বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আমাদের প্রিয়নবী, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত, আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, আকায়ে নামদার, সারওয়ারে কায়েনাত, সারকারে দো আলম, তাজদারে মদিনা, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। এ কথাটি বলতে বলতে এবং শুনতে শুনতে আমরা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, এর সুগভীর মর্ম অনুধাবনে যথেষ্ট উদাসীন হয়ে গেছি।
মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও সামাজিক জীবনের চিন্তা ও মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত, উপলব্ধি ও অনুভূতিপ্রকাশ কেমন হওয়া উচিত, বাহ্যিক আচার ও তৎপরতা কেমন হওয়া উচিত, নিজের ও অন্যের ক্ষেত্রে পছন্দ ও সিদ্ধান্তগত সমন্বয়বিধানের দিকটি কেমন হওয়া উচিত, এ সবকিছুর সুবিন্যস্ত সুসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি ও বাস্তব উদাহরণ হিসেবে যাঁর জীবনের প্রতিটি উপদেশ, নির্দেশ, কর্ম ও কাহিনি আমাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট অনুসরণীয় আদর্শ তিনিই তো আল্লাহর হাবীব, আমাদের জীবনযাপন, পরিবার-পরিজন থেকেও প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চৈন্তিক, আচরণিক, মানবিক ও ব্যবহারিক জীবন আদর্শকেই আমরা সুন্নাহ বা সুন্নাত বলে থাকি। আর এই সুন্নাতসমূহকে নিজেদের জীবনে ধারণ ও পালন করার অর্থই হলো নবীর সুন্নাতের অনুসারী হওয়া বা এক কথায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসারী হওয়া।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অনুসারী হওয়ার জন্য ঈমান শর্ত। কোনো অমুসলিম যদি রাসূলের কিছু কিছু নীতি ও আচরণকে অনুসরণ করেও, তবুও তাকে সুন্নাতের অনুসারী বলা যাবে না। কারণ, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশ্বাসীই নয়, অর্থাৎ মুমিন নয়। অতএব, পৃথিবীর সমস্ত মুমিন ও মুসলিমরাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী; কেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্নাতটিই হচ্ছে ঈমান। ঈমানের পাশাপাশি নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ আল্লাহর অনেক বিধান ও নির্দেশ রয়েছে যা আমাদের জন্য ফরজ আমল এবং এসব ফরজ বিধানসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূলের মাধ্যমেই আমাদের নিকট এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আমল করে আমাদের শিখিয়েছেন বলেই আমরা শিখেছি এবং আমাদেরও আমল করতে বলেছেন বলেই আমরা আমল করি। অতএব, এসব বিধান আল্লাহর পক্ষ হতে আরোপিত ফরজ হওয়ার পাশাপাশি রাসূলের নির্দেশিত সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। তদ্রুপ রাসূলের জীবনাচার থেকে পাওয়া অন্য সব সুন্নাত আমাদের জন্য সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ না হলেও নিদর্শনস্বরূপ; যা আমাদের জন্য অনুকরণীয় করে দিয়েই পবিত্র কোরআনে একে ‘উসাওয়াতুন হাসানাহ’ বা উত্তম আদর্শ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে কোনো সুন্নাতের অনুসরণ আল্লাহর নিদর্শন ও নির্দেশনারই অনুসরণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতকে নানা আঙ্গিক থেকে বিশ্লেষণ ও বিন্যস্ত করা যায়।
প্রথমত ধরে নেয়া যায় সুন্নাত দুই প্রকার :
এক. আল্লাহর সমস্ত বিধান, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন ও বুঝিয়েছেন, শিখিয়েছেন, করে দিয়েছেন এবং করতে বলেছেন। এগুলো আল্লাহরও বিধান এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরও সুন্নাত।
দুই. রাসূলের নিজস্ব রুচি বৈশিষ্ট্য ও জীবনাচার, যা আল্লাহই মানব জাতির অনুসরণীয় আদর্শ হিসাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্তা ব্যক্তিত্ব ও জীবনের সঙ্গেই জুড়ে দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন এবং ‘উত্তম আদর্শ’ বা ‘উসওয়াতুন হাসানাহ’ বিশেষণে কোরআনে উল্লেখ করেছেন এবং মানুষকে তা অনুসরণের নির্দেশনা দিয়েছেন।
দ্বিতীয় প্রকার সুন্নাত অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাচার থেকে পাওয়া সুন্নাতকেও প্রথমে দুটো ভাগে ভাগ করে নেয়া যায় :
এক. পরোক্ষ সুন্নাত। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি-উপলব্ধি, বিশ্বাস-বিবেচনা, মন-মানসিকতা, বিবেক ও বিচার-বুদ্ধির ধারণ-ধরন, প্রকাশ ও প্রয়োগের দৃষ্টি-গতি, আন্দাজ-মেজাজ ও মাত্রা।
দুই. প্রত্যক্ষ সুন্নাত। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা-কাজ-নির্দেশ, আচার-আচরণ-তৎপরতা, রুচি-পছন্দ-আগ্রহ-অভ্যাস, আদেশ-আকাক্সক্ষা, পরামর্শ, নির্দেশনা ও সমর্থন।
এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রকার সুন্নাত, অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরোক্ষ সুন্নাতসমূহ সঠিকভাবে অনুধাবন ও অনুকরণ করতে পারা খুব কমসংখ্যক মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়ে থাকে। এর জন্য যে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন, যতটুকু সূ² উপলব্ধি ও নিরীক্ষণ ক্ষমতার প্রয়োজন, তা উম্মতের অতি অল্প মনোনীত মানুষকেই আল্লাহ দান করেন, যাদের চিনতে ও বুঝতে পারাও অন্য সবার পক্ষে সহজ নয়, এমনকি সম্ভবও নয়।
আর দ্বিতীয় প্রকার সুন্নাত, অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যক্ষ সুন্নাতসমূহের মধ্যেও আবার কিছু ভাগ রয়েছে :
এক. একান্ত ব্যক্তিগত রুচি-অভ্যাস।
দুই. পারিবারিক রীতি-নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য।
তিন. সামাজিক ও পারিবারিক আচরণ, শিক্ষা ও নির্দেশনা।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পরিমন্ডলেও এই তৃতীয় প্রকারটির বর্ধিত ও সম্প্রসারিত চর্চাই প্রযোজ্য হয়ে থাকে। সর্বোপরি এই সমস্ত প্রকারের সুন্নাতকে বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে আরো দু’রকম ভাগে বিন্যস্ত করা যায় :
এক. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহ্যিক কথা, কর্ম ও সমর্থন ।
দুই. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য ও আদর্শ। অথবা এক. আচরণগত সুন্নাত। দুই. নীতিগত সুন্নাত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।