Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানাহার ও জীবন যাপনে শৃঙ্খলা

উবায়দুর রহমান খান নদভী | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

পানাহারের পরিমিতিবোধ ও অল্পে তুষ্টি সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পিত, প্রয়োজন পরিমাণ জীবনোপকরণ তাকে দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছে এর ওপরই তাকে তৃপ্ত করে দিয়েছেন, সে ব্যক্তি বাস্তবিকই সফলকাম।’ (সহীহ মুসলিম : ১/৩৩৭)
একদিন হজরত আবু হুরায়রা রা:কে খাওয়ায় অংশ নেয়ার জন্য ডাকলে তিনি খেতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, ‘ হজরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমতাবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন যে, কোনো দিন তিনি পেটপুরে যবের রুটিও আহার করেননি।’ (সহীহ বুখারী : ২/৫২০)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত, হজরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কাফের সাতপেট খায় আর মুমিন একপেট খায়।’ (সুনানে তিরমিযী : ২/৪)
এ হাদিসটিতে আল্লাহ ও আখেরাতের বিশ্বাসী ব্যক্তির খাদ্য-সংযম সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রতিটি সুশিক্ষিত, স্বাস্থ্যসচেতন, মেধাবী ও স্মার্ট ব্যক্তির পানাহার যেমন শৃঙ্খল এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে, তেমনি ঈমানদার, পরহেজগার মানুষের খাদ্যাভ্যাসও হয় একপেট। অপরদিকে বিলাসী, গোঁয়ার, অপরিণামদর্শী, ভোজনরসিক ও পেটপূজারি ব্যক্তির খাদ্যগ্রহণে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তারা চোখে যা দেখে, যা কিনতে পারে, যা কাছে পায় যতক্ষণ পারে তা গলাধঃকরণ করতেই থাকে। পেট ফুলে গিয়ে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে না আসা পর্যন্ত তারা খেতেই থাকে। আরো বেশি কেন গিলতে পারল না সে জন্য আফসোস করে এবং ক্ষুধা অনুভ‚ত হলেই আবার খেতে শুরু করে। এ কথাটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কাফেররা সাতপেট খায়। মনে করে এই দুনিয়াতে যত খাওয়া যাবে ততই লাভ। ওদের সামনে পরকালের কোনো ধারণা বা বিশ্বাস নেই। ওরাই বলে, জীবন তো একটাই, যত পার খেয়ে নাও। ভোগ করে নাও। পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ পাক বলেছেন, যারা কাফের তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুষ্পদ জন্তুর মতো যত পারে আহার করে। দোজখের আগুনই তাদের আবাসস্থল।’ (সূরা মুহাম্মাদ (৪৭) : ১২)
অপরদিকে মহান আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন সে তো ক্রীড়া-কৌতুক আর মিছে অহমিকা বৈ কিছু নয়। আর পরকালীন জীবনই হচ্ছে প্রকৃত জীবন।’ (সূরা আনকাবুত (৮৫) : ৬৪)
হজরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে মদিনার সীমান্তে পরিখা খননের সময় ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিজ সাহাবিদের উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন আর কবিতার ছন্দ বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, পরলোকের জীবন ছাড়া আর জীবন কিসের? তুমি মদিনাবাসী আনসার ও মক্কা ছেড়ে আসা মুহাজিরদের ওপর রহম করো।’
এ আনন্দময় বাণী ছন্দে শুনে নবীপ্রেমিক সাহাবিরা তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা ভুলে গিয়ে জবাবী ছন্দে গলা মিলাচ্ছিলেন, ‘আমরা হলাম সেই আত্মোসর্গকারী দল যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে তনু-মন-প্রাণ সব সঁপে দিয়েছে। শপথ নিয়েছি যত দিন বেঁচে থাকি তার সঙ্গীরূপে সর্বাত্মক জিহাদ তথা সাধনা ও সংগ্রাম চালিয়েই যাব।’ (সহীহ বুখারী : ৪০৯৯)
