপায় নেই, তার উপায় আমি। এমন কৌশল দেখাব, যাতে দুনিয়ার সব কৌশলকারীরা হতভম্ব হয়ে যাবে।’ আল হাদিস। তুমি পরম ধৈর্যশীল, আবার নিখুঁত প্রতিশোধ পরায়ণ। ‘আসসাবুর ওয়াল মুনতাকিম।’ মা হিসাবে আমি চাই, পরকালের বিচার তো হবেই, আমার নিরপরাধ পুত্রের হত্যাকারী এই জালিম বাদশাহর কাটা মুন্ডু দিয়েও যেন মানুষ খেলা করে। হজরত শাইখের মোরাকাবায় আল্লাহর তরফ থেকে কাশফ ও ইলকা’র মাধ্যমে অতীতের এসব ঘটনা ফিল্ম রিওয়াইন্ড করার মতো দেখিয়ে দেয়া হলো। শাইখ ঘেমে নেয়ে উঠলেন। মোরাকাবা ভেঙে তিনি ইশা’র নামাজ শেষে এ ঘটনা শিষ্যদের মাঝে বর্ণনা করে কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখার নির্দেশ দেন। (ওয়াকায়েউশ শুয়ুখ)।
আল্লাহতায়ালার শক্তি ও ক্ষমতা বর্ণনা করতে গিয়ে খুতবায় বলা হয়, সম্রাটদের মাথা চূর্ণকারী, জালিমদের গর্ব খর্বকারী, স্বৈরশাসকদের হাঁড় পাঁজর ধুলোয় রূপান্তরকারী। কিন্তু মানুষ নিজের অবস্থানটি বুঝতে চায় না। পবিত্র কোরআনে বারবার আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র মালিক আমি আল্লাহ।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয় ইজ্জত ও সম্মান কেবল আল্লাহ রাসূল আর বিশ্বাসী বান্দাদের।’ আল কোরআন। প্রিয়নবী সা. বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বাঁচো, কারণ এই দোয়া ও আল্লাহর মাঝখানে কোনো আড়ার নেই।’ আল হাদিস। ইসলাম জগতের বড় বাদশাহরা রাত-দিন সুযোগ পেলেই আল্লাহকে বিনয়াবনত চিত্তে সেজদা করতেন। নিজের অহঙ্কার ধুলোয় মিশিয়ে দিতেন। জুলুম হচ্ছে কি না, এ ভয়ে ২৪ ঘণ্টা কাঁপতেন।
সুলতান মাহমুদ গজনভী প্রতি রাতে ইশা’র পর থেকে ফজর পর্যন্ত একটি আলাদা কক্ষে সময় কাটাতেন। তখন রাজকীয় পোশাক খুলে রেখে, তিনি তার অতীতের ছেঁড়া ময়লা পোশাকটি গায়ে দিয়ে রুকু সেজদা জিকির ও মোনাজাতের মধ্যে রাত পার করে দিতেন। ব্যক্তিগত খাদেম ও একদার দাস আয়াজ ছাড়া এ রহস্য আর কেউ জানত না। ফজরের জামাতে তারা দু’জনই পাশাপাশি দাঁড়াতেন। কবি ইকবাল তার কাব্যে বলেছেন, ‘ইসলাম মানুষকে কেমন নিরহঙ্কার করে, কতটুকু বিনয়ী ও সমতাবাদী করে এর প্রমাণ তোমরা দেখতে পারো সুলতান মাহমুদ ও দাস আয়াজের নামাজে দাঁড়ানো থেকে। মালিক ও গোলামের একই সাথে রাতজাগা, ইবাদত, তাহাজ্জুদ ও জিকির থেকে।’ পৃথিবীর সকল যুগের সকল শাসক ও শক্তিমান মানুষের জন্য কোরআন, হাদিস, ইতিহাস ও আউলিয়াদের জীবনীতে রয়েছে অনন্ত উপদেশমালা। ভাগ্যবানরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।



 

Show all comments
  • লোকমান ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১:৫০ এএম says : 0
    ভাগ্যবানরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।
    Total Reply(0) Reply
  • পাবন রহমান ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১:৫৩ এএম says : 0
    লেখাটির জন্য উবায়দুর রহমান খান নদভী হুজুরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি
    Total Reply(0) Reply
  • Golam Mohammed ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ৮:১৬ এএম says : 0
    পৃথিবীর সকল যুগের সকল শাসক ও শক্তিমান মানুষের জন্য কোরআন, হাদিস, ইতিহাস ও আউলিয়াদের জীবনীতে রয়েছে অনন্ত উপদেশমালা। ভাগ্যবানরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফ ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ৯:৪৩ এএম says : 0
    আল্লাহ জনাব নদভী সাহেবকে ও ইনকিলাব সংশ্লিষ্ট সকলকে এর উত্তম প্রতিধান প্রধান করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Azad. ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১১:৪৫ এএম says : 0
    This is a great feature that U have written. Thanks a lot. Please write this kind of Islamic feature that we can learn many things.
    Total Reply(0) Reply
  • ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ২:৪৫ পিএম says : 0
    جزاه الله احسن الجزاء
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন