পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিচের মৌলিক ত্রুটিগুলো রয়েছে ঃ
১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২. এই আইন পুলিশকে বাসাবাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এ আইনে দেওয়া ক্ষমতাবলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারী সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।
২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণীত হওয়ার সময় সরকার বলেছিল, সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ, আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকসহ অন্য যাঁরা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গেছেন, তাঁরা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কারাভোগ করেছেন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এখনো একইভাবে বলা হচ্ছে যে, সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি, কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে, এই আইনেও সাংবাদিকেরা আবার একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হবেন। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এ আইনের উদ্দেশ্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সঙ্ঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার’ করা। তাই এ আইন নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছ নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তার সংজ্ঞায়িত পরিধি অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতার পরিধির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, যে সাংবাদিকতা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কাজ ডিজিটাল প্রযুক্তির জগৎ নিয়ে, যে জগৎ অবিরাম বিকশিত হয়ে চলেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি জীবনের সর্বস্তরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা থেকে খাদ্য উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক লেনদেন পর্যন্ত সর্বত্রই ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমও এর বাইরে নেই।
অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজন ‘নিয়ন্ত্রণ’, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কেন্দ্রীয় বিষয় কেবলই ‘নিয়ন্ত্রণ’, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এতে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম মৌলিক ত্রুটি, এর ফলে এ আইন সংবাদমাধ্যমের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটা ভীতিকর দিক হলো, এতে পুলিশকে এমন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যার বলে একজন সাংবাদিক ভবিষ্যতে তথাকথিত কোনো অপরাধ করতে পারেন কেবল এই সন্দেহে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে পারবে। পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো জামিনঅযোগ্য। এর ফলে সাংবাদিকতা বাস্তবত পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়বে।
উদ্বেগের আরও একটি বিষয় হলো, এ আইনের অপরাধ ও শাস্তিসংক্রান্ত প্রায় ২০টি ধারার মধ্যে ১৪টি জামিন-অযোগ্য, ৫টি জামিনযোগ্য এবং একটি সমঝোতাসাপেক্ষ। ন্যূনতম শাস্তির মেয়াদ করা হয়েছে ১ বছর কারাদন্ড, সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ ৪ বছর থেকে ৭ বছর কারাদন্ড। এর ফলে অনিবার্যভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেখানে সাংবাদিকতার স্বাভাবিক অনুশীলন অসম্ভব না হলেও হয়ে উঠবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আইনটি শুধু তার উদ্দেশ্যের সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত কেবল লঙ্ঘনই করেনি, এটি অস্পষ্টতায়ও পরিপূর্ণ। অস্পষ্টতার কারণে এ আইন অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। দেশবিদেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব আইনের শব্দচয়ন সুস্পষ্ট, যেখানে অপরাধগুলো সুনির্দিষ্ট এবং অপরাধের সঙ্গে শাস্তির মাত্রা সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেসবের মাধ্যমে ‘আইনের শাসন’ ভালোভাবে অর্জিত হয়। আইনের ভাষাগত অস্পষ্টতা থেকে অপরাধ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা এবং আইনের অপব্যবহারের সুযোগ ঘটে থাকে। যখন আইনের অপব্যবহার ঘটে, তখন স্বাধীনতা খর্বিত হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আরেক ত্রুটি হলো ‘অপরাধীদের’ শাস্তির মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে একই সময়ে পাস করা সড়ক নিরাপত্তা আইনের কথা বলা যায়। এ আইনে দুর্ঘটনায় মানুষ মেরে ফেলার সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ বছরের কারাদন্ড। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিধান করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩) লঙ্ঘনের জন্য সাংবাদিকদের যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে। কোনো সাংবাদিক তাঁর মোবাইল ফোনে অপ্রকাশিত কোনো সরকারি নথির ছবি তুললে অপরাধী বলে গণ্য হবেন, অথচ এটি আজকাল খুবই সাধারণ একটি চর্চা।
বিশদ ব্যাখ্যা
সম্পাদক পরিষদ মনে করে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থী, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধাত্মক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারাকে আমরা সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করছি, নিচে তা হুবহু তুলে ধরলাম। একই সঙ্গে সেসব নিয়ে আমাদের অবস্থানের বিশদ বিশ্লেষণ তুলে ধরলাম।
