বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
বৃদ্ধ ও অসহায় পিতামাতার ভরণপোষণ সন্তানের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, অনেক সন্তানই এই দায়িত্ব পালন করেন না। শিক্ষিতদের মধ্যে এ প্রবণতাটি একটু বেশিই দেখা যায়। শিক্ষিত ও উপযুক্ত সন্তান থেকেও অনেক শিক্ষিত ঘরের বৃদ্ধ ও অসহায় বাবা-মাকে আশ্রয় নিতে দেখা যায় বৃদ্ধাশ্রমে। উপার্জনক্ষম সন্তান থেকেও বৃদ্ধ বয়সে পিতামাতাকে যদি বৃদ্ধাশ্রমে দিন কাটাতে হয়, এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ও নিষ্ঠুর আর কিছু হতে পারে না। কাজেই সন্তানের উচিত বৃদ্ধ পিতামাতার দেখাশোনা ও ভরণপোষণ করা এবং তাদের সঙ্গ দেয়া।
আমরা জানি, বৃদ্ধ বয়সে যাতে সন্তানের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সে জন্য পিতামাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ গৃহীত হয়েছে। কোনো সন্তান যদি বৃদ্ধ পিতামাতাকে বাধ্য করেন বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও বসবাস করতে, অথবা কোনো সন্তান যদি পিতামাতার ভরণপোষণ না করেন, তাহলে তারা এ আইনের অধীনে ভরণপোষণের জন্য আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন।
পিতামাতার ভরণপোষণের আইনটি একটি জনকল্যাণকর আইন। এ আইনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যেহেতেু সন্তান কর্তৃক পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়, সেহেতু আইনটি প্রণয়ন করা হলো। কোনো সন্তান যদি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে পিতামাতার ভরণপোষণ না করেন, তাহলে তারা ভরণপোষণের জন্য এ আইনের অধীনে লিখিত অভিযোগের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে পারবেন।
আইনে ভরণপোষণ প্রদানে সন্তান বলতে শুধু পুত্রকেই বোঝায়নি। কন্যাকেও বুঝিয়েছে। অর্থাৎ পিতামাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব ছেলের একার নয়, বরং মেয়েরও। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা আনা হয়েছে। আর ভরণপোষণ শুধু কোনো বিশেষ সন্তান নেবে; তা নয় বরং সবাইকে নিতে হবে। তবে একাধিক সন্তান থাকলে তারা নিজেরা আলোচনা করে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করবেন। কোনো সন্তান পিতামাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকেই তাদের পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে এবং চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। পিতামাতা একত্রে বা আলাদা বসবাস করলে প্রত্যেক সন্তানকে সাধ্যমতো তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। পিতামাতা যদি সন্তানের সাথে বসবাস না করেন, তাহলে তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ উর্পাজন থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ দেবে।
আইনটি শুধু পিতামাতার ভরণপোষণ বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী ও নানা-নানীর ভরণপোষণের ব্যাপারেও জোর দিয়েছে। পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে পিতামাতার মতো ভরণপোষণ দিতে হবে।
আইনে কেউ অপরাধ করলে তা অবশ্যই আমলযোগ্য। এই আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলায় জামিনও পাওয়া যেতে পারে। মামলায় আপস-মীমাংসারও সুযোগ রয়েছে। অপরাধের অভিযোগ দায়ের ও বিচার হবে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। অপরাধের লিখিত অভিযোগ পিতা-মাতাকেই দায়ের করতে হবে। অন্যথায় আদালত তা গ্রহণ করবেন না। আদালত সংশ্লিষ্ট অভিযোগ আপস নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে প্রেরণ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে শুনানির সুযোগ দিয়ে তবেই নিষ্পত্তি করতে হবে এবং তখনই তা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হয়েছে বলে গণ্য হবে।
আইনে ভরণপোষণ অর্থ ক, খাওয়া-দাওয়া খ, বস্ত্র, গ, চিকিৎসা ঘ, বসবাসের সুযোগ-সুবিধা এবং সঙ্গ দেয়া। এ আইনের ৩ ধারা মতে, প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। একাধিক সন্তান থাকলে নিজেরা আলোচনা করে পিতামাতার ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ধারায় আরও উল্লেখ আছে, সন্তান পিতামাতার সাথে এবং একই স্থানে বসবাস করতে হবে। পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে কোনো বৃদ্ধ নিবাস বা অন্য কোনো স্থানে একত্রে বা আলাদা বসবাস করতে বাধ্য করা যাবে না। প্রত্যেক সন্তানকে পিতামাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান ও পরিচর্যা করতে হবে। পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তান থেকে পৃথকভাবে বসবাস করলে সন্তানকে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে। পিতামাতা সন্তানদের থেকে পৃথক বসবাস করলে সন্তান মাসিক বা বার্ষিক আয় থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা, ক্ষেত্র মতো উভয়কে দিতে হবে।
এ আইনের ৪ ধারার বিধান অনুযায়ী, সন্তান পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে ভরণপোষণ করবে। এ আইনের ৫ ধারা মোতাবেক পিতামাতার ভরণপোষণ না করলে অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে তিন মাসের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। ৫(২) ধারা মোতাবেক কোনো সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রমতে স্বামী, পুত্র-কন্যা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় ব্যক্তি পিতামাতা বা দাদা-দাদী বা নানা-নানীর ভরণপোষণ করতে বাধা দিলে বা অসহযোগিতা করলে তিনি অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং ওই দ-ে দ-িত হবেন।
আইনের ৭ ধারা মোতাবেক পিতামাতার লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে এ অপরাধের জন্য মামলা দায়ের করা যাবে। আইনে আপস মীমাংসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান, মেম্বার, কমিশনারদের আপস করে দেয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ আপস মীমাংসা আদালত কর্তৃক স্বীকৃতি দেয়ার বিধান আইনে রাখা হয়েছে।
মা-বাবা যখন বার্ধক্যে উপনীত হন, তখন তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার ওপর অর্পিত হবে; তা একটি যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর এ আইনে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। কার্যত সব পিতামাতাই সন্তানের মঙ্গল চান। কোনো পিতামাতাই সন্তানের বিরুদ্ধে যেতে চান না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি সন্তানের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য করে, তাহলে সন্তানের বিরুদ্ধে না যেয়ে আর উপায় থাকে না। অনেক সন্তান পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করে। আবার কোনো সন্তান যদি পিতামাতার ভরণপোষণ না করেন, তাহলে পিতামাতা এ আইনের মাধ্যমে ভরণপোষণের জন্য আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধণবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।