উন্নত ও আদর্শ জীবনবোধের ফলে মুমিনদের পানাহার তাদের পরকালীন বিশ্বাসের আলোকেই সংযত, নিয়ন্ত্রিত ও সুপরিমিত হওয়া স্বাভাবিক। যা কাফেরদের মাঝে পাওয়া খুবই দুষ্কর।
ঈমানদার নেক লোকেরা হালাল ও পবিত্র খাবার অল্প পরিমাণে গ্রহণ করে থাকেন। অপচয় বা অতিভোজন করেন না। ক্ষুধা না থাকলে অভ্যাসবশত বা লৌকিকতার কারণে খাবার খান না। কেবল মুখের রুচি বা চোখের ক্ষুধায় তারা লোভাতুর হয়ে কিছু খেতে থাকেন না। যা আল্লাহ দান করেন তাতেই তারা তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট থাকেন। খাদ্যের ব্যাপারে তাদের মনে অতৃপ্তি, লোভ, অপূর্ণ বাসনা লালন করেন না। এতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন। সাধারণত অতিভোজনে তাদের কোনো রোগ হয় না।
ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে মহান পন্ডিত ইমাম গাযালী রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ এহইয়াউ উলুমিদ্দীনে পরিমাণমতো খাওয়া, অল্পে তুষ্ট থাকা ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার শেষ করার দশটি উপকারের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : এতে আত্মার স্বচ্ছতা, স্বভাবের পরিচ্ছন্নতা ও মেধা-মননের কার্যকারিতা অর্জিত হয়। অন্তরে নম্রতা, বিনয় ও সংযমের ভাব সৃষ্টি হয়, যা প্রভুর ইবাদত ও মানবতার সেবায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। দম্ভ, অহঙ্কার ও পাপের স্পৃহা বিনষ্ট হয়। ইবাদত ও কাজকর্মের সময় এবং শক্তি পাওয়া যায়। সুস্থ থাকায় চিকিৎসা-ব্যয়ও কম হয়। সুতরাং সন্তান ও পরিজনদের পেছনে ব্যয় কম করতে হয়। অর্থসম্পদ দরিদ্র, অসহায়, নিরন্ন মানুষ ও আর্তমানবতার সেবায় ব্যয় করার মাধ্যমে পরকালের জন্য সঞ্চয় করা সহজ হয়। দেহ-মন সতেজ ও সুস্থ থাকায় অল্প নিদ্রায় তৃপ্তি আসে এবং অধিক ইবাদত, সৎকর্ম, তেলাওয়াত ও নফল নামাজ পড়া যায়।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষ যদি ইসলাম-নির্দেশিত খাদ্যরীতি গ্রহণ করে অল্পে তুষ্ট থাকে এবং জীবন চলার পরিমাণ রিজিকে সন্তুষ্ট হয়ে যায় তাহলে সীমিত সঞ্চয়েই বরকত হবে এবং সীমিত উৎপাদন সেই বিশ্ববাসীর ক্ষুধা নিবৃত্তি সম্ভব হবে। মুসলিমরা যদি পরকালে পাওয়ার আশায় নিজের অংশ থেকে অপর ভাইকে খাবার দেন তাহলে সমাজে অভাবের তাড়নায় কৃত অন্যায়-অপকর্মও কমে আসবে। ধর্মীয় অনুশাসন যথার্থভাবে মানলে ঘাতকব্যাধি এইডস থেকেও আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা ধরনের বড় রোগ থেকে বাঁচার উপায় পানাহার ও জীবনযাপনে শৃঙ্খলা আনা একান্ত জরুরি।
আসুন! কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা রোগ প্রতিরোধ করি। পানাহার-সংক্রান্ত কোরআন ও হাদিসের এসব নির্দেশনা অপর ভাইয়ের কছে পৌঁছে দেই। নিজে বাঁচি মানবতাকে বাঁচাই। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমিন!



 

Show all comments
  • মারুফ ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:২১ এএম says : 0
    দৈনন্দিন জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরায় হুজুরকে ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • সুলতান ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:২২ এএম says : 0
    আসুন! কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা রোগ প্রতিরোধ করি।
    Total Reply(0) Reply
  • খাইরুল ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৩:২৩ এএম says : 0
    এই ধরনের লেখাগুলো আমাদের জীবন পরিচালনায় সহযোগিতা করে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন