বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম হচ্ছে হজ্জ। মুসলমানের ওপর এ হজ্জ জীবনে একবার মাত্র ফরজ। নিকট-দূরের যে কোনো প্রান্ত হতে মুসলমানগণ আল্লাহর ঘর খানা-ই-কাবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে হজ্জ ও উমরাহ পালনের নিয়তে সারা বছর সমবেত হয়ে থাকেন। খানা-ই-কাবার ‘তাওয়াফ’ ও ‘তালবিয়া’ পাঠ (আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলা) হজ্জ ও উমরা পালনে অন্যতম প্রধান কাজ এবং তা কাবা জিয়ারত তথা তাওয়াফকারী প্রত্যেকের এ ‘তালবিয়া’ পাঠ করতে হয় এবং ‘তালবিয়া’ পাঠের ফলে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠে ও হৃদয় বিগলিত হয়ে যায়। কেউ কেউ জ্ঞানহারা হয়ে পড়ে। কিসের জন্য? কোন আকাক্সক্ষায়? এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে হজরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা.) এর তালবিয়া পাঠে।
বর্তমানে অতি স্বল্প সময়ে দূরদূরান্ত থেকে হজ্জে গমন খুবই সহজ হয়ে গেছে। আগেকার যুগে পদব্রজে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সময় লেগে যেত। কারো কারো হজ্জ যাত্রা ছিল এমন যে প্রত্যেক পদক্ষেপেই আল্লাহকে স্মরণ করা হতো, এমনই একজন সাধক সুলতানুল আরেফীন হজরত বাইজিদ বোস্তামী (রহ.) এর হজ্জযাত্রায় খোরাসান হতে তার মক্কায় পৌঁছাতে সময় লেগেছিল বারো বছর। দুটি ঘটনাই আজকের আলোচ্য বিষয়।
বর্ণিত আছে যে, হজরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রা.) যখন হজ্জ করতেন, তখন ‘তালবিয়া’ পাঠের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়তেন, তার আগে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তার চেহারা হলদে হয়ে যেত। অজ্ঞান হওয়ার পর যখন জ্ঞান ফিরে আসত, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হতো : ‘আপনার এ অবস্থা হয় কেন?’ তিনি বলতেন, ‘লাব্বাইক আল্লহুম্মা লাব্বাইক’ বলার সময় আমার ভয় অনুভ‚ত হয়, আমি যদি বলে ফেলি ‘লাব্বাইক লা সাদাইক’ (তুমি হাজির নও)। এ জন্য লোকেরা তাকে উৎসাহিত করত যে, ‘তালবিয়া’ পাঠ করা খুবই জরুরি। এ উপদেশের পরও তিনি ‘তালবিয়া’ পাঠ করে অজ্ঞান হয়ে সোয়ারী হতে পড়ে যেতেন। এটা ছিল তাঁর হজ্জের সময়ের অবস্থা। নফল ইবাদত সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এক হাজার রাকাত নামাজ পড়তেন। হজরত জয়নুল আবেদীন (রা.) বলতেন, ‘আমি দশ জনের অধিক লোককে দেখেছি তারা প্রত্যেক হজ্জের সময় আমার ঘরানাদের পক্ষ থেকে কোরবানি দিত’। ‘তালবিয়া’ পাঠের সময় তার মর্ম অনুধাবন করাও জরুরি। খোরাসান হতে মক্কা গমনে বাইজিদ বোস্তামী রহ. এর সময় লাগে বারো বছর। সম্ভবত তিনি তখন খোরাসানে ছিলেন, তখন হজ্জ পালনের নিয়ত করেন। তার পাথেয় বা সম্বল ছিল ‘তাকওয়াহ’। ‘তাজকেরাতুল আওলিয়া’ এর বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত বাইজিদ (রহ.) যখন হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, তখন প্রত্যেক নামাজের স্থানে জায়নামাজ বিছিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন এবং প্রত্যেক পদে পদে সেজদা করতেন। বারো বছর সময়ে খানা-ই-কাবা পর্যন্ত পৌঁছেন। চলার সময় বলতেন : ‘এটি দুনিয়ার কোনো বাদশাহর দরবার নয় যে, ঐ স্থানে একবার দৌঁড়ে পৌছে যাবো।’ অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে যাওয়ার জন্য প্রত্যেক পদক্ষেপেই সম্মান প্রদর্শন করা উচিত।
আল্লাহর ঘরে কিছু দেখেছেন কী? এ সম্পর্কে কাশফুল মাহজুবের লেখক হজরত বাইজিদ (রহ.)-এর একটি উক্তি নকল করে লিখেছেন, ‘আমি প্রথমবার যখন কাবা জিয়ারতের সৌভাগ্য লাভ করি, তখন সেখানে আমি কাবা ঘরকে খুব ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু ঘরের মালিককে দেখিনি। তাই আমি বুঝতে পারলাম যে, এখনো আমার হজ্জ কবুল হয়নি। দ্বিতীয়বার যখন মক্কা মোআজ্জমায় গমন করি, তখন ঘরও দেখি এবং ঘরের মালিককেও দেখি। তৃতীয়বার যখন হজ্জ্বে গমন করি তখন ঘরের মালিককে খুব ভালোভাবে দেখেছি এবং ঘর কোথাও দেখা যায়নি।’
মদিনা মোনাওয়ারা মাহবুবে খোদার শেষ বিশ্রামের স্থান হওয়ার জন্য এমন একটি পবিত্র ভূমি যার প্রতি ভক্তি ভালোবাসা প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে তরঙ্গায়িত হয়। এমন আশেকে রাসূল বিশ্বাসীদের জন্য কেবলার মতো মর্যাদাবান, যার বিন্দু কণা পর্যন্ত আদব ও সম্মানের দাবিদার এবং সেই বিশেষ স্থান, যেখানে পবিত্র দেহ সমাহিত (রওজা মোবারক)। মক্কা মোকাররমা জিয়ারত করার সাথে মদিনা মোনাওয়ারা জিয়ারত করা উত্তম। কিন্তু হজরত বাইজিদ (রহ.) -এর মন সায় দিলো না যে, হজ্জের সঙ্গে সঙ্গেই মদিনা জিয়ারতের কাজও সমাধা করতে হবে। তাই তিনি যখন হজ্জ করেন, তখন মদিনা জিয়ারতে গমন করেননি এবং বলেন; ‘এটি আদব (সম্মান) হতে পারে না যে, মদিনাকে মক্কা জিয়ারতের অধীনে রাখা যাবে।’
পরবর্তী বছর রাসূলের পবিত্র ভ‚মি মদিনা জিয়ারতের জন্য খোরাসান হতে সফর শুরু করেন এবং রসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারকে হাজির হন। এখানে রসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভক্তি ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য যা যা করা দরকার সাধ্যমতো সবই করেন এবং দরূদ ও সালাম পাঠ করতে থাকেন। এ সময় তাঁর নিদ্রা এসে যায়। তিনি দেখলেন তাঁর দৃষ্টির সামনে রসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত এবং বলছেন, ‘বাইজিদ ওঠো এবং গিয়ে তোমার মায়ের খেদমত করো।’
আমরা দুইজন বিখ্যাত সাধকের হজ্জ আদায় জিয়ারতের দুই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছি মাত্র। এরূপ আরো অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। এ দুটি ঘটনায় হজ্জ যাত্রীদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তারা নিজেদের হজ্জ মূল্যায়ন করলে বুঝতে পারবেন তাদের হজ্জ এর কি অবস্থা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।