Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ভবিষ্যৎ কী

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বনেদী ‘সওদাগরী পাড়া’। অনাদরে অবহেলায় কালক্রমে আজ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ সামগ্রিকভাবে গভীর অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে। দু’শ বছরের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির ধারক সুবিশাল এই ব্যবসায়িক এলাকাটির ভবিষ্যৎ কোথায়? বর্তমানই বা কী? গভীর হতাশা ক্ষোভ-অসন্তোষ বুকে নিয়ে এখানকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ওই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন। আর সমৃদ্ধ অতীতের সঙ্গে বর্তমান দুর্দশাগুলো পদে পদে মিলিয়ে দেখছেন। স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। নানামুখী সঙ্কট ঘিরে ধরেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জকে। এর মধ্যে প্রধান সঙ্কট বর্ষাজুড়ে ও আগে-পরে বৃষ্টি আর জোয়ারে পানিবদ্ধতা। এর পাশাপাশি রয়েছে ‘ব্রিফকেস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত অসৎ তথাকথিত ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বৃদ্ধি, ঠগবাজি, প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গের বিভিন্ন ঘটনায় সার্বিকভাবে আস্থার সঙ্কট। আছে নীরব চাঁদাবাজি সন্ত্রাসও। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, অলিগলি, নালা-নর্দমাসহ অবকাঠামো সুবিধা অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। বিস্তীর্ণ এই সওদাগরী পাড়ার মূল প্রাণপ্রবাহ ছিল চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান খাল চাক্তাই খাল। একে নির্বিচারে দখল-দূষণ ও ভরাটের পরিণামে দীর্ঘদিন ধরে ‘চট্টগ্রামের বারমাইস্যা দুঃখ ও আপদ’ হয়ে আছে সেই চাক্তাই খাল এবং এর সাথে যুক্ত খাল-ছরা, নালা-নর্দমাগুলো। অথচ একদা চাক্তাই খাল দিয়ে মালামাল বোঝাই নৌকার বহর ভোর থেকে রাত অবধি ছুটে যেতো বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জের সবচেয়ে বড় সমস্যা-সঙ্কট এমনকি আতঙ্ক হিসেবে চেপে বসেছে পানিবদ্ধতা। এবার বর্ষা মৌসুমে বর্ষা ও তার আগে-পরে মারাত্মক পানিবদ্ধতার কবলে পড়ে দফায় দফায়। এতে করে শত শত দোকান-পাট, গুদাম, আড়ত, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৮শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি। এবারের পানিবদ্ধতার ভয়াবহতার তিক্ত অভিজ্ঞতায় গত প্রায় দু’মাসে কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গেছে। কেউ কেউ ঢাকায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছেন। আবার কেউ কেউ চাক্তাই খাতুনগঞ্জে নিদেনপক্ষে একটি লিয়াজোঁ অফিস চালু রেখে মূল অফিস অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইছেন। তবে অনেকে আগেই হেড অফিস চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে কিংবা ঢাকায় স্থানান্তর করে নিয়েছেন।
আলাপকালে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জ থেকে বার্ষিক হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব রাষ্ট্রকে জোগান দেয়া হয়। প্রতিদিন হাজার কোটি টাকা মূল্যের নিত্য ও ভোগ্য পণ্যসামগ্রীর হাতবদল হচ্ছে। অথচ দীর্ঘদিনের অবহেলা ও নির্লিপ্ততা একই সাথে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ছালামের অপরিকল্পিত, যথেচ্ছ উন্নয়ন যন্ত্রণার কারণে আজ চাক্তাই খাতুনগঞ্জ অতীত গৌরব ও গুরুত্ব হারাতে বসেছে। চট্টগ্রামের কর্ণধারদের অদূরদর্শিতা, যথেচ্ছ কর্মকান্ড আর সার্বিক সমন্বয়ের অভাবকে দুষছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগণ। তারা বহুবার কর্তা-কর্ণধারদের কাছে ধরনা দিয়েও ‘হবে-হচ্ছে’ ‘করবো করছি’ ছাড়া কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এ যাবত দেখতে পাননি। এরফলে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এ নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এ বছর বর্ষা নাজুক পরিস্থিতিতে কেটেছে। সামনের বর্ষায় পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। কেননা চাক্তাই খাল পরিকল্পিবভাবে খনন ও রাস্তাঘাট মেরামত, নালা-নর্দমা সংস্কারের কোন পদক্ষেপ এখনও গ্রহণ করা হয়নি। সিডিএ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্বিকার। অথচ সংস্থাটির চেয়ারম্যান ‘উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে’ দেয়ার দাবি করছেন হরহামেশাই। গত বছর বর্ষার তুলনায় এবার বেশি পানিবদ্ধতায় ডুবেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। প্রতিবছর এখানে হঠাৎ করেই কয়েক দফায় সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতা। আর এতে শত কোটি টাকার মালামাল বিনষ্ট হয়। আগামী বর্ষায় অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এ নিয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ভয়ে-আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় দিনগুজরান করছেন। বছর বছর এই পানিবদ্ধতা ক্রনিক সমস্যা-সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান চেয়ে ব্যবসায়ী নেতারা ইতোমধ্যে কয়েকবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আশারবাণীও শোনানো হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত সমাধানের কোনই আলামত দেখা মিলছে না।
