পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
শফিউল আলম : বিশ্বাস বাবু মরে গেছেন! দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসাকেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ‘সওদাগরী বাণিজ্য পাড়া’ খ্যাত চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়ীদের কাছে এই কথাটা মুখে মুখে প্রচলিত। আগে ব্যবসায়ীদের মুখের কথায় ও মামুলি একটি চিরকুট বা সিøপের উপর নির্ভর করে প্রতিদিন শত কোটি টাকার লেনদেন হতো অনায়াসেই। এখন এসবে কাজ হয় না। ব্যাংকের চেকেও ভরসা নড়বড়ে। বর্তমানে এক কথায় চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিশ্বাস অচল। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে গাঁ ঢাকা দেয়ার একের পর এক ঘটনায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। এই অবিশ্বাস এখন আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায়ীরা পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখেন। যে কোন লেনদেনের সময় চূড়ান্তভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। সুবিশাল বিস্তৃত ব্যবসা-বাণিজ্য পাড়া চাক্তাই খাতুনগঞ্জে রয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের প্রায় অর্ধশত শাখা। সেই ব্যাংকপাড়ায়ও বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। এহেন গভীর সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে। তাছাড়া খাতুনগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যবসায়ী ও শিল্প গ্রুপ মূল ভোগ্যপণ্য আমদানি ও ইন্ডেন্টিং ব্যবসায় থেকে ক্রমশ নিজেদের গুটিয়ে নেয়ায় ব্যবসায়-বাণিজ্যে মন্দাদশা বিরাজ করছে। তবে এ সমস্যা সাময়িক বলে মনে করেন বনেদী ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, হরেক রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারী, ইন্ডেন্টিং বাজার হচ্ছে শতবর্ষের প্রাচীন চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। এটি প্রাচীনকাল থেকেই দেশের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ব্যবসায়িক এলাকা। এখানে দৈনিক গড়ে ১২শ’ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী হাতবদল এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নগদ অর্থ লেনদেন হয়ে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষত ব্যবসায়িক প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে ‘ব্রিফকেস পার্টি’র তথাকথিত ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়ে কিংবা বিভিন্ন অপকৌশলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করে গা-ঢাকা দেয়ার মতো একের পর এক ঘটনাবলী বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। গত ৫ বছরে প্রায় ৭০ কোটি টাকা প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে আত্মসাতের ঘটনা ঘটে গেছে। এতে করে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে সন্দেহ-অবিশ্বাস ক্রমাগতভাবেই দানা বেঁধে উঠেছে। অথচ চাক্তাই খাতুনগঞ্জের প্রথাগত ব্যবসায়িক কর্মকা-ে টাকার পুঁজির চেয়েও সবচেয়ে বড় ‘পুঁজি’ হিসেবে মনে করা হতো মুখের কথার উপর পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জে প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গ কিংবা হরেক অপকৌশলে ধূর্ত ব্রিফকেস সর্বস্ব তথাকথিত ব্যবসায়ীরা অর্থআত্মসাতের ঘটনার যাতে আর পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে এরজন্য এখানকার প্রকৃত ও ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে ‘ঠকবাজদের প্রতিরোধের নীতি’ অনুসরণ করে চলছেন। বনেদী ও ঐতিহ্যবাহী সওদাগরী বাণিজ্যিকপাড়া বন্দরনগরীর চাক্তাই খাতুনগঞ্জের কর্মচাঞ্চল্য আরও বৃদ্ধি করে এর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সুখ্যাতির ধারা ফিরিয়ে আনতে বিলম্বে হলেও সচেষ্ট হয়েছেন বণিক-সওদাগরবৃন্দ। একযোগে ঘুরে দাঁড়াতে চান এ অঞ্চলের নামীদামী শিল্পপতি ও সওদাগরগণ। এরজন্য নিজেদের মধ্যে তারা ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা চান অবিশ্বাসের মতো বড় সংকট কাটিয়ে উঠতে। অবশ্য এ ধরনের উদ্যোগ ইতিপূর্বেও গ্রহণ করা হয়েছিল।
