Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আঁরার চাক্তাই খাল কডে

একসময় পণ্যবাহী বড় বড় নৌকা ছুটত সমৃদ্ধির খাল এখন চাটগাঁর দুঃখ

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

চাক্তাই খাল’দি এক শয়ৎ বড় বড় নৌকা-ছাম্পান আইসত্যু। এ খালরে ঘিরি চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জ অতব্যবসা-বাণিজ্য শুরু অইয়ি। খাল ভরি গিইয়্যে, মাইনষ্যে দহল গরি বাড়ি-ঘর-দোয়ান বাইনদ্যে। আঁরার আগের হেই চাক্তাই খাল এহন হডে? (চাক্তাই খাল হয়ে একসময় বড় বড় নৌকা-সাম্পান আসতো। এ খালকে ঘিরেই চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আছদগঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়। খাল এখন ভরাট হয়ে গেছে। খাল দখল করে মানুষ বাড়িঘর দোকান-পাট তুলেছে। আমাদের আগের সেই চাক্তাই খাল এখন কোথায়?) ফুলতলায় চাক্তাই খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আক্ষেপের সাথে কথাগুলো বলছিলেন বৃদ্ধ আবুল হাশেম।
তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন কেটেছে চাক্তাই খালের পাড়ে। আবুল হাশেমের মতো চাক্তাই খালপাড়ের বাসিন্দা ব্যবসায়ী ওমর আজম, স্বপন কুমার দে, মো. খোরশেদ আলমও বললেন, খালের মরণদশার কাহিনী। নির্বিচারে পাহাড় নিধন, অপরিকল্পিত নগরায়ন আর বেপরোয়া দখলবাজিতে নগরীর যেসব খাল হারিয়ে যেতে বসেছে তার অন্যতম প্রধান খাল চাক্তাই। নগরীর বহদ্দারহাট থেকে চকবাজার, বাকলিয়া হয়ে প্রায় আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল কর্ণফুলীতে মিশেছে। বেপরোয়া দখল আর দূষণে চাক্তাই খাল এখন সরু-মৃতপ্রায়। সমৃদ্ধির এই খাল-ই এখন নগরবাসীর জন্য দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খাল ভরাট আর দখল হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারেও প্লাবিত হচ্ছে আশপাশের এলাকা। ভারী বর্ষণ হলে হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বিশাল অংশ। নগরীতে স্থায়ী পানিবদ্ধতার মূলেই রয়েছে চাক্তাই খালসহ বড় বড় খাল ভরাট আর বেদখল হয়ে যাওয়া। একসময় এই খাল হয়ে নৌপথে কম খরচে পণ্য চলে যেতো দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এখন খালে বড় নৌকা ভিড়তে পারে না। ট্রাকে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে একদিকে যানজট বাড়ছে, অন্যদিকে পরিবহন খরচের সাথে বাড়ছে পণ্যমূল্যও। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে।
চাক্তাই খাল উদ্ধারে বিগত তিন দশকে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যয় করা হয়েছে শত শত কোটি টাকা। কিন্তু সুফল মেলেনি। খালের পাড় দখলমুক্ত করে কিছু কিছু এলাকায় পাকা দেয়াল ও পাড় নির্মাণ করা হলেও বেশিরভাগ এলাকায় এখনও অরক্ষিত। ফলে যে যার মতো করে খাল দখল করছে, তৈরি করছে স্থাপনা। কোথাও আবার ভাঙনও দেখা দিয়েছে। প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অংশ হিসেবে খালের কিছু অংশে মাটি সরানো হলেও জোয়ারের সাথে নেমে আসা ময়লা-আবর্জনায় তা আবার ভরাট হয়ে গেছে। সরেজমিন ঘুরে খালের বিভিন্ন পয়েন্টে এমন বেহাল চিত্র দেখা গেছে।
খরস্রোতা কর্ণফুলীর শাখা খাল চাক্তাই। এ খালের দৈর্ঘ্য প্রায় আট কিলোমিটার। প্রস্থ কোথাও ৬০ ফুট, কোথাও ৪০ ফুট ছিল। কালক্রমে খালটি সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসনের হিসাবে ৪৭ জন দখলদার খালটির ৮২ শতাংশই দখল করে নিয়েছে। দখলদারদের তালিকাও রয়েছে প্রশাসনের হাতে। বারবার উদ্যোগ নিয়েও এসব দখলদারদের উচ্ছেদ করা যায়নি। অবৈধ দখলমুক্ত হয়নি গুরুত্বপূর্ণ এ খালটি।
