Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

শ্রমিক-শিক্ষার্থী মুখোমুখি

৩দিন ধরে অঘোষিত ধর্মঘট : হঠাৎ শ্রমিকরা মারমুখি

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান ছাত্র আন্দোলন ঠেকাতে দেশজুড়ে অঘোষিত বাস ধর্মঘট চলছে গত তিন দিন ধরে। দুদিন রাতে দুরপাল্লার বাস চললেও গতকাল শনিবার থেকে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের কোথাও বাস যাতে চলতে না পারে সেজন্য পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাধার সৃষ্টি করছে। তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নানাভাবে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। এর আগে সকালেও পরিবহন শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দিয়ে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরিবহন শ্রমিকদেরকে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর এই প্রচেষ্টাকে কেউই ভালো চোখে দেখছে না। ইতোমধ্যে গতকাল বিকালে ধানমন্ডিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নগ্ন হামলা চালানো হয়েছে। সবমিলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা চলছে। এ প্রসঙ্গে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা কেউ কারো মুখোমুখি নয়। ছাত্ররা আমাদেরই সন্তান। একইসঙ্গে শ্রমিকরাও আমাদের ভাই। প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত হলেই মালিকরা বাস চালানোর অনুমতি দেবে।
এদিকে, ঢাকাসহ সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় সারাদেশ অচল হয়ে পড়েছে। মানুষের ভোগান্তি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়ছে দেশের অর্থনীতি। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে।
পরিবহন মালিকরা জানান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্দেশে অঘোষিত এ ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। শুক্রবার রাতেই শাজাহান খান শনিবার থেকে গাড়ি চলবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পর দিন (গতকাল) থেকে উল্টো রাতের দুরপাল্লার বাসও বন্ধ করে দেয়া হলো। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, সড়কে আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। এ পর্যন্ত চার শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সে জন্যই রাস্তায় যানবাহন নামছে না।
গতকাল শনিবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, বগুড়া, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, বেনাপোলসহ দেশের অধিকাংশ জেলায় বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। ঢাকার চারটি বাস টার্মিনাল থেকে শুক্রবার রাতে কয়েকটি দুরপাল্লার বাস ছেড়ে গেলেও সকাল ৭টার পর পরিবহন শ্রমিকদের বাধার মুখে কোনো বাস আর ছাড়তে পারেনি। একইভাবে ঢাকার বাইরে থেকেও বাস ছাড়তে গেলে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের বাধার মুখে আটকে গেছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, তারা কোনো বাস চলতে বাধার সৃষ্টি করছেন না। চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলে কোনো গাড়িরই চলতে কোনো বাধা নেই। অনেকের মতে, ঢাকাসহ সারাদেশে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। সেই সাথে চালকদের লাইসেন্সও নেই। সেটাকে আড়াল করার জন্য মালিক-শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি নামাতে ভয় পাচ্ছে।
এদিকে, রাজধানীতে সিটি সার্ভিস বন্ধ থাকায় লাখ লাখ মানুষকে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। নগরীতে চলাচলের জন্য এখন ভরসা করতে হচ্ছে অটোরিকশা ও রিকশার উপর। গতকাল উবার বা ট্যাক্সিরও দেখা মেলেনি। গণপরিবহন সঙ্কটকে পুঁজি করে এক লাফে বেড়ে গেছে অটোরিকশা ও রিকশার ভাড়া। এদিকে, বাস বন্ধের কারণে চাপ বেড়েছে রেলওয়েতে। গত বুধবার থেকে ট্রেনে উপচে পড়া ভিড়ে যাত্রীদের কষ্ট বেড়েছে।
জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই ৯ দফা দাবির আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গত কয়েক দিন ধরেই পরিবহন শ্রমিকদেরকে উস্কে দেয়া হচ্ছে। গত শুক্রবার সকালেও পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রাবাড়ীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে গাড়ি চলাচলে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া বৃহস্পতিবার বিকালে মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায় পরিবহন শ্রমিকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই বিভিন্ন রুট কমিটির নেতা। চাঁদাবাজিই যাদের পেশা। বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা তুলে এরা পকেটে ভরে। পরিবহন মালিকরা এদের কাছে জিম্মি।