ধারা ৮
৮। কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার ক্ষমতা।-
(১) মহাপরিচালকের নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোনো বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করিলে তিনি উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমত, ব্লক করিবার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে, অতঃপর বিটিআরসি বলিয়া উল্লিখিত, অনুরোধ করিতে পারিবেন।
(২) যদি আইনকৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনকৃঙ্খলা ক্ষুন্ন করে, বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহা হইলে আইনকৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে, বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবেন।
(৩) উপ-ধারা (১) ও (২) এর অধীন কোনো অনুরোধ প্রাপ্ত হইলে বিটিআরসি, উক্ত বিষয়াদি সরকারকে অবহিতক্রমে, তাৎক্ষণিকভাবে উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমতো, ব্লক করিবে।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
এখানে দুটি উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। একটি মহাপরিচালকের (ডিজি) ক্ষমতা, অন্যটি আইনকৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতা। প্রকাশের বিষয়বস্তু ব্লক করার ক্ষমতা মুদ্রিত বা অনলাইন যেকোনো প্রকাশনার অন্তরাত্মাকে আঘাত করবে। কোনো সংবাদমাধ্যমের যেকোনো প্রতিবেদন ব্লক করা যাবে, যেকোনো আলোকচিত্র জব্দ করা যাবে- এভাবে সংবাদমাধ্যমটির স্বাভাবিক কাজ বিঘ্নিত হবে।
প্রকাশিত বিষয়বস্তু অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যুক্তি আইনটিতে এত অস্পষ্ট যে, তা নানা ব্যক্তি নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এতে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোনো প্রকল্পে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার ফলে যদি সেটার অর্থায়নকারী বা কোনো বিনিয়োগকারী অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, তাহলে এ আইনের অধীনে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ‘অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করা’র দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন এবং তা ওই খবর ব্লক বা অপসারণ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
ধারা ২১
২১। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণার দন্ড।-
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা ও সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণের প্রতি পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং অতীতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা উপলব্ধি করি যে, এ বিষয়ে কিছু করা প্রয়োজন। তবে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ খুবই অস্পষ্ট একটি শব্দবন্ধ। কী কী করলে তা এই ধারার অধীনে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হবে, তা সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট না করায় এবং ‘অপরাধগুলো’কে আরও সংজ্ঞায়িত না করায় এই আইনের গুরুতর অপব্যবহার ও সাংবাদিকদের হয়রানির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এর শাস্তি হিসেবে রাখা হয়েছে যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড এবং/অথবা ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধান।
আমরা আবারও বলতে চাই, আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান উত্তরাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংক্ষরণ করতে চাই। তবে আইন প্রণয়নের সময় আমাদের তা খুব স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখন যে অবস্থায় আছে, তা শুধু সাংবাদিকদের জন্যই ভোগান্তিমূলক হবে না, ইতিহাসবিদ, গবেষক, এমনকি কথাসাহিত্যিকদের মতো সৃজনশীল লেখকদেরও দুর্ভোগের কারণ হতে পারে। এমনকি ভুল ব্যাখ্যা এবং সম্ভাব্য শাস্তির ভয়ে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বেশি লেখালেখিও করতে চাইবেন না।
ধারা ২৫
২৫। আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি। (১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে-
(ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্তে¡ও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিযোগে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা
(খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্তে¡ও, কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন,
তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য্য হইবে একটি অপরাধ।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
এই ধারা সংবাদমাধ্যমে সব ধরনের অনুসন্ধানী রিপোর্টিংকে সরাসরি বিরূপভাবে প্রভাবিত করবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মসংক্রান্ত ঘটনা নিয়েই এ ধরনের প্রতিবেদন করা হয়ে থাকে। দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা সাংবাদিক ও সংবাদপ্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখাতে এই আইন ব্যবহার করতে পারেন। তাঁরা এই অজুহাত দেখিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন যে, ওই প্রতিবেদনে তাঁদের আক্রমণ করা বা হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের সব প্রতিবেদনই উল্লিখিত এক বা একাধিক বিধানের আওতায় পড়ে বলে মন্তব্য করা হতে পারে এবং সংবাদমাধ্যমকে হয়রানির কাজে ব্যবহার করা হতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচন করে, এমন যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বিরক্তিকর’, ‘বিব্রতকর’ বা ‘অপমানজনক’ হতে পারে। এই বিধান কোনো দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ অসম্ভব করে তুলবে।
