Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ওরা এখনো ঘরছাড়া

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে জামিন দেয়া হলেও কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুলিশের গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক ছাত্রছাত্রী গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ কেউ স্বজদের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও তাদের ভেতরে সার্বক্ষণিক গ্রেফতারের আতঙ্ক। এসব আন্দোলনকারীদের কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে আটকের পর অন্য মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠাচ্ছে, রিমান্ডে নিচ্ছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি এমন আচরণে শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এমন গণগ্রেফতারের ভয়ে আন্দোলনকারীরা পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপন করতে পারবেন কিনা সেটিও পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে চরম আতঙ্ক ও উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে স্বজনরা। শিক্ষার্থী ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, নায্য দাবিতে আন্দোলন করেছে; সরকার তাদের বাহবাও দিয়েছে। তারপরও অন্যায়ভাবে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে। এদিকে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনটি ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন। একইভাবে শিক্ষার্থীদের গ্রেফতারে উদ্বেগ জানিয়ে ঈদের আগেই আটক সব শিক্ষার্থীকে মুক্তি দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিক সৈয়দ আবুল মকসুদ। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ১১ জন নোবেল বিজয়ীও শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।
ঢাকার বিভিন্ন থানা ও আদালত সূত্র জানা যায়, আন্দোলনের সময় সংঘাত, ভাঙচুর, উস্কানি ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় ৯৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে গতকাল ঢাকার পৃথক আদালত আটক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪২ জনকে জামিন দেন। এর মধ্যে বাড্ডা ও ভাটারা থানার মামলায় গ্রেফতার ২২ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৬ জনের ও এবং ধানমন্ডির মামলায় ৯ জনের জামিন মঞ্জুর করেনে আদালত। বাড্ডা ও ভাটারার মামলায় এখনো ৬ শিক্ষার্থী কারাগারে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্তত ৪ জন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে দুজনকে আদালত শিশু গণ্য করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া আন্দোলনের ঘটনায় ৫১ মামলায় মোট ৯৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এ ছাড়া মামলার এজাহারে নাম থাকার কারণে ৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ জন শিক্ষার্থী পলাতক রয়েছেন।
গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আটক কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী লুৎফুন্নাহার লুনার মা রাশেদা বেগম ইনকিলাবকে জানান, পাঁচ বছর আগে তার স্বামী মারা গেলে অনেক কষ্টে তিনি তিন মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। আগে বড় মেয়ে কেয়া সরকার টিউশনি করে পরিবারের খরচ যোগাত। পরবর্তীতে লুনা নিজেও টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচের পাশাপাশি পরিবারকে সাহায্য করতো। তিনি অভিযোগে জানান, পুলিশ তার মেয়েকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। যে ভিডিও ক্লিপসের অভিযোগে তার মেয়েকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটি প্রকৃতপক্ষে লুনার ছিল না। পরবর্তীতে লুনাকে অন্য একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয় যা সম্পূর্ণ অমানবিক বলে তিনি অভিযোগ করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আরেক যুগ্ন আহবায়ক ফারুক হোসেনের ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলন যৌক্তিক বলে স্বীকার করার পরেও অন্যায়ভাবে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করেছে। যারা বাইরে আছে তারাও গ্রেফতারের ভয়ে বাড়ি ঘরে যেতে পারছেন না। তিনি তার ভাইসহ আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান এবং নতুন করে আর কাউকে আটক না করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, কোন বাবা-মা বা ভাই বোনের পক্ষে সন্তানকে কারাগারে রেখে ঈদ করা সম্ভব নয়।