সায়েদাবাদ টার্মিনালের এক বাস মালিক জানান, পরিবহন শ্রমিকদেরকে অন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য নানা অপচেষ্টা চলছে। শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক ফেডারেশন মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন নস্যাৎ করতে চাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা শাজাহান খানের পদত্যাগ দাবি করায় পরিবহন শ্রমিকদের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে একপ্রকার লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওই মালিক বলেন, আমরা চাচ্ছি এর একটা সমাধান। এভাবে চলতে পারে না। শ্রমিকরা ফেডারেশনের জোরে যা ইচ্ছা তাই করবে- তা তো হতে পারে না। তাদের কারণেই তো আজকের এই দশা। তারা বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই প্রতিদিনই কোনো না কোনো মায়ের বুক খালি হচ্ছে। সন্তান হারিয়ে বাবা-মা বিলাপ করছে। বাবা হারিয়ে সন্তান এতিম হচ্ছে। তারা ঠিক হলে তো এতোটা দুর্ঘটনা ঘটতো না। আরেক মালিক বলেন, বেশিরভাগ শ্রমিকই নেশাগ্রস্ত। তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কারও কথা শুনতে চায় না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকালই গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা শহরের বাস চালকদের ৩৫ শতাংই নেশা করে। বাস মালিককদের সবচেয়ে বড় সংগঠনের এই নেতার কথায় বোঝা যায় শ্রমিকদের কাছে মালিকরা কতোটা অসহায়।
পূর্বঘোষণা ছাড়াই দুরপাল্লার বাস বন্ধ রাখায় আন্ত:জেলা টার্মিনালে গিয়ে বিপাকে পড়েছে মানুষ। গত ৬ দিনে রাজধানীতে অচলাবস্থার মধ্যে আটকে যাওয়া কাজ সারতে যারা বের হয়েছেন, তারাও পড়েছেন দুর্ভোগে। রাস্তায় নেমে বাস না পেয়ে বেশি টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। গতকালও সায়েদাবাদ টার্মিনালে বাসের জন্য কয়েকশ’ মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। সিলেটের যাত্রী মহব্বত হোসেন বলেন, সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছেন বাসের জন্য। কুমিল্লার যাত্রী শাহাবুদ্দিন আলী বলেন, সরকার ছাত্রদের আন্দোলন ঠেকাতে বাস বন্ধ করে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। শাজাহান খানের শ্রমিকরা নিজেদের দোষ আড়ালের জন্য এই কৌশল নিয়েছে।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা আন্দোলনের মুখে চলমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দূরপাল্লার সব বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাস মালিকরা। এ কারণে গতকাল থেকে নাইট কোচ চলাচলও বন্ধ করে দেয় হয়েছে। এতে করে শেষ ভরসার স্থল ছিল রাতের বাস। সেই সুযোগও আর থাকলো না।
অপরদিকে, রাজধানীতে সিটি সার্ভিসের বাসও চলছে না তিন দিন ধরে। রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, কাকরাইল, শাহবাগ, এলিফ্যান্ট রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, মিরপুর রোড, সাতমসজিদ রোড, কাওরানবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, জিয়া উদ্যান, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১, ১০ ও ১১, পল্লবী, কালশী, মগবাজার, প্রগতি সরণি, তেজগাঁও, নাবিস্কো, রামপুরা, বাড্ডা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, বিমানবন্দর সড়ক, খিলক্ষেত, উত্তরা ও আবদুল্লাহপুরের ব্যস্ততম সড়কগুলোতে তেমন সাধারণ যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। ভুক্তভোগিরা জানান, আগের দিন মাঝে মধ্যে দু’একটি বাসের দেখা মিললেও গতকাল কোনো বাসের দেখা মিলেনি। এ কারণে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। কুড়িল এলাকা থেকে মতিঝিল এলাকায় আসা জুয়েল নামে একজন যাত্রী বলেন, আমি ৫০ টাকা দিয়ে রিকশা নিয়ে বাড্ডা পর্যন্ত এসেছি। এরপর একটি পিকাপভ্যানে ২০ টাকা দিয়ে রামপুরা পর্যন্ত এসেছি। তারপর ২০ টাকা দিয়ে এক বালুর ট্রাকে চড়ে কমলাপুর পর্যন্ত এসেছি। মিরপুর থেকে ৭শ’ টাকা দিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটে মতিঝিল এসে আনোয়ার নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, গণপরিবহন সঙ্কটে অটোরিকশা আর রিকশাওয়ালারা মানুষের গলা কাটতে দ্বিধা করছে না। সরকারে উচিত মানুষের এই দুর্ভোগ লাঘবে এক্ষুণি ব্যবস্থা নেয়া।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