এটি সংবাদপত্রকে জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করবে। এমনকি সাংবাদিকতার সাধারণ অনুসন্ধানও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয় ধারায় ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো’র কথা বলা হয়েছে। ‘বিভ্রান্তি ছড়ানো’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা সুনির্দিষ্ট করা না হলে এই ধারা সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের হয়রানি করার হাতিয়ারে পরিণত হবে। একজনের কাছে যা বিভ্রান্তিমূলক, আরেকজনের কাছে তা না-ও হতে পারে। সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানোর জন্য এটি নিশ্চিতভাবেই নতুন একটি পথ তৈরি করবে।
রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি ও সুনাম’ ক্ষুন্ন করা বলতে কী বোঝায়? সম্প্রতি আমরা ব্যাংক খাতে বিভিন্ন বিবেকহীন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দুর্নীতির খবর পরিবেশন করেছি। সেসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জনগণকে জানিয়েছি যে, ব্যাংক খাত গুরুতর সঙ্কটে পড়েছে। এতে কি ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন হয়েছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দুর্নীতি নিয়ে আমরা সংবাদ পরিবেশন করেছি। আমরা ‘হেফাজতে মৃত্যু’, ‘গুম’ ও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছি। কেউ যদি ব্যাখ্যা করেন যে, এসব প্রতিবেদন রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুন্ন করেছে, তাহলে এই আইন এ ধরনের সংবাদ পরিবেশন করায় সাংবাদিক ও সংবাদপত্রগুলোকে শাস্তি দেওয়ার বৈধতা দেয়। কারণ, প্রায় সব সংবাদপত্রেরই নিজস্ব ওয়েবসাইট ও অনলাইন পোর্টাল রয়েছে।
ধারা ২৮
২৮। ওয়েবসাইট বা কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ একটি অস্পষ্ট পরিভাষা। একজন সাংবাদিক কীভাবে জানবেন কখন ও কীভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ আহত হয়েছে? এই পরিভাষা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং কোনো সাংবাদিকই এ ধরনের বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে স্বস্তিবোধ করবেন না। এটি সমাজের বড় একটি অংশে সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিরীক্ষণ বাধাগ্রস্থ করবে। বহির্বিশ্বে ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হতো না, যদি ওই সব দেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে ‘আঘাত’ করে, এমন সংবাদ প্রকাশ রুখতে আইন থাকত। বেআইনি ফতোয়া ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করাও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি ‘আঘাত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে। এই ধারা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের হয়রানি করতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ধারা ২৯
২৯। মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে Penal Code (Act XLV of 1860)-এর section ৪৯৯-এ বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ (তিন) বৎসর কারাদন্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
মানহানির অভিযোগ বিচার করার জন্য ইতিমধ্যেই একটি আইন থাকায় ডিজিটাল মাধ্যমে মানহানি নিয়ে আলাদা কোনো আইন নিষ্প্রয়োজন। উপরন্তু একই অপরাধে পত্রিকার চেয়ে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমে অতিরিক্ত শাস্তির যুক্তি থাকতে পারে না।
ধারা ৩১
৩১। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ইত্যাদির অপরাধ ও দন্ড।-
(১) যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যাহা সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
দলিত বা নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো শোষণ সম্পর্কে পরিবেশিত একটি সংবাদপ্রতিবেদনের এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হতে পারে যে, সেটি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের দুঃখকষ্ট তুলে ধরে লেখা প্রতিবেদন এভাবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে যে, তাতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। একইভাবে সম্ভাব্য শ্রমিক অসন্তোষ, আসন্ন হরতাল বা বিক্ষোভ সমাবেশ নিয়ে পরিবেশিত সংবাদ ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকারী’ প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য হতে পারে এবং এই আইনের আওতায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এমন খবর পরিবেশিত হতে পারে যে, কোনো বিক্ষোভের সময় এক ব্যক্তি মারা গেছেন, পরে জানা যেতে পারে যে, খবরটি সত্য নয়। তাহলে কি সংবাদমাধ্যম ‘গুজব ছড়ানো’র অপরাধ করবে? সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এ রকম ভুল হয়, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ভুলের সংশোধনীও প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এমনকি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যায় হেরফের হয়। সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে সব সময়ই বেসরকারিভাবে সংগৃহীত তথ্যের অমিল থাকে। এ ধরনের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। কখনো কখনো আমরা কিছু পূর্বাভাসমূলক খবরও পরিবেশন করতে পারি, যা পরে ঠিক সেভাবেই নাও ঘটতে পারে। এ ধরনের প্রতিবেদনও ‘গুজব ছড়ানো’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এভাবে দেখতে পাচ্ছি, এই ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি করবে।
