Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৮, ১:০১ এএম

গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছেই। বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চলাচল, সিটিং ও বিরতিহীনের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, পাল্লাপাল্লি করে ছুটে চলা, যত্রতত্র থামা, ওঠানামা করানো, ট্রাফিক নিয়ম লঙ্ঘন কোনোটাই বন্ধ হয়নি। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম দেখা গেলেও এখনও চলছে ফিটনেসবিহীন বাস ও মিনিবাস। ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, নগর পরিবহনে সেবা বলতে কিছু নেই। বেশিরভাগ বাসের সীট সরু-আরাম করে বসা যায় না। কোনো কোনো বাসের সীট নড়বড়ে, দরজা-জানালা নাই, বডি থেকে টিন খুলে পড়েছে, সামনে-পেছনের লাইট জ্বলে না, হুইস পাইপ দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হয়, চলতে গিয়ে বিকট শব্দ হয় আরও কতো কি? নিয়ম না মেনে চলার কারণে নগরীর ব্যস্ত এলাকাগুলোতে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টির কারণও এই যাত্রীবাহী বাসগুলো। সবকিছু মিলিয়ে পরিবহন সেক্টর সেই আগের মতোই বিশৃঙ্খল, অরাজক, নিয়মনীতিহীন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরেও পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরার কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমরা আশা করেছিলাম, শিক্ষার্থীরা আমাদেরকে যে পথ দেখিয়ে গেছে তার একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। কিন্তু গত কয়েক দিনে ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেও এর তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। আগের মতোই গাড়িগুলো লেন মেনে চলছে না। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে, পাল্লাপাল্লি করছে। তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশ এ কয়দিনে শুধু বড় অঙ্কের মামলা ও বিশাল অঙ্কের জরিমানা আদায় করেছে। কিন্তু তারা শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি। তাদের দায়িত্ব তো রাজস্ব আদায় করা নয়। আমরা শিক্ষার্থীদের দেখানো পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হবে বলে আশা করেছিলাম।
তাহলে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে? এ প্রশ্নের জবাবে সাধারণ বাস মালিকরা বলেছেন, পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারী দলের নেতারা। আবার শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বেও আছেন মন্ত্রী-এমপিরাই। তাদের প্রভাবেই চালক থেকে শুরু করে পরিবহন শ্রমিকরা বেপরোয়া। এ কারণে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।
জানা গেছে, ঢাকায় বাস কোম্পানি আছে ২৪৬টি। আর বাস চলে প্রায় ৮ হাজার। বেশিরভাগ বাসেরই ফিটনেসসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আপডেট নেই। তার প্রমান গত রোববার থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ ও মোবাইল কোর্টের অভিযান শুরুর পর থেকে ঢাকায় বাস ঠিকমতো রাস্তায় নামছে না। বাস মালিকদের ভাষায়, এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ দেড় হাজার বাস চলাচল করেছে। এর মধ্যে সপ্তাহের শেষ দিন গত বৃহস্পতিবার নেমেছিল আরও কম। এ কারণে গণপরিবহনের অভাবে যাত্রীদের সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রভাবশালী রাজনীতিকদের বাস কোম্পানি থাকায় এতোদিন ফিটনেসবিহীন, রংচটা, লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসের বিরুদ্ধে খুব একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। প্রভাবশালী মালিকের বাস চালকেরা বরাবরই বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে কোনো যাত্রী উচ্চবাচ্য করলে তাদের শায়েস্তা করার জন্যও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নিজেদের লোক রাখেন পরিবহন মালিকেরা। এ কারণে সিটিং, বিরতিহীন, সময় নিয়ন্ত্রণ, গেইটলকসহ নানা কৌশলে সরকার-নির্ধারিত হারের দু-তিন গুণ ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল পান না যাত্রীরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকায় তিনটি রুটে চলাচল করে সরকারের এক মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন কোম্পানীর বাস। সরকারদলীয় দুজন বর্তমান ও একজন সাবেক এমপির নিজ নামেই পরিবহন কোম্পানি আছে। এর বাইরে এমপি পরিবারের সদস্য, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সরকার-সমর্থক কাউন্সিলরসহ ২০ থেকে ২৫ জন নিজ নামে বা পরিবারের সদস্যদের নামে কোম্পানি করে বাস পরিচালনা করছেন। আবার পুলিশের সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাই, ছাত্রলীগের সাবেক একজন সাধারণ সম্পাদকের কোম্পানির অধীনেও বাস-মিনিবাস চলছে ঢাকায়। আছে একটি বিশেষ জেলার কিছু ব্যক্তির বাস কোম্পানীও। সাধারণ মালিকরা জানান, প্রভাবশালী এসব মালিকের বাসগুলোর চালক শ্রমিকরাও নিজেদেরকে প্রভাবশালীই মনে করে। বেপরোয়া চলাচলে তারা দ্বিধাবোধ করে না।
গত ২৯ জুলাই বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস আরও দুটি বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ফুটপাতে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের উপর তুলে দেয়। এতে ঘটনাস্থলে দুজন নিহত ও আরও ১০/১২জন আহত হয়। ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে রুপ নেয়। জাবালে নূর পরিবহন কোম্পানীর মালিক সরকারের এক মন্ত্রীর শ্যালক। বাস মালিকরা জানান, এক কোম্পানীর বাস যারা চালায় তাদের বেশিরভাগই বেপরোয়া। ওই মন্ত্রীর ভাইয়ের মালিকাধাীন কনক পরিবহনের বাস চালকদের বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ আছে।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে মধ্যদিয়ে নগরীতে শুরু হয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান। এখন চলছে ট্রাফিক সপ্তাহ ও মোবাইল কোর্টের অভিযান। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর প্রথমে নগরীতে এবং পরে দুরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় মালিক-শ্রমিকরা। প্রায় এক সপ্তাহ বাস চলাচল বন্ধ থাকাকালে সারাদেশই কার্যত অচল ছিল। তাতে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সে দায় নিতে নারাজ মালিক-শ্রমিকপক্ষ। সে সময় নেতারা দাবি করেছিলেন, নিরাপত্তার কারণে তারা রাস্তায় গাড়ি নামাচ্ছেন না। এখন আন্দোলন শেষ। ফিরে এসেছে স্বাভাবিক পরিবেশ। এখন আবার ওই সব নেতারাই নিজ দায়িত্বে গাড়ির কাগজপত্র চেক করছেন। কিন্তু তারপরেও চালকদের স্বেচ্ছাচারিতা থামে নি। থেমে নেই বাে বাসে রেষারেষি। এমনকি ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর বাসও চলছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া রুটে এখনও চলছে ফিটনেসবিহীন বাস। গাজীপুর-সদরঘাট রুটেও দেখা গেছে ফিটনেসবিহীন বাস। মিরপুর এলাকায় গতকালও বেশ কয়েকটি ফিটনেসবিহীন বাস চলেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগি যাত্রীরা। তাদের মতে, বাসগুলোর ভিতরের অবস্থা খুবই খারাপ। সীটগুলো নড়বড়ে। ছাদের ফুটো দিয়ে আলো প্রবেশ করে। এসব বাসের ফিটনেস থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের মুখে গতকাল বিকালেও একাধিক বাসকে পাল্লাপাল্লি করে যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। একজন যাত্রী জানান, শ্রাবণ পরিবহনের বাসের সাথে কোমল পরিবহনের বাসের এমন পাল্লাপাল্লির সময় যাত্রীরা ক্ষীপ্ত হয়ে উঠলে চালক আর না দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করে। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তা বন্ধ করে তুরাগ পরিবহনের বাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে। একই চিত্র দেখা গেছে গুলিস্তানে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে। গুলিস্তান থেকে ফ্লাইওভার দিয়ে রায়েরবাগ, সাইনবোর্ডের বাসগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী তুলছে। অথচ অদূরেই দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশ। এতোকিছুর পরেও বন্ধ হচ্ছে না বিশৃঙ্খলা। তাহলে কবে ফিরবে শৃঙ্খলাঃ এ প্রশ্নের জবাবে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দোষেই সব বিশৃঙ্খলা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সড়কে চলাচলের জন্য পথচারীদেরকেও কিছ নিয়ম-কানুন তো মানতে হবে। তা না হলে বিশৃঙ্খলা তো হবেই। তিনি বলেন, আমরা শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করছি। সকালেও সায়েদাবাদ টার্মিনালে কাগজপত্র চেক করে তবেই বা ছাড়তে দিয়েছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, অনেক দিনের সৃষ্ট সমস্যা, এটা ঠিক হতে একটু তো সময় লাগবেই।
গণপরিবহনের নৈরাজ্য প্রসঙ্গে গণপরিবহন ও দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ বুয়েটের শিক্ষক প্রফেসর ড. শামছুল হক বলেন, আমাদের পেছনে অনেক বেশি ভুল হয়ে গেছে। এজন্য সৃদূরপ্রসারি পরিকল্পনা দরকার। একই সাথে পদ্ধতিগত পরিবর্তন দরকার। তা না হলে পরিবহন সেক্টরের এই বিশৃঙ্খলা যুগ যুগ ধরে থেকেই যাব। তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের পরিবহন সেক্টরের সিস্টেমকে হুবুহু ফলো করলেই মোবাইল সেক্টরের মতো এখানেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।



