Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অসহায় মানুষ নদীর দিকে তাকিয়ে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদী ভাঙন। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর পাবনায়, নাটোর, কুড়িগ্রাম, ও রাজবাড়ী জেলায় যমুনা ও পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি, বাজার ও সরকারি ভবনসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলীন হচ্ছে। শত শত পরিবার ঘরবাড়ী ও সহায়-সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির চলে গেছে পদ্মার গর্ভে। যমুনার সর্বগ্রাসী থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলা। ভাঙন এতই ভয়াবহ আকার ধারন করছে যে, অনেকেই গবাদি পশু সরিয়ে নেওয়ার সময় পান নি। চোখের পানি মিশিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কোন উপায় থাকে না। যেটুকু টিকে থাকে সরে গিয়ে সেখানে বসতি গড়েন। অনেকে সব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে বসবাস করছেন খোলা আকাশের নিচে, আবার কেউ রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে খুপরি ঘর তোলে কোনো মতে মাথা গুঁজে আছেন। রাক্ষসী পদ্মার ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে তাদের দিন কাটছে আজ সীমাহীন কষ্টে আর চোখের পানিতে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য নিয়ে ডেস্ক রিপোর্ট :
শরীয়তপুর : পদ্মার অব্যাহত ভাঙনে গত সোমবার রাতে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনটির বেশির ভাগ নদীতে চলে গেছে। হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ ও বহিঃবিভাগ চালু রাখা হলেও হাসপাতালে প্রবেশের সড়কটি বিলীন হয়ে যাওয়ায় ভয়ে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন না। ফলে এ উপজেলার তিন লক্ষাধিক লোকের স্বাস্থ্যসেবা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরো ১১টি ভবন। এছাড়া গত তিন দিনে মূলফৎগঞ্জ বাজার ও আশপাশের এলাকার অর্ধশতাধিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও অন্তত ৪০টি বাড়ি ঘর পদ্মায় চলে গেছে। উপজেলার অন্তত সাড়ে চার হাজারের বেশি মানুষের ফসলি জমি, বাপ-দাদার কবর, বাড়িঘর ও বহুতল ভবনসহ অনেক স্থাপনা পদ্মায় বিলীন হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : যমুনার সর্বগ্রাসী থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে কাজিপুর সদর, মাইজবাড়ী, গান্ধাইল ও শুভগাছা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। এছাড়া খাসরাজবাড়ী, নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ ও মনসুর নগর ইউনিয়নের অনেক গ্রাম তীব্র ভাঙনের শিকার। বর্তমানে ছয়টি স্পটে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। যমুনার এমন তান্ডবে নদীশিকস্তি মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাপ-দাদার বসতভিটা আর সহায়সম্পদ হারিয়ে তারা এখন অসহায়। নদীর পূর্ব পাড়ে ভাঙন ক্রমেই ধেয়ে আসায় আশপাশের লোকালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েক দিনে পাটাগ্রাম, বাঐখোলা, ফুলজোড়, শুভগাছা, মাজনাবাড়ী, খাসরাজবাড়ী, চরগিরিশ এলাকার আশপাশের বিস্তীর্ণ জনপদ যমুনা গ্রাস করেছে। একটি মসজিদ, কয়েক শ’ বসতঘর, ফসলি জমি, গাছগাছালির বাগান বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাটা গ্রাম সডিল স্পার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ও গুচ্ছগ্রাম। জানা গেছে, ইতোমধ্যে ৩৬৮ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটারের জনপদ কাজিপুরের তিনভাগই যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র তিনটি। আবার যমুনার পূর্ব পাড়ে বেশ কয়েকটি চর জেগে উঠলেও চরের মালিকানা নিয়ে ভূমিহীন-জোতদারের মধ্যে চলছে বিরোধ। নদীশিকস্তি পরিবারগুলো সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়ছে।
এদিকে শুভগাছা, গান্ধাইল ও কাজিপুর সদর ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত দুই তিন মাসে ভাঙনে এসব এলাকার প্রায় ৩০০ বসতঘর, বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, একটি মসজিদ নদীতে বিলীন হয়েছে।
রাজবাড়ী : রাজবাড়ীতে দ্রুত নদী শাসন না করলে জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে অনেক গ্রাম ও ইউনিয়ন। ভাঙন ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ব্যাগে নিয়মানুযায়ী মোটা দানার বালু ভরা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
নদীপাড়ের লোকজন জানান, জেলা সদরের গোদারবাজার ঘাট, অন্তরমোড়, উড়াকান্দা, মহাদেবপুর, কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়ন, গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়ন এলাকায় চলছে নদীভাঙন। হুমকিতে রয়েছে নদীপাড়ে অবস্থিত সরকারি বিদ্যালয়, মসজিদসহ নানা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, এমনকি শহররক্ষা বাঁধও রয়েছে হুমকিতে।
