Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদালতের নির্দেশ অমান্য

সড়ক দুর্ঘটনায় মামলায় ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না নিহতের পরিবার

মালেক মল্লিক : | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

প্রতি দিনই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হার। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই একের পর এক সড়ক দূর্ঘটনার নিত্য দিনের চিত্র। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ২ হাজার প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এইসব দুর্ঘটনার প্রতিরোধ ও চালকের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে। আবার কোনটি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। এরপর শুরু হয় বিচার কার্যক্রম। শুনানি শেষে আর আদালত ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিলেও বছরের পর বছর ধরে চলে সেই মামলা। আবার কোনটি রায় হলেও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না নিহতের পরিবার। ১৯৯১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবার আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন। নিন্ম আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের রায় দেন। ২৫ বছর পর ২০১৬ সালে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি সংশ্লিষ্ট পরিবার।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনার নজরে আনার পর ক্ষতি পূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এই সব আদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন আইনজীবীরা। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকদের জন্য শাস্তির বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন। একইসঙ্গে আইনের কঠোর প্রয়োগের তাগিদ দেন তারা। আদালতের আদেশ থাকা সত্তে¡ও নিহতের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না বিষয়ে জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রহুল কুদ্দুস কাজল ইনকিলাবকে বলেন, আদালতের আদেশ থাকার পর ক্ষতিপূরণ না দেয়াটা দুঃখজনক। এক্ষেত্রে আমি মনে করি আদালতের রায়ের সময় কত দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা নিধার্রণ করে দিলে এমন হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত ৩০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক। এসময় তিনি ট্রাফিক আইন পরিবর্তনের বিষয়ে কথা বলেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ট্রাফিক আইন পরিবর্তন করা দরকার। একইসঙ্গে আইন কার্যকর করার দিকেও গুরুত্ব দেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক বলেন, দুর্ঘটনা কী পরিমাণে বেড়েছে! কারও হাত চলে যাচ্ছে, পা চলে যাচ্ছে, মাথা চলে যাচ্ছে। এভাবে কোনো সভ্য দেশ চলতে পারে না। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৪ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৪০০ টাকা জরিমানা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে কেউ লাইসেন্স নেয়ার তেমন গরজ বোধ করবে না বলেও মনে করেন তিনি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, শতকরা ২০ ভাগ ঘটনায় মামলা হয়। তবে যেসব ঘটনায় মামলা হয় তার মধ্যে ৯৯ ভাগ কোনো না কোনো তদবিরে ছাড় পেয়ে যায়। বাকি ১ ভাগ এর শাস্তি শেষ পর্যন্ত নানা অদৃশ্য কারণে বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাস্তবায়ন হয় না। নিরাপদ সড়ক চাই এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি জানুয়ারী মাস থেকে জুন পর্যন্ত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার পাঁচশ ৪৯ টি। এতে আহত হয় ৩ হাজার আটশ ৩১ জন। নিহতের সংখ্যা ১ হাজার আটশ ৮৩ জন।
সর্বশেষ গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও মীম নিহত হন। এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল