দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ঘটনা-১: বনী-ইসরাঈলের একটি এতিম শিশু সবকাজই তার মা’কে জিজ্ঞাসা করে মায়ের সন্তুষ্টি মোতাবেক সম্পাদন করতো। সে একটি সুন্দর গাভী পালন করতো এবং সার্বক্ষণিক তার দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকতো। একদা একজন ফেরেশতা মানুষের আকৃতি ধারণ করে ছেলেটির সামনে উপস্থিত হলো এবং গাভীটি ক্রয় করার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো। ছেলেটি মূল্য জিজ্ঞামা করলে, ফেরেশতা তার মূল্য অনেক কম বললো। ছেলেটি বিষয়টি যখন তার মা’কে জানালো, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তারপর ফেরেশতা পর্যায়ক্রমে যতবারই দাম বাড়াতে থাকে, ছেলেটি তার মা’কে অবহিত করে তার জবাব দিতে থাকে। কয়েকবার এমনটি হওয়ার পর ছেলেটি বুঝতে পারলো, আমার মা গাভীটি বিক্রয়ে সম্মত নন। তাই সে ফেরেশতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল, কোন মূল্যেই গাভীটি বিক্রয় করা হবে না। ফেরেশতা বললেন, তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবান! কারণ, তুমি প্রতিটি কথাই নিজের মা’কে জিজ্ঞাসা করে, বলে থাকো। অতি সত্বর তোমার কাছে কয়েকজন লোক গাভীটি ক্রয় করতে আসবে। তখন তুমি গাভীটির মূল্য অনেক বেশী হাঁকবে।
অপরদিকে বনী-ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তির হত্যার ঘটনা সংঘটিত হলো এবং তাদেরকে যে-গাভীটি কুরবানী করার নির্দেশ দেওয়া হলো, সেটি ছিলো ওই ছেলেটির গাভী। এমনিভাবে বনী-ইসরাঈলের লোকজন যখন ওই ছেলের কাছ থেকে গাভী খরীদ করতে এলো তখন ছেলেটি বললো, গাভীটির মূল্য তার সমপরিমাণ ওজনের স্বর্ণ। পরিশেষে, বনী-ইসরাঈলের লোকজন উক্ত চড়া মুল্য আদায় করেই গাভীটি খরীদ করে নিল। অর্থাৎ মায়ের প্রতি অধিক আদব-সম্মান প্রদর্শনের ফলেই, মহান আল্লাহ্ ছেলেটিকে এ জগতেই একটা অসাধারণ ফলাফল দিয়ে দেওয়ার কুদরতী ব্যবস্থা করলেন। ‘তাফসীরে আযীযী’ ও ‘তাফসীরে মা‘আলিমুল-কুরআন ফী দারসিল-কুরআন’-এ লেখা হয়েছে, “ছেলেটির ওই অসামান্য সম্পদ প্রাপ্তির কারণ হচ্ছে, পিতামাতার প্রতি তার আদব ও আনুগত্য।” ‘তাফসীরে তাবারী’-তেও উক্ত একইরকম ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, পিতামাতার সেবা ও আদবের আংশিক ফলাফল জাগতিক জীবনেও পাওয়া যায়।
ঘটনা-২: বনী-ইসরাঈলের তিনজন লোক একসঙ্গে সফর করছিল। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দৌড়ে তিনজনই একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গুহায় আশ্রয় নিল। এরই মধ্যে পাহাড়ের উপর থেকে একটি বিশালকায় পাথরখন্ড পড়ে গুহাটির মুখ বন্ধ হয়ে গেল। গুহার ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেল। তিনজনের সামনেই মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠছিল। তারা পরস্পর পরামর্শ করলো, আল্লাহ্র দরবারে নিজ নিজ কৃত নেক আমলের উসিলায় প্রার্থনা করে এ ভীষণ বিপদ থেকে মুক্তির আবেদন করা যেতে পারে। তাই করা হলো। তাদের মধ্যকার একজন বললো, হে প্রভ‚! আপনি জানেন যে, আমার পিতামাতা বৃদ্ধ ছিলেন। আমি সারাদিন ছাগল চরাতাম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফিরে সেসব ছাগলের দুধ আমার পিতামাতাকে পান করাতাম। একদিন ঘরে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল এবং ঘরে ফিরে দেখলাম তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন। হেআল্লাহ্! আমি দুধের পিয়ালা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে,যখন তাঁদের ঘুম ভাঙ্গবে, তা পেশ করবো। ওই অবস্থাতেই আমার সারা রাত কেটে গেল। দয়াল আল্লাহ্! আমার এ আমলটি যদি আপনার কাছে কবূল হয়ে থাকে তা হলে তার উসিলায়/বরকতে এ পাথরখন্ডটিকে সরিয়ে দিন! তাই হলো, পাথরটি নিজস্থান থেকে কিছুটা সরে গেল এবং গুহার মুখ এক-তৃতীয়াংশ উন্মুক্ত হয়ে গেল। তারপর একইভাবে দ্বিতীয়জন ও তৃতীয়জন প্রার্থনা জানালো......এক পর্যায়ে পাথর খন্ডটি সরে গেল এবং তারা তিনজনই মুক্ত হয়ে গেল। (সীরাতুন নবী (স): আল্লামা শিবলী নোমানী র.)
উক্ত ঘটনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, মাতাপিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের ফল এ জগতেও পাওয়া যায়।
ঘটনা-৩: জনৈক যুবক নিজ পিতামাতার প্রতি আদব-সম্মান প্রদর্শনে অনেক যতœবান ছিল এবং সর্বদা পিতামাতার সেবায় ব্যস্ত থাকতো। পিতামাতা যখন অনেক বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হলেন তখন তার ভাইয়েরা পরামর্শ করলো, পিতামাতা জীবিত থাকতেই আমরা সব সম্পদ বন্টণ করে নেই। তা হলে পরবর্তিতে আর আপসে কোনো ঝগড়া-বিবাদ হবে না। ওই যুবক বললো, আপনারা সব জাগা-জমিন বন্টণ করে নেন এবং আমাকে নিজ পিতামাতা সেবার সুযোগ দিয়ে তাঁদেরকে আমার ভাগে দিয়ে দিন। অন্য ভাইয়েরা সন্তুষ্টচিত্তে তাই করলো। এই যুবক সারাদিন বাইরে কাজকর্ম-পরিশ্রম করতো এবং রাতে বাড়ী ফিরে পিতামাতার সেবা ও স্ত্রী-সন্তানদের দেখাশোনা করতো। দিন যেতে থাকে, এক পর্যায়ে পিতামাতা দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
একদা যুবকটি রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলো, একজন লোক তাকে বলছে,“হে যুবক! তুমি নিজ পিতামাতার আদব, সেবা করেছো, তাঁদের সন্তুষ্ট রেখেছো; তার পরিবর্তে তোমাকে পুর¯কার দেওয়া হবে। তা হচ্ছে, যাও! অমুক পাথরের নিচে একটি স্বর্ণমুদ্রা রাখা আছে; তা উঠিয়ে নাও!” তাতে তোমার জন্য বরকত নিহিত রয়েছে। যুবকটি সকালবেলা জাগ্রত হয়ে দেখতে পেল, পাথরটির নিচে একটি স্বর্ণমুদ্রা পড়ে আছে। সে তা উঠিয়ে নিল এবং খুশী খুশী বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে জনৈক মাছবিক্রেতার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মনে জাগলো, স্বর্ণমুদ্রাটি দিয়ে একটি বড় মাছ ক্রয় করে বাড়ী নিয়ে যাই; তা হলে বিবি-বাচ্চা সকলে মিলে তা ভাজি করে খাওয়া যাবে। সে তাই করলো, একটি বড় মাছ ক্রয় করে বাড়ী ফিরলো। স্ত্রী মাছটি রান্না করার জন্য কাটতে শুরু করলেন। মাছটি কাটার পর তার পেটে অনেক মূল্যবান একটি হীরা পাওয়া গেল! যুবক খুশিতে বাগ বাগ হয়ে গেল। বাজারে গিয়ে তা বিক্রি করে, এতো বড় অঙ্কে তার মূল্য পেল; যা তার আজীবনের ব্যয়ভার বহনে যথেষ্ট হয়ে গেল।
ঘটনা-৪: একজন বুযুর্গ দিবারাত্রি ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকতেন। একদা তাঁর মনে জাগলো, আল্লাহ্ তা‘আলার কোনো ওলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দরকার। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, একটি যুবক ছাগল চরাচ্ছে এবং আরেকজন লোক বলছে,“এই যুবকটি আল্লাহ্ তা‘আলার দোস্ত; তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করো!”