মাদারীপুর : গত ২-৩ দিন ধরে পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিবচরের পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে তিনটি ইউনিয়নে ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি। অনেকের বাড়িঘর নদীতে চলে গেছে। মালামাল নিয়ে তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ৩-৪ সপ্তাহের ব্যবধানে এ তিন ইউনিয়নে চারটি স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙনের মুখে রয়েছে গ্রামীণফোনের টাওয়ারসহ শত শত ঘরবাড়ি, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
পাবনা : পাবনার সুজানগর উপজেলায় যমুনা ও পদ্মা নদীর প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। অপর দিকে, বেড়া উপজেলার নাকালিয়া - হাটুরিয়া এলাকায় ভাঙন অব্যাহত আছে। ভাঙনে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়ীয়া, মানিকহাট ও নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের শত শত বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমি। ভাঙন কবলিত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা জানান, পদ্মার ভাঙনে সাতবাড়ীয়া, মানিকহাট ও নাজিরগঞ্জসহ ৫টি ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, রাইপুর বাজার ও রাইপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ইতোমধ্যেই নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
লালপুর (নাটোর) : নাটোরের লালপুর উপজেলায় পদ্মা নদীতে তীব্র ভাঙন না থাকলেও গত কয়েক দিনে পদ্মার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীর রক্ষায় নির্মিত সিসি ব্লক ধসে পড়েছে। ইতোমধ্যেই প্রায় ৩০০ মিটার এলাকার সিসি ব্লক পদ্মা নদীতে ধসে পড়েছে। সিসি ব্লক ধসে পড়ার পরে নদীর পাড়েও ধস শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে নুরুল্লাপুর পয়েন্টে ব্লক ধস লক্ষ্য করা গেছে। ভাঙন রোধে স্থানীয়রা প্রাথমিক ভাবে বাঁশের বেড়া দিয়ে তার মধ্যে কাশফুর ও কচুরিপানা দিয়ে ভর্তিকরে দিচ্ছেন। তবে এতে ভাঙন রোধে কতটুকু কার্যকর হবে তা বলা যাচ্ছে না। এদিকে পদ্মায় দ্রুত পানি বাড়ার ফলে আতঙ্কে রয়েছে পদ্মার তীরবর্তী গ্রামের মানুষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভাঙন রোধে উপজেলার তিলকপুর থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত ২২৬ দশমিক ০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সি.সি. ব্লক দিয়ে ৮ দশমিক ৫৮৫ কি: মি: দৈর্ঘ্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। নুরুল্লাপুর গ্রাম এলাকায় নির্মিত সিসি ব্লকে গত বর্ষা মৌসুমে ফাটলের সৃষ্টি হয়। এ সময় ভাঙন এলাকায় বালির বস্তা ফেলে ঝুঁকিমুক্ত করা হলেও চলতি বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে বালির বস্তা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে সি.সি. ব্লক ধসে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ সময় নদীর তীর রক্ষা বাঁধের কয়েকশ গজ এলাকা ধসে পড়ে ভাঙন দেখা দেয়।
সিসি ব্লকের ধস শুরু হওয়ায় উপজেলার নদী তীরবর্তী নুরুল্লাপুর, লক্ষীপুর, তিলকপুর ও নবীনগর গ্রাম হুমকির মুখে পড়ছে। আর এজন্য এলাকার লোকজন নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনকে দায়ি করছেন। তারা বলছেন, নদীর তলদেশ থেকে বালি উত্তোলনের ফলেই সিসি ব্লকের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে সিসি ব্লক নদীতে ধসে পড়ছে।
ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ধরলা নদীর পানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ভাঙন। ২য় ধরলা সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে নদীর স্রোত সোজাসুজি উপজেলার ভুখন্ডে আঘাত করার কারনে গত ২দিনের ভাঙনে নদী নিকটবর্তী সোনাইকাজী গ্রামের বেড়ীবাঁধ,মসজিদ, আবাদি জমি, সুপারী বাগান, বাঁশঝাড় সহ প্রায় ১৫/২০টি বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, ২য় ধরলা সেতুর এক কিলোমিটার দক্ষিণে সোনাইকাজী এলাকায় ধরলা নদীর ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে সেতুর এ্যাপ্রোচ সড়কে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদীর তীব্র স্রোত সোজাসুজি এই এলাকায় আছড়ে পড়ছে। ফলে অব্যাহত ভাঙনের ফলে সোনাইকাজী গ্রামের ১৫/২০ টি পরিবারের বসতভিটা ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর নদী থেকে সামান্য দুরত্বে মারাত্বক ভাঙন হুমকির মুখে রয়েছে বেশকিছু গুরত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