ফি-বছর প্রাক-বর্ষা, ভরা বর্ষায় এবং বর্ষাত্তোর হঠাৎ ভারী বর্ষণের সাথে সামুদ্রিক প্রবল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের সওদাগরী পাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ। ‘চট্টগ্রামের দুঃখ’ চাক্তাই খালের দুই কুল উপচে গিয়ে নগরীর এই সুবিশাল এলাকা দফায় দফায় প্লাবিত হয়। তখনই চাক্তাই খাতুনগঞ্জজুড়ে সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতা। তলিয়ে যায় নিত্যপণ্য-ভর্তি শত শত দোকানপাট, গুদাম ও আড়ত। আর এ সময় অনেকাংশ মালামালই জোয়ার, কাদা-পানিতে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। যার আর্থিক পরিমান শত কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের মা-বাপ নেই।
শুধুই চাক্তাই খাতুনগঞ্জই নয়; কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ, রাজাখালীসহ নগরীর বিস্তীর্ণ প্রধান ব্যবসায়িক এলাকা প্লাবিত হয়। চাক্তাই খালের গভীরতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া কর্ণফুলীর মোহনায় নির্বিচারে দখল, ভরাট ও দূষণের কারণে চাক্তাই খালের মুখ উঁচু ও ভরাট হয়ে গেছে। এতে করে অল্পক্ষণ ধরে ভারী বর্ষণের সাথে সাথেই কর্ণফুলী নদীর জোয়ার যুক্ত হয়ে চাক্তাই খালের উভয় পাড় ছাপিয়ে সমগ্র সওদাগরী পাড়া তলিয়ে যায়। পানিবদ্ধতায় এখানকার সবক’টি সড়ক, রাস্তা-ঘাট, অলিগলি ৩/৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে থাকে। যা বছর বছর রীতিমতো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগের রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মাঝে পানিবদ্ধতা সঙ্কট উত্তরণের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছে। কিন্তু কর্তারা যেন কানে তুলো দিয়ে বসে আছেন।
দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায়কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সওদাগরী বাণিজ্য পাড়া খ্যাত চাক্তাই খাতুনগঞ্জে দৈনিক গড়ে ১২শ’ কোটি টাকা থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী হাতবদল হয়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নগদ ও বাকিতে অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। হরেক রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি, ইন্ডেন্টিং বাজার হচ্ছে দু’শত বর্ষের প্রাচীন চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। এটি প্রাচীনকাল থেকেই দেশের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ব্যবসায়িক এলাকা। বর্ষা ও দুর্যোগের মওসুমে মারাত্মক পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসন ব্যবসায়ীমহলের দীর্ঘদিনের প্রধান দাবি। অনুন্নত রাস্তা-ঘাট নালা-নর্দমা সংস্কার, ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ড্রেজিং ও সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। পরিকল্পিতভাবে সওদাগরী পাড়াকে ঢেলে সাজানোরও দাবি উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।
চট্টগ্রামকে ছাপিয়ে রাজধানী ঢাকার অনেক শীর্ষস্থানীয় বণিক-শিল্পপতি ও প্রধান প্রধান ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারদের মূল ব্যবসা-বাণিজ্যিক অফিস অথবা একেকটি করে লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ কিংবা আছদগঞ্জে। শুধুই শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের ৬ দিনে গড়ে প্রতিদিন এখানে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রায় অর্ধশত শাখা রয়েছে। কোন কোন ব্যাংকের একাধিক শাখাও রয়েছে। ১২ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে প্রায় ১০/১২ হাজার ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ও আশপাশজুড়ে। এখান থেকেই ব্যবসা শুরু করে আজ অনেকদূর এগিয়ে গেছে দেশের অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় আমদানি-রফতানিকারক, বণিক ও শিল্পগ্রুপ। সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ঐতিহ্য ও গুরুত্বকে অটুট রাখতে হলে এরজন্য এ অঞ্চলকে দেশের ‘বাণিজ্যিক জোন’ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলাই অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যকে ঘিরে করে কর্ণফুলী নদী ও এর সংলগ্ন চাক্তাই খালের কিনারাজুড়ে ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য স¤প্রসারিত হয়ে গড়ে উঠেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ কোরবানীগঞ্জ সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাব-জজ হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় স্ত্রী মোছাম্মৎ খাতুন বিবির নামানুসারে এখানকার সওদাগরী ব্যবসায়িক পাড়া খাতুনগঞ্জ গড়ে ওঠে। তবে পুরনো সওদাগরী পাড়া চাক্তাই গড়ে ওঠে আরও আগে। সম্রাট বাবরের শাসনামলে পালতোলা জাহাজ নিয়ে আরব, পারস্য ও মধ্য-এশিয়ার সওদাগররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপদ পোতাশ্রয় দিয়ে আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এসময়ে তুর্কী বণিকরা চট্টগ্রামের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হন। তাদের অন্যতম ছিলেন প্রাচীন তুরস্কের অতিচৌকস, বনেদী ও ‘জাত’ ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত ‘চুগতাই’ সওদাগরগণ। তাদেরই নাম ও খ্যাতির স্বর্ণযুগের সাথে জড়িয়ে চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়-বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ‘চাক্তাই’ হিসেবে পরিচিতি ও সুখ্যাতি লাভ করে। সার্বিক নাজুকদশায় তা অতীত হতে চলেছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