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ওমর আজম বলেন, নির্বিচারে পাহাড় কর্তনে খাল ভরাট হয়ে গেছে, দখলে হয়েছে সরু। বর্ষায় আশপাশের বিরাট এলাকা প্লাবিত হয়। এর ফলে দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছাদগঞ্জ এলাকায় কোটি কোটি টাকা মালামাল বিনষ্ট হয়। অথচ আগে এ খালে বড় বড় পণ্যবাহী নৌকা-সাম্পান ভিড়তো। মালামাল নিয়ে নৌপথে প্রতিদিন শত শত নৌকা বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যেতো। এক নৌকার পণ্য পরিবহন করতেই প্রয়োজন হচ্ছে অন্তত ১০টি ট্রাকের। ট্রাকের ভিড়ে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ স্থবির হয়ে পড়ছে। যার প্রভাবে যানজট হচ্ছে পুরো নগরীতে।
খালের পূর্ব পাড়ে চাক্তাই ফুলতলায় হার্ডওয়্যারের দোকানের মালিক স্বপন কুমার দে বলেন, দুই যুগ ধরে খালের পাড়ে আছি। দেখছি কিভাবে খাল দখল হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর বর্ষার আগে কিছু মাটি সরানো হলেও দুই একদিনের মধ্যে তা আবার ভরাট হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক জোয়ারে তার দোকানে পানি উঠে না। তবে অমাবস্যা-পূর্ণিমা কিংবা ভারী বর্ষণের সাথে জোয়ার হলে আশপাশের সব দোকান আর গুদামে কোমর সমান পানি উঠে।
খালের পশ্চিম পাড়ে খাতুনগঞ্জে ‘রামপুর সিন্ডিকেটে’র ব্যবসার বয়স প্রায় অর্ধ বছর। ব্যবসায়ী মো. খোরশেদ আলম পিতার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিশুকাল থেকে চাক্তাই খাল দেখে আসছেন তিনি। তিনি জানালেন একসময় এ খাল দিয়ে স›দ্বীপ, হাতিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, বাঁশখালী এবং নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বড় বড় নৌকায় পণ্য নিয়ে যেতেন। ১০-১২ বছর আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেত। কিন্তু এখন তা শুধু স্মৃতি। কিছু নৌকা দেখা যায় কর্ণফুলী লাগোয়া খালের মুখে। বেশিরভাগ পণ্য পরিবহন হয় ট্রাকে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী নুরুল হক বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলে ফের দখল শুরু হয়। দখলবাজি ঠেকানো যায়নি। খালের প্রস্থ ৬০ ফুট থেকে সংকুচিত হয়ে ৪০ ফুটে চলে এসেছে, কোথাও আরও কম। চাক্তাই খাল খননের আগে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, কর্ণফুলীর গভীরতা বাড়লে খাল থেকে দ্রুত পলি মাটি নদীতে চলে যাবে। নদী ড্রেজিং না করে খালের মাটি সরিয়ে কোন লাভ নেই।
এদিকে চাক্তাই খালের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে উদ্যোগের শেষ নেই। সম্প্রতি নদী সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় চট্টগ্রামের চাক্তাই খালের সীমানা পুননির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনকে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছিল। তবে সে প্রতিবেদন এখনো তৈরি হয়নি। দখলদারদের তালিকা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সাহস কেউ করেন না। পানিবদ্ধতা নিরসনে মেগা প্রকল্পের আওতায় চাক্তাই খালসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন ও তলানির বর্জ্য অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। সিডিএর কর্মকর্তারা জানান, মোট ৩৬টি খাল খনন করা হবে। এর মধ্যে চাক্তাই ও মহেশখালের কিছু অংশে মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। নগরীতে খালের সংখ্যা ৫৭টি হলেও পানি নিষ্কাশনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান দুইটি খালের একটি চাক্তাই। এদিকে জোয়ারের পানি আটকাতে চাক্তাই খালের মুখে স্লইস গেইট বসানোরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের সুফল আদৌ মিলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