বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে লেনদেন, বেচা-কেনা এবং কায়-কারবারে বস্তুর ওজন ও মাপ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দাঁড়িপাল্লা ও অন্যান্য পন্থায় দু’টি কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং মানব জীবনের শুরু থেকে দাঁড়িপাল্লার মাধ্যমে জিনিসপত্র ওজন ও পরিমাপ করে দেয়ার চিরাচরিত প্রথা প্রচলিত। এই লেন-দেন, বেচা-কেনা, ও আদান-প্রদানে যে সমতা ও ইনসাফ অনুসরণ করার বিধান রয়েছে, পবিত্র কোরআনে তা স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। ওজন ও মাপের কোরআনী বিধান অনুসরণের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত কল্যাণ ও সামাজিক শান্তি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। পবিত্র কোরআনের ওজন পরিমাপ সংক্রান্ত আয়াতসমূহের তাফসির বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে জিনিসপত্র ও দ্রব্য সামগ্রীর বেচা-কেনা এবং লেনদেন সম্পর্কে বহু বিষয়ের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। সেই জাহেলি বা অজ্ঞ, অন্ধকার যুগের আরবের ইতিহাস পাঠ করলেও সেকালের আরবদের অনুসৃত বহু অন্যায় ও ক্ষতিকর প্রথার সাথে পরিচিত হওয়া যায়। বিশেষত জিনিসপত্র ও বস্তু সামগ্রীর ওজন পরিমাপে মানুষের ক্ষতি করার এবং তাদেরকে জিনিস বেচা-কেনায় ঠকানোর যেসব রেওয়াজ ছিল, তাতে কম প্রদান, বেশি গ্রহণ, চুরি, প্রতারণা, ভেজাল কৃত্রিমতা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যায়-অনাচার ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মক্কা হতে হিজরত করে মদিনায় গমন করেন, তখন মদিনাবাসীর সাধারণ কাজ কারবার ‘কায়ল’ তথা মাপের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। তারা এ ব্যাপারে চুরি করা ও কম মাপার খুবই অভ্যস্ত ছিল। সূরা ‘তাত্ফিফ’ অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপটও ছিল তাই এবং মদিনায় অবতীর্ণ এটিই ছিল প্রথম সূরা।
মদিনাবাসীর মধ্যে তখন প্রচলন ছিল যে, তারা নিজেরা কারো কাছ থেকে সওদা নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করত এবং অন্যের কাছে বিক্রি করার সময় মাপে কম দিত। এই সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর তারা এই বদ অভ্যাস থেকে চিরতরে বিরত হয়ে যায়। কিন্তু কম দেয়ার এই বদ অভ্যাস ও ঘৃণিত প্রথা দুনিয়ার সর্বত্র নানাভাবে বিরাজমান এবং মুসলমানদের মধ্যেও এই কুপ্রথার অনুসরণ দুঃখজন হলেও দেখতে পাওয়া যায়, যার ব্যাপক প্রচল এ দেশেও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আমাদের দেশে জায়গা জমির বেচা-কেনা, হস্তান্তর, জরিপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিমাপে কারচুপি দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাপককে কম দেয়ার নানা কলা-কৌশল সর্বজনবিদিত। এই অবৈধ ও অন্যায় আচরণ বন্ধ করতে হলে কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন, প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। আর ইসলামি আইন চালু ও বলবৎ করা হলে এই নৈতিকতা ও সমাজবিরোধী ঘৃণ্য কার্যকলাপ চিরতরে বন্ধ হতে পারে, দেশের প্রচলিত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং জরিপ বিভাগকে সক্রিয় ও দুর্নীতিমুক্ত করা গেলেও সমাজের এই দুষ্টু ক্ষত মুছে ফেলা সম্ভব।
অসাধু ব্যবসায়ীরাসহ যারাই ওজনে মাপে কম দেয়ার অনাচার-পাপাচার করে থাকে তারা সমাজদ্রোহী ও নৈতিকতাবিরোধী। তারা এই ঘৃণ্য কার্যকলাপের মাধ্যমে ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে নিজেরা লাভবান হয় বলে মনে করলেও এতে তাদের অকল্যাণই হয়ে থাকে। দুনিয়াতে আইনের চোখে যেমন এই কার্যকলাপ নিন্দিত ও দন্ডণীয় তেমনি আল্লাহর নিকটও এটি জঘণ্য অপরাধ। ইতিহাস হতে জানা যায় যে, হজরত শোয়েব (আ.)-এর যুগে মাদায়েনবাসীরা এই ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। হজরত শোয়েব (আ.) তার জাতিকে এই অসাধু ব্যবসা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। কিন্তু তারা নবীর এই আহ্বানের প্রতি কর্ণপাত না করে তাদের এই নৈতিকতাবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ফলে তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে এবং এই জাতিকে আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তিদান করত ধ্বংস করেন। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এই শ্রেণীর অনাচারের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা প্রচারিত হয়েছে। এ সম্পর্কে সূরা আনআমের ১৭২ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওজন ও মাপ পূর্ণ কর ন্যায় সহকারে।’ যারা ওজন ও মাপে কম-বেশি করবে তাদের জন্য সূরা ‘তাত্ফিফ’ এ কঠোর শাস্তির বাণী উচ্চারিত হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।