ধারা ৩২
৩২। সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধ ও দন্ড।
(১) যদি কোনো ব্যক্তি Official Secrets Act, 1923 (Act No. XIX of 1923)-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ (চৌদ্দ) বৎসর কারাদন্ড, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
(২) যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা (১) এ উল্লেখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অনধিক ১ (এক) কোটি টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্তডি হইবেন।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ঔপনিবেশিক আমলের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণমূলক আইন, যা ব্রিটিশ প্রশাসনকে সব ধরনের জবাবদিহি থেকে রক্ষা করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছিল। আমরা মর্মাহত হয়ে সেটিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে টেনে আনতে দেখলাম। সরকার যা প্রকাশ করে না, তা-ই ‘সরকারি গোপন তথ্য’ বলে বিবেচিত হতে পারে। একটি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমরা ব্যাংক খাতের অনিয়ম সম্পর্কে কয়েক ডজন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। বলা হতে পারে, এ ধরনের সব প্রতিবেদনই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লঙ্ঘন করেছে। প্রকাশ করা হয়নি, এমন সব সরকারি প্রতিবেদনই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতায় পড়ে, এমনকি পরিবেশদূষণ বা শিশুপুষ্টি নিয়ে সরকারি প্রতিবেদন ইত্যাদিও। এ ধরনের কোনো তথ্য ছাড়া কি অর্থপূর্ণ সাংবাদিকতা সম্ভব? আর যেখানে তথ্য অধিকার আইনের বলে জনগণের ‘জানার অধিকার’ রয়েছে- বিশেষত যখন এ ধরনের সব প্রতিবেদন তৈরি করা হয় জনগণের অর্থ ব্যয় করে- সেখানে এসব প্রতিবেদন সাংবাদিকতার কাজে ব্যবহার করা কেন ‘অপরাধ’ বলে গণ্য হবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকারি দপ্তরের অপ্রকাশিত প্রতিবেদন ছাড়া ফারমার্স বা বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋত বা ব্যাপক অনিয়ম নিয়ে কি আমরা কোনো প্রতিবেদন তৈরি করতে পারতাম? আমাদের প্রতিবেদকের হরহামেশাই মোবাইল ফোনে এ ধরনের দলিলের ছবি তুলতে হয়। কাজেই তাদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া যেতে পারে, তাই তো?
এ আইনের প্রবক্তাদের কাছে আমাদের উদাহরণগুলো ‘হাস্যকর’ ঠেকতে পারে। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগের বাস্তব নজির সাংবাদিকদের কোনো স্বস্তির কারণ জোগায়নি।
ধারা ৪৩
৪৩। পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লশি, জব্দ ও গ্রেফতার।
(১) যদি কোনো পুলিশ অফিসারের এইরূপ বিশ্বাস করিবার কারণ থাকে যে, কোনো স্থানে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সঙ্ঘটিত হইয়াছে বা হইতেছে বা হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে বা সাক্ষ্য প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছিয়া ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হইবার বা করিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে, তাহা হইলে তিনি অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া মহাপরিচালকের অনুমোদনক্রমে নিম্নবর্ণিত কার্য সম্পাদন করিতে পারিবেন,
(ক) উক্ত স্থানে প্রবেশ করিয়া তল্লাশি এবং প্রবেশ বাধাপ্রাপ্ত হইলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
(খ) উক্ত স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সঙ্ঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ;
(গ) উক্ত স্থানে উপস্থাপিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি;
(ঘ) উক্ত স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করিয়াছেন বা করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার।
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিধান এটি।
এতে পুলিশকে যেকোনো জায়গায় প্রবেশ, যেকোনো কম্পিউটার ব্যবস্থায় তল্লাশি চালানো, যেকোনো কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও সার্ভার জব্দ করা, যেকোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি এবং শুধু সন্দেহবশত যে কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারের হুমকি স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালনে বাধার সৃষ্টি করবে। পুলিশ যখন শ্রেফ সন্দেহবশত ও পরোয়ানা ছাড়াই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা পাবে, তখন এই আইনের ছায়াতলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কবর রচিত হবে। আইনটির ২০টি শাস্তির বিধানের মধ্যে যখন ১৪টিই জামিন-অযোগ্য, তখন গ্রেফতারের ঝুঁকি প্রত্যেক সাংবাদিকের মাথার ওপর ডেমোক্লেসের খড়গের মতো সব সময় ঝুলতে থাকবে, মানসিক চাপ সৃষ্টি করে রাখবে। এতে প্রকৃত সাংবাদিকতার সব পন্থা বাধাগ্রস্থ হবে। আমাদের সংবাদমাধ্যম নিছকই জনসংযোগ কর্মকান্ড ও প্রচারণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
