Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধ্যবিত্তের হিমশিম

জীবনধারণে খরচ বাড়ছেই নুন আনতে পানতা ফুরায়

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

‘বাসা ভাড়া গত জানুয়ারি মাস থেকে বেড়ে গেছে। বাজারে চাল ডাল তেল মাছ গোশত সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামে আগুন। গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের পর এখন মোবাইল ফোনে কথা বলতেও বিল বাড়ছে। বাস অটোরিকশা ও রিকশা ভাড়া বেড়ে গেছে। ওষুধের দাম বাড়তি। সন্তানদের স্কুলের টিউশন ফি কোচিং ফি বইপত্র কাগজের মূল্যও বেশি আদায় করা হচ্ছে। সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে’। কথাগুলো বলছিলেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের বাসিন্দা একটি বেসরকারি শিপিং এজেন্সীর কর্মকর্তা মোঃ আবদুল বাতেন তরফদার। তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারটির ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়েছেন বলে জানান তিনি।
এহেন দুরবস্থা আবদুল বাতেন তরফদারের শুধু নয়। শহুরে এবং গ্রামের মধ্যবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারের চালচিত্র এবং পরিবারের কর্তাদের নাভিশ্বাস আলাদা করে দেখার উপায় নেই। সীমিত আয়-রোজগারে নুন আনতে পানতা ফুরায় দশা। একদা বলা হতো ‘মধ্যবিত্তের সাধ অনেক সাধ্য সীমিত’। আর এখন সাধ ও সাধ্য উভয়ই সীমিত হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত বিশেষত শহর-নগরে বসবাসরত পরিবারের কর্তাদের আয়-রোজগারের বেশিরভাগই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে খাদ্য দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়, সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালানো এবং গণপরিবহন ভাড়া। তাছাড়া রয়েছে জীবনধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির প্রবণতা। চিকিৎসা ব্যয় বিশেষ করে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট ফি এবং অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের ফি কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেবাখাতে সবধরনের ব্যয় মেটাতে হচ্ছে ক্রমাগত বেশি হারে।
ভোক্তা-ক্রেতা সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ ও প্রতিনিধিত্বকারী জাতীয় স্বেচছাসেবী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) রিপোর্ট অনুসারে, গত ২০১৭ সালে দেশের জনগণের সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এরমধ্যে বাসা ভাড়া বৃদ্ধি পায় ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। এরআগের বছর ২০১৬ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত একবছরে খাদ্যপণ্য বিশেষত চালের মূল্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। সবধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ। এরমধ্যে গরিবের মোটা চালের দাম বেড়েছে বেশী। যা এক ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত। সেবা খাতে দুই বার্নার গ্যাসের চুলার গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। আবাসিক খাতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও বাণ্যিজিক খাতে বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মূল্য প্রতি হাজার লিটারে বেড়েছে ৫ ভাগ।
নিত্য ও ভোগ্য পণ্য, সেবাখাতের ব্যয় অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক কিছুই চলে এখন সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সেই সাথে ভ্যাটসহ বিভিন্ন ধরনের শুল্ক-করের চাপ গিয়ে পড়ছে মধ্যবিত্তের ওপর। এতে করে সাধারণ মধ্যবিত্তরা ত্যক্ত-বিরক্ত। লাগামহীন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে আয়ের সাথে খরচের খাপ খাওয়ানো সম্ভবই হচ্ছে না। পরিবারের কর্তা যাদের হাতের পাঁচ ক্ষুদ্র সঞ্চয় ছিল তাও ভেঙে জীবনধারণে বাধ্য হচ্ছেন। তাছাড়া কর্তারা দায়-দেনাভারে জর্জরিত। এই সুবাদে সুদি মহাজন আর কতিপয় এনজিওর সুদের কারবার রমরমা। মধ্যবিত্তের অভাব-অভিযোগ আর দুঃখ-কষ্টের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা পিতৃপুরুষের সামাজিক অবস্থান (স্ট্যাটাস) ধরে রাখতে গিয়ে ‘নিচে’ও নামতে পারেন না। আবার সেই দুঃসহ জীবনধারণের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেন না।
এদিকে জনগণের অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় করে ১২ থেকে ১৫টি ‘অতি প্রয়োজনীয় পণ্য’ চিহ্নিত করে সেগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করেছে ক্যাব। দ্রব্যমূল্য ও সেবাখাতে ব্যয় সহনীয় সীমায় রাখতে ১০ দফা সুপারিশও করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় এবং মধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হন সে লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এরজন্য নিত্য অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো চিহ্নিত সরবরাহ সন্তোষজনক এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘সরবরাহ ও মূল্য’ নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক বিভাগ অথবা একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা, বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দায়িত্বে একটি পৃথক উইং প্রতিষ্ঠা, ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা, কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ‘কনট্রাক্ট গ্রোয়িং’ পদ্ধতি অনুসরণ, ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ ও শস্যবীমা প্রথা প্রবর্তন।
বাড়ি ভাড়া আইন ১৯৯১ অনতিবিলম্বে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে ভাড়াটেদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া কমিশন গঠন, ডাক্তারদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, শিক্ষাখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূরীকরণ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইন-ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ ইত্যাদি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ, ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিত্যপ্রয়োজনীয়

২০ আগস্ট, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