বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বিদেশে একবার এক পরিবারের ভেতরগত মনোমালিন্য মিটাবার বৈঠকে বসেছিলাম। পরিবারটির কিছু অংশ আমেরিকা-প্রবাসী, কেউ কেউ মধ্যপ্রাচ্যে, দুয়েকজন বাংলাদেশেও আছেন। বাহ্যত এই পরিবার ও তার আত্মীয়স্বজন বেশ ধর্মপ্রাণ কিন্তু সমন্বিত দ্বীনি শিক্ষা, আলেম-উলামাদের সান্নিধ্য ও ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধির অভাবে তাদের মধ্যকার অশান্তি চরম আকার ধারণ করে। এ পরিবারের কয়েকজন আমার পরিচিত হওয়ায় তারা দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের এসব সমস্যা আমার সামনে তুলে ধরা ও আমার দেয়া সমাধান সবাই মেনে নেয়ার কথা বলে আসছিলেন। আমি এসব বিষয়ে সবাইকে নিয়ে বসা বা সমাধান দেয়ার লোক নই। তবুও তাদের অনুরোধ-উপরোধ এড়াতে না পেরে বললাম, আপনাদের বিভিন্ন পক্ষের একজন করে প্রতিনিধি আমার সাথে বসবেন। সমস্যাগুলো শুনে আমি ভেবে দেখব কী করা যায়। কথামতো প্রতিনিধিরা আমার সাথে হোটেলে সাক্ষাৎ করলে আমি তাদের যা কিছু বললাম, এতে তারা খুবই আপ্লুত হলেন। পরদিন তাদের দেখাদেখি প্রবাসী আরো তিন-চারটি পরিবার নিজেদের কিছু অশান্তি আমার সামনে পেশ করার ইচ্ছা পোষণ করল। শুনে আমি বললাম, আমি আসলে কোনো পরামর্শদাতা নই। কাউন্সেলিং আমার পেশা নয়। আপনাদের উচিত এসব নিজ নিজ পরিচিত আলেম, ইমাম ও শাইখের নিকট পেশ করে সমাধান চাওয়া। দোষ-ত্রু টি থেকে মুক্ত হওয়া, তওবা করা, আত্মশুদ্ধি অর্জন করা। তারা আবদার করলেন, আমি যেন তাদের সবগুলো পরিবারের ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সমন্বয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে ইসলাহী বয়ান করি। যাতে করে তাদের ভেতরকার সমস্যা ও অশান্তিগুলো আলোচিত হয় আর তারা এর থেকে সংশোধনের খোরাক পেয়ে যান। অনেক ভেবে-চিন্তে আমি রাজি হলাম এবং একদিন সন্ধ্যায় সময়ও বের করলাম। একটি হলরুমে পুরুষরা জমা হলেন। পাশের রেস্টুরেন্ট বুক করে মহিলাদের বসতে দেয়া হলো।
উন্নত দেশের শিক্ষিত পরিবেশে একদল আত্মীয়-স্বজন দুয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন পরিবার ইসলামের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক হুকুম-আহকাম শোনার জন্য এখানে সমবেত। তাদের সাথে অনেক নারী-পুরুষ এমনিতেই আগ্রহ নিয়ে এসে যোগ দিয়েছেন। আচার-আচরণ মানবিকতা ও সৌজন্য বিষয়ক বিধান এবং নির্দেশনা যারা জীবনে খুব কমই শুনেছেন তারা আজ গভীর আগ্রহ নিয়ে সমবেত। স্থানীয় ইমাম সাহেব কোরআন তেলাওয়াত শেষে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি মাসনূন খুতবা পড়ে বয়ান শুরু করলাম।
বললাম, ইসলাম কিছু অনুষ্ঠানের নাম নয়। কিছু পূজাপার্বণ বা রীতি-নীতি পালনের নাম নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এর মূল রূপ হচ্ছে- বিশ্বাস, চেতনা, ভাবনা, কর্ম, মনোভাব ও আচরণের সকল ক্ষেত্রে শরীয়ত মেনে চলা। আল্লাহর সামনে পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ নিজের স্বভাব-প্রকৃতি, রুচি-চাহিদা ইত্যাদি সবকিছু কোরআন-সুন্নাহ অনুসারে রূপান্তরিত করা। যেমন : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে দাখিল হও। কোনোভাবেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । (সূরা বাকারা (২) : ২০৮)
সুতরাং জীবনভর শয়তানের প্ররোচনা থেকে আত্মরক্ষা করে ইসলামের পথে চলা এবং ঈমানের ওপর দৃঢ়পদ থাকাই আমাদের কাজ। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেন, ওহে যারা ঈমান এনেছ, আল্লাহকে ভয় করো ভয় করার মতো আর পরিপূর্ণ মুসলিম বা আত্মসমর্পণকারী না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা আলে ইমরান (০৩) : ১০২)
ইসলাম ও তার আনুসঙ্গিক সকল বিষয় পাঁচটি শিরোনামে এসে যায় : এক. ঈমান আকীদা (বিশ্বাস ও চেতনা) দুই. ইবাদাত (উপাসনা) তিন. মুআমালাত (আর্থিক লেনদেন ও হালাল জীবিকা) চার. মুআশারাত (পারস্পরিক সম্পর্ক ও সামাজিকতা) পাঁচ. আখলাক (মানবিকতা, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধি)
সমবেত মুসলিম ভাই-বোনদের মধ্যে এসব বিষয় কতটুকু কীভাবে আছে তা আমার জানা নেই। তবে আমার দেখা মুসলিম-সমাজে উল্লিখিত বিষয়সমূহের সুষম উপস্থিতি হতাশাজনক। সমন্বয়হীন ইসলামী বিধান মেনেই এবং মৌলিক অনেক দায়িত্ব অপূর্ণ রেখেই নিজ নিজ খেয়াল-খুশিমতো মানুষ ‘দ্বীনদার’ ‘পরহেজগার’ ‘আল্লাহওয়ালা’ সেজে বসে আছে। অথচ প্রকৃত দ্বীনি ইলম আছে এমন মানুষের দৃষ্টিতে এরাই শরীয়ত লঙ্ঘনকারী অপরাধী ব্যক্তি। এ সমস্যা সমাজে যেন দিন দিনই বাড়ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।