এমনকি সাংবাদিকদের ওপর এ আইনের প্রয়োগ না হলেও (আইন থাকলে প্রয়োগ হবেই না বা কেন?) ভীতির পরিবেশে তাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা অনুভব করবেন। গ্রেফতার আতঙ্ক তাঁদের ‘মানসিক পরিবেশের’ এক প্রাত্যহিক অংশ হয়ে উঠবে। প্রতিবেদন তৈরির কাজে তাঁরা নিয়মিত যেসব সংগত ঝুঁকি নিয়ে থাকেন, এই ভীতির কারণে সেসব ঝুঁকি নিতে তাঁরা আর সাহস পাবেন না। এই বিধানের ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হবে, তা খাটো করে দেখা ঠিক নয়। খুব সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে, ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এ আইনের অপব্যবহার করবেন। ধনী ও ক্ষমতাসীনেরা গোপন রাখতে চান, এমন বিষয়ে যেকোনো সংবাদ প্রতিবেদনের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে হুমকি দিতে, এমনকি গ্রেফতার করতে তাঁরা আইন প্রয়োগকারীদের প্ররোচিত বা ‘হাত করতে’ পারেন।
এ আইনের আরও বিপজ্জনক দিক হলো, সব সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশনই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থায় কাজ করে বলে কম্পিউটার ও সার্ভারসহ কম্পিউটার নেটওয়ার্ক জব্দ করার ক্ষমতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে দেওয়ার মাধ্যমে কার্যত তাদের যেকোনো সংবাদপত্র, টিভি স্টেশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাজ বন্ধ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি জব্দ করলে তার কার্যক্রম থেমে যেতে পারে। এভাবে কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না করেই আইনের এই ধারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হাতে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বা কোনো টিভি স্টেশনের কার্যক্রম রুদ্ধ করে দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
ধারা ৫৩
৫৩। অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা। এই আইনের
(ক) ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪-এ উল্লেখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হইবে; এবং (খ) ধারা-১৮-এর উপধারা (১) এর দফা (খ) ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৮-এর উপধারা (৩) এ উল্লিখিত অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হইবে;
সম্পাদক পরিষদের মন্তব্য
এই আইনের প্রায় ১৯টি ধারার ১৪টির ক্ষেত্রেই অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিনঅযোগ্য। পুলিশকে নিছক সন্দেহের কারণে এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়ায় এবং এতগুলো অপরাধের অভিযোগকে আমলযোগ্য ও জামিনঅযোগ্য করায় আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি এক বাস্তব হুমকি।
উপসংহার
১. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নাগরিকদের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যা যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করে;
২. এ আইন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং যেসব মহান আদর্শ ও মুক্তির জন্য আমাদের শহীদেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, সেসব লঙ্ঘন করে;
৩. গণতন্ত্রের মূলনীতি, গণতান্ত্রিক শাসন এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও ১৯৭১ সালের পরবর্তী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আমাদের জনগণ বারবার লড়াই করেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেসবের পরিপন্থী;
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নৈতিক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সব মূল্যবোধের পরিপন্থী।
৫. এ আইন তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কেন আমাদের সংবিধান, মৌলিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী, তা আমরা ওপরে বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছি।
এসব কারণে সম্পাদক পরিষদ এই আইন প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছে।
এই আইন আমাদের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধসাপেক্ষে’ (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা খর্ব করে।
পরিশেষে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু কথা উদ্ধৃত করতে চাই। ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নসম্পর্কিত এক বিতর্কে তিনি স্পিকারের উদ্দেশে বলেছিলেন:
‘আপনারা বলে থাকেন যে, বাকস্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
‘আপনি কি জানেন যে, পূর্ববঙ্গে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না, আপনারা ওটা ছাপাতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখে ছাপাতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি।...নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে...। সরকারের তরফ থেকে একজন ইন্সপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে, আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।...
‘এটা পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকবে, তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে পারবেন এবং জনমত গড়ে তুলতে পারবেন।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।