উক্ত বুযুর্গ জাগ্রত হয়ে ওই যুবকের তালাশে বের হলেন। একদিন তিনি দেখতে পেলেন, যুবকটি তার ছাগলের পাল নিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছে। তিনি সাক্ষাতে অত্যন্ত খুশি হলেন এবং তাকে বললেন, আমি কয়েকটি দিন আপনার গৃহে মেহমান হিসাবে অবস্থান করতে ইচ্ছুক। যুবকটিও আনন্দ প্রকাশ করলো এবং ওই বুযুর্গকে নিজ গৃহে নিয়ে এলো। রাতের বেলায় দু’জনে বাক্যালাপ করছিলেন এবং ওই বুযুর্গ প্রাসঙ্গিকভাবে নিজের স্বপ্নের কথা যুবকটিকে শোনালেন; এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কোন্ আমলটি আল্লাহ্র কাছে এতো অধিক প্রিয় হয়েছে যে, তিনি তোমাকে তাঁর বন্ধু হিসাবে কবূল করে নিয়েছেন? তা শুনে ওই যুবকের চোখে কান্না এসে গেল। তারপর সে পার্শ্ববর্তী কক্ষ খুলে দেখালো যে, এই সেই কক্ষ যেখানে দু’জন বিকৃত মুখমন্ডলধারী মানব বন্দী অবস্থায় ছিলেন! ওই বুযুরগ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী রহস্যাবৃত কথা বলছো? যুবকটি বলতে লাগলো, এরা ছিলেন আমার পাপিষ্ট, উদাসীন পিতামাতা। একবার তাঁরা উভয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এমন বে-আদবীপূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের চেহারা বিকৃত করে দিয়েছেন। আমি সারাদিন ছাগল পাল চরাই এবং রাতে যখন ঘরে ফিরি তখন প্রথমে তাঁদের খানা খাওয়াই; তারপর নিজে খাই। যদিও তাঁরা তাঁদের অপরাধের শাস্তি দুনিয়াতেই পেয়ে গেছেন। কিন্তু আমার তো ফরয দায়িত্ব তাঁদের যথাযথ সেবা করা, তা আমি করে গেছি। কেননা তাঁরা তো আমার পিতামাতা। ওই বুযুরগ তা শুনে অবাক হয়ে গেলেন এবং তার সঙ্গে কোলাকুলি করে বললেন, আমি তো পুরো রাত জেগে ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছি এবং সারাদিন রোযা পালন করেছি; তবুও তো সেই মর্যাদায় উপনীত হতে পারিনি যে-মর্যাদায় আপনি আপনার পিতামাতার প্রতি আদব ও সেবার দ্বারা উন্নীত হয়েছেন! (হুক‚কুল ওয়ালেদাইন)
ঘটনা-৫: হযরত ওয়েছ করনী রা. একজন অন্যতম বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন। তিনি মহানবী (স)-এর যুগ পেয়েছিলেন বটে; তবে নবী কারীম (স)-এর নূরানী চেহারা মুবারক দেখার মতো সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। তার কারণ, তিনি সার্বক্ষণিক তাঁর মায়ের সেবায় ব্যপৃত থাকতেন। একবার মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন, যেন মদীনা শরীফ পৌঁছে নবীজী (স)-এর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হতে পারেন। মা বললেন, বাবা! যাও, তবে তাড়াতাড়ি এসে পড়বে! হযরত ওয়েছ করনী রা. দীর্ঘ সফর করে মদীনা শরীফ পৌঁছালেন; কিন্তু প্রিয়নবী (স) তখন মদীনার বাইরে কোনো যুদ্ধের জন্য চলে গিয়েছিলেন। মায়ের আদেশ পালনার্থে তিনি বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারলেন না এবং বাড়ি ফিরে এলেন। নবীজী (স) যখন মদীনা ফিরে এলেন এবং তাঁকে বলা হলো, “কারন গোত্রের জনৈক যুবক আপনার সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে এসেছিল; তবে সে নিজ মায়ের আদেশের নিমিত্তে ফিরে গেছে।” তখন প্রিয়নবী (স) স্বীয় জুব্বা মুবারক দিয়ে হযরত উমর ও হযরত আলী রা.-কে ইরশাদ করলেন:“আমার পক্ষ থেকে এটি হাদিয়াস্বরূপ ওয়েছ করনীকে পৌঁছে দেবে এবং তাকে বলবে, এই জুব্বা পরিধান করে যেন আমার গোনাহগার উম্মতের জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করে!” ‘তাযকিরাতুল আওলিয়া’ গ্রন্থে রয়েছে, প্রিয়নবী (স)-এর ইন্তেকালের পর হযরত উমর ও হযরত আলী রা. সেই জুব্বা হযরত ওয়েছ করনী রা.-কে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
ঘটনা-৬: হযরত খাজা আবুল হাসান খারকানী র.-এর এক ভাই অনেক বেশী ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন এবং দিনরাত ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন। অথচ তাঁর নিজের সময়ের বেশীঅংশ মাতাপিতার সেবা ও আনুগত্যে কেটে যেত! একবার যখন তাঁর ভাই রাতের বেলায় যিকির ও ইবাদতে লিপ্ত ছিলেন তখন কোনো একজন আওয়াযদানকারীর শব্দ শুনতে পেলেন, যিনি বলেন,“আমি তোমার ভাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি এবং তার বরকতে তোমাকেও ক্ষমা করে দিলাম!” এই ভাই অত্যন্ত আশ্চাযান্বিত হলো যে, যিকির ও ইবাদতে তো আমি সার্বক্ষণিক নিমগ্ন থাকি অথচ আবুল হাসানের বরকতে আমাকে ক্ষমা করা হলো! তারপর পুনরায় শব্দ এলো, “তোমার ইবাদতের প্রয়োজন আমার নেই; বরং মুখাপেক্ষী মায়ের সেবাকারী ব্যক্তির ইবাদত-আনুগত্যই আমার কাছে কাঙ্খিত, গ্রহণযোগ্য”। (তাযকিরাতুল আউলিয়া)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।