‘অচল’ বিশ্বাসকে সচল করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি বর্ষা মওসুমে মারাত্মক পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসন, অনুন্নত রাস্তা-ঘাট, নালা-নর্দমা, সংস্কার, ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ লাইন হিসেবে বিবেচিত চাক্তাই খাল ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ড্রেজিং ও সংস্কার, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি রোধসহ আইন-শৃঙ্খলা ও বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং সমস্যা নিরসন, অবকাঠামো সুবিধার উন্নয়নসহ চাক্তাই খাতুনগঞ্জের যুগোপযোগী আধুনিকায়নের বিষয়ে সওদাগরদের সুচিন্তিত মতামত, দাবি ও প্রস্তাব রয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ী নেতারা সেসব দাবি ও প্রস্তাব সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন। তারা আশাবাদী চাক্তাই খাতুনগঞ্জ সমস্যা-সংকটের জট থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে। গত বর্ষার মওসুমের শেষ দিকে প্রবলবর্ষণ ও সামুদ্রিক জোয়ারে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে টানা কয়েকদিনের পানিবদ্ধতায় পাঁচ শতাধিক দোকান, গুদাম ও আড়তে কয়েকশ’ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী বিনষ্ট হয়। যা ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর এ যাবত সবচেয়ে বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা। এরপর থেকে ব্যবসায়ীরা পানিবদ্ধতা সংকট থেকে উত্তরণের দাবি জানিয়ে আসছে।
চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম মনে করেন, দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি চাক্তাই খাতুনগঞ্জ। এখানে সমস্যা অনেক। তবে এসব সমস্যা একে একে নিরসন করা বিশেষ করে একটি আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে জাতীয় স্বার্থেই আমরা সচেষ্ট। চাক্তাই খাতুনগঞ্জ অচিরেই দেশের আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হবে। ব্যবসায়ীরা আস্থা ফিরে পেতে শুরু করেছেন। পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসনসহ আমরা আরও পরিকল্পিত উন্নয়ন চাই। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশের সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যম-িত সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া চাক্তাই খাতুনগঞ্জের সুখ্যাতি ফিরিয়ে আনা ও এখানকার বিশ্বাসের পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ এখনই জরুরী।
চট্টগ্রাম ছাপিয়ে ঢাকার অনেক শীর্ষস্থানীয় বণিক-শিল্পপতি ও প্রধান প্রধান ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধারদের মূল ব্যবসা-বাণিজ্যিক অফিস অথবা একেকটি করে লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জে। শুধুই শুক্রবার ও সরকারী ছুটির দিন বাদে সপ্তাহের ৬ দিনে গড়ে প্রতিদিন এখানে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ৪৮টি শাখা রয়েছে। কোন কোন ব্যাংকের একাধিক শাখাও রয়েছে। ১২ বর্গকিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে প্রায় ১০/১২ হাজার ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে। এখান থেকেই ব্যবসা শুরু করে আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে দেশের অনেকগুলো শীর্ষস্থানীয় আমদানি-রফতানিকারক, বণিক ও শিল্পগ্রুপ।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের পুরনো ঐতিহ্য ও গুরুত্বকে অটুট রাখার জন্য এ অঞ্চলকে দেশের ‘বাণিজ্যিক জোন’ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা অপরিহার্য। এই সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব জোগান দেয়া হয়। তাই এখানকার উন্নয়নের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যকে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী নদী ও এর সংলগ্ন চাক্তাই খালের কিনারাজুড়ে ব্রিটিশ আমলে ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়ে গড়ে উঠেছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আছদগঞ্জ কোরবানীগঞ্জ সওদাগরী বাণিজ্যপাড়া। ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাব-জজ হামিদুল্লাহ খানের দ্বিতীয় স্ত্রী মোছাম্মৎ খাতুন বিবির নামানুসারে এখানকার সওদাগরী ব্যবসায়িক পাড়া খাতুনগঞ্জ গড়ে ওঠে। তবে পুরনো সওদাগরী পাড়া চাক্তাই গড়ে ওঠে আরও আগে। সম্রাট বাবরের শাসনামলে পালতোলা জাহাজ নিয়ে আরব, পারস্য ও মধ্য-এশিয়ার সওদাগররা চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপদ পোতাশ্রয় দিয়ে আন্তঃদেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। এসময়ে তুর্কী বণিকরা চট্টগ্রামের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট হন। তাদের অন্যতম ছিলেন প্রাচীন তুরস্কের অতিচৌকস, বনেদী ও ‘জাত’ ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত ‘চুগতাই’ সওদাগরগণ। তাদেরই নাম ও খ্যাতির স্বর্ণযুগের সাথে জড়িয়ে চট্টগ্রামের এ ব্যবসায়-বাণিজ্যিক অঞ্চলটি চাক্তাই হিসেবে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।