 

Show all comments
  • মোঃ নুরুল ইসলাম ১১ আগস্ট, ২০১৮, ১:১২ এএম says : 0
    ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে অতো শত অনিয়ম ধরা পড়ল তবুও আমরা সড়কে পরিবহন নৈরাজ্য করেই অতঃপর নিত্য মানুষ মরছেই সড়ক দুর্ঘটনা জনিত কারণে প্রতিটি দিনে রাতে????
    Total Reply(0) Reply
  • Ismail Hossain ১১ আগস্ট, ২০১৮, ২:৩৫ এএম says : 0
    তাহলে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরবে কবে?
    Total Reply(0) Reply
  • Fayshal ১১ আগস্ট, ২০১৮, ২:৪৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশে ট্রাফিক আইন বলে যে কিছু আছে, তা ছবিটা লেখলে বুঝাই যায় না।
    Total Reply(0) Reply
  • Habib Readoy ১১ আগস্ট, ২০১৮, ২:৪৭ এএম says : 0
    ট্রাফিক সিগন্যাল এ কেমেরা থাকবে,,,অটুমেটিক ফাইন পরবে। তাহলে এসব বন্ধ হতে পারে
    Total Reply(0) Reply
  • Farhana Aktar Shoshi ১১ আগস্ট, ২০১৮, ২:৪৭ এএম says : 0
    পুলিশকে ঘুষ খাওয়া বন্ধ করলেই সব সমাধান হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Goutam Sanyal ১১ আগস্ট, ২০১৮, ২:৪৯ এএম says : 0
    If 100% people of Dhaka use foot over bridge, you will observe tremendous traffic management improvement, I can challenge. Traffic congestion will reduce drastically.
    Total Reply(0) Reply
  • Md Habibur Rahman ১১ আগস্ট, ২০১৮, ৯:০৮ এএম says : 0
    Very bad our government failed
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