রাশেদের মা সালেহা খাতুন ও স্ত্রী সুবর্ণা আলো গতকাল রাশেদকে দেখতে কেরাণীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে যান। তারা দু’জন ইনকিলাবকে বলেন, সরকার অন্যায়ভাবে রাশেদসহ অন্য আন্দোলনকারীদের কারাগারে আটক রেখেছে। তারা বলেন, দেশের শিক্ষক, রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবীসহ অনেকে তাদের সন্তানদের মুক্তির দাবি জানালেও সরকার সে বিষয়ে দৃষ্টি দিচ্ছে না। ঈদের আগেই আটক সবার মুক্তির দাবি জানান তারা।
এদিকে গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়ানো ছাত্র পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক বিন ইয়ামিন বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কোন গুজব প্রচার বা ভাংচুরে না থাকলেও সরকার বিনা অপরাধে অনেককে গ্রেফতার করেছে। এখনো অনেককে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ছবি এডিট করে নানা প্রপাগান্ডা ছড়ানোর কারণে পুলিশকে উৎসাহিত হয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করছে। অনেকক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের মারধর করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করছে। আরেক নেতা বাশার বাবু বলেন, গ্রেফতারের ভয়ে তাদের অনেক বন্ধু শিক্ষার্থীরা বাড়ি ঘর পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
এদিকে উসকানি ও ভাংচুরের অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পরিবার ও স্বজনরা গ্রেফতারকৃতদেরকে দ্রুত মুক্তি দাবি করেছেন। জাকির মোল্লা নামে এক আইনজীবী বলেন, গত ৪ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে হিউম্যান হলার ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে এক কলেজছাত্রসহ চারজনকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন পুরান ঢাকার কে এল জুবিলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিল সে তার মক্কেল। কলেজে টাকা জমা দিয়ে ফেরার সময় ছাত্রলীগ তাঁকে ধরে পুলিশে দেয়।
একইভাবে রমনা থানার একটি মামলায় গ্রেফতার হয়েছে তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার এক ছাত্র। তার আইনজীবী তৌসিফ মাহমুদ বলেন, মামলায় তার বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ বছর। কিন্তু সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৩ বছর ১ মাস। এছাড়া আটক অনেক শিক্ষার্থীরা স্বজন ও আইনজীবীরা বলেন, বেশির ভাগ ছাত্রকেই সুনির্দিষ্ট কোন মামলায় গ্রেফতার না করে সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার করেছে। আদালতকেও তাঁরা সে বিষয়টি বুঝিয়ে তাদের মক্কেলের জামিনের আবেদন করেছেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, এসব ছাত্রদের যদি ঈদের আগে জামিন দেওয়া হয় তবে ভালো। অন্যথায় কারাগারের চার দেয়ালের ভেতরে তাদের এবারের ঈদ কাটবে।
দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রবন্ধে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ ঈদের আগেই কারাগারে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিয়ে মায়ের কোলে ফেরত দিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি ওই প্রবন্ধে সরকার, প্রশাসন ও পুলিশে দায়িত্বরতদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনার সবাই কোন সন্তানের মা-বাবা অথবা কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক। অতএব গ্রাম থেকে উচ্চ শিক্ষা নিতে আসা নিম্মবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সামান্য ভুলভ্রান্তির জন্য তাদের যাত্রাপথে কাটা পুতে দেওয়া ঘোরতর নির্মমতা।’ দেশে খুনের আসামি ও ব্যাংকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে মন্তব্য করে কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের ভুল বা অপরাধ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আবেদন জানান তিনি। তিনি বলেন, সন্তানকে জেলে রেখে কোন মা-বাবা, ভাই-বোন ঈদের আনন্দ করতে পারে না। তাই ঈদের আগেই তাদের মুক্তি দিন।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ইনকিলাবকে বলেন, কাউকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বাইরে গ্রেফতার করা হলে দ্রুততর সময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারো বিরুদ্ধে কোন অন্যায় প্রমাণিত না হলে তাদেরকে ভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখনো আরও অমানবিক। তিনি বলেন, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ আন্দোলনকে সরকার যৌক্তিক দাবি করেছে। তাই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা হলে দ্রুততর সময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। একইভাবে নতুন করে যেন কাউকে গ্রেফতার না করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি তিনি আহবান জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