বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
শান্তি ও ন্যায় সত্যের ধর্ম ইসলাম। সত্য প্রতিষ্ঠিত থাকলে শান্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হয় সহজ। তাই দেখা যায় প্রাথমিক যুগে ইসলাম ধর্মের সভ্যতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিধর্মীরা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এই ধর্মের সত্যতা সকল যুগেই প্রমাণিত হয়েছে এবং চিরকাল প্রমাণিত হতে থাকবে।
আধুনিক যুগে ইসলাম ধর্মের পুনর্জাগরণ দেশে দেশে পরিলক্ষিত হওয়ার অন্তরালেও কাজ করছে এই বিশ্ব ধর্মের সত্যতা, বাস্তবতা। বর্তমানে দুনিয়ার সর্বত্র বিভিন্ন জাতির লোক ইসলামের মাহাত্মে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। যার প্রমাণ বিশ্ববাসী প্রতিনিয়ত লক্ষ করছে। বাংলাদেশেও এই শুভ লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানেও নও মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পর্যন্ত অনেক বিধর্মী নারী-পুরুষ ইসলাম ধর্মের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। বর্তমানে তারা ইসলাম ধর্মের বিধান মোতাবেক সুখী জীবনযাপন করছে। বস্তুত ইসলামের বাস্তব আদর্শ শিক্ষা মানব জীবনকে সুশৃঙ্খলিত ও সুনিয়ন্ত্রিত করে থাকে বলে তার প্রকৃত অনুসরণ এই ধর্মের প্রতি অনুপ্রাণিত করে থাকে। তাই সত্যনিষ্ঠ ও সত্য প্রচারের আদর্শ মানব জীবনকে করে ধন্য ও গৌরবান্বিত।
সত্য প্রচারের আবশ্যকতা সম্পর্কে কালাম মজিদে আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি মন্ডলী থাকা বিশেষ আবশ্যক, যারা আহ্বান করতে থাকবে কল্যাণের পানে এবং যারা সঙ্গতের জন্য আদেশ দিতে ও অসঙ্গত হতে বাধা দিতে থাকবে। বস্তুত এই যে লোকসমাজ, সফলকাম হতে পারবে তারাই।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১০৩)
মানুষকে কল্যাণের দিকে ডেকে আনা, তাকে সৎকর্মে প্রবৃত্ত ও অসৎকর্ম হতে নিবৃত্ত করার জন্য একটি ‘উম্মতের’ একান্ত আবশ্যক। এই উম্মত বা প্রচারকমনন্ডলীর পরিচয়ও অপর আয়াতে দেয়া হয়েছে, ‘তোমরা হচ্ছ শ্রেষ্ঠতম উম্মত, যাদেরকে আবির্ভ‚ত করা হয়েছে বিশ্বমানবের হিতকল্পে, তোমরা সঙ্গতের আদেশ দান করতে ও অসঙ্গত হতে নিষেধ করতে থাকো। আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী থাকো। বস্তুত আহলে কেতাবগণ ঈমান আনলে তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক হতো। তাদের মধ্যে কতক লোক হচ্ছে মোমেন আর তাদের অধিকাংশই অনাচারী (ফাসেক)। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১০৯)
এই আয়াতে শ্রেষ্ঠতম উম্মতের দুইটি প্রধান কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। সত্য ও সঙ্গত যা কিছু আছে তা যাতে সর্বভাবে জয়যুক্ত হয়, আদেশ-উপদেশ, প্রচারে ও আলোচনায় তার যথাসাধ্য চেষ্টা করা এবং অসত্য ও অসঙ্গত যা কিছু আছে মানব সমাজকে তা হতে বিরত রাখার যথাসম্ভব প্রয়াস চালানো। এই দুইটি সাধন হবে উম্মত হিসেবে তাদের প্রধান কর্তব্য পালনের সময়। এই উম্মতগণ সকলে সত্যকার ঈমানের সকল কল্যাণে নিজের মন ও মস্তিষ্ককে পরিপূর্ণ করে রাখবে, তাও আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। আদেশ-নিষেধ প্রচারের কর্তব্য পালন করতে যাবে যারা, তারা নিজেরাই যদি আল্লাহতে সত্যিকারভাবে বিশ্বাসী না হয়, অথবা অসত্য ও অসঙ্গত সংস্কার দ্বারা সেই ঈমানকে আড়ষ্ঠ ও অবসন্ন করে ফেলে তা হলে এই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালন করা তাদের পক্ষে কখনই সম্ভবপর হবে না।
আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন; ‘সকলে তার সমান নয়, তাহলে কিতাবীদের মধ্যে (এরূপ) একটি ন্যায়নিষ্ঠ মন্ডলী আছে যারা আল্লাহর আয়াতগুলোর আবৃত্তি করতে থাকে রাতে, আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনসমূহও তারা সেজদা করে থাকে। তারা বিশেষ করে আল্লাহ হতে তার পরবর্তী দিবস আর সঙ্গতের আদেশ চায় ও অসঙ্গত হতে নিষেধ করে থাকে এবং সমস্ত সৎকর্মেই তারা দ্রুত তৎপর হয়। বস্তুত তারাই হচ্ছে সাধু জনগণের অন্তর্গত।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত-১১২-১১৩)
জগতের বুকে সত্যের সহায়তা ও ন্যায়ের সংগ্রাম করার আবশ্যকতা কোরআনের উদ্ধৃত আয়াত হতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এ সম্বন্ধে হজরত রসূলুল্লাহ (সা:) পবিত্র হাদিসেও ঘোষণা করেছেন যে, ইসলাম ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করার নির্দেশ দান করেছেন। রসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন যে, ‘আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচার করে কোনো মানুষের হুকুম মেনে চলবে না।’ (নওয়াস ইবনে সোবআন কর্তৃক বর্ণিত)
হজরত আব্দুল্লাহ (রা:) কর্তৃক বর্ণীত এক হাদিসে হুজুর (সা:) বলেছেন, ‘আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত অপরাধের দন্ড বন্ধ করার জন্য যে ব্যক্তি অনুরোধ করে সে আল্লাহর সঙ্গেই বিরোধ করে। যে ব্যক্তি জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা অন্যায় পক্ষ সমর্থন করে, এই কার্য হতে বিরত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর অভিশাপে পরিবেষ্টিত থাকে। আর যে ব্যক্তি কোনো মোমিনের প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করে, তওবা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের মধ্যে শামিল করে রাখেন।’ (আদবুল মোফরাদ)
হজরত আলী (রা:) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদিসে হুজুর (সা:) এরশাদ করেছেন, ‘হুকুমদাতা যে কেউই হোক না কেন, কোনো পাপ কার্যের হুকুম করলে তা মানতে হবে না, বরং শুধু সৎ কার্যের আদেশ মেনে চলবে।’
হজরত আবু সাউদ (রা:) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে হুজুর (সা:) বলেছেন, ‘অত্যাচারী জালেম শাসকের সম্মুখে সত্য কথা বলাই সর্বোত্তম জেহাদ।’
অন্যায়ের প্রতিবাদ সম্বন্ধে হজরত ওবাদা ইবনে সামেত (রা:) বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূলের হাতেই বায়াত (শপথ গ্রহণ) করেছি যে, সুখে-দুঃখে, সুবিধা-অসুবিধায় আমরা তার হুকুম মেনে চলব। যে ব্যক্তি যে কাজের উপযুক্ত বা যার যা প্রাপ্য, সে ব্যাপারে আমরা অনর্থক ঝগড়া-বিবাদ করে অশান্তি সৃষ্টি করব না।’
পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদিস দ্বারা অকাট্যরূপে প্রমাণিত, শ্রেষ্ঠ উম্মতের পরিচয় কি হওয়া উচিত। প্রত্যেক মুসলমানের ইসলামের এসব আদর্শ শিক্ষা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত করা হলে দাবি করা চলে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে। মুখে যা বলা হলো কাজে তার প্রতিফলন নেই, এটা শ্রেষ্ঠ উম্মতের লক্ষণ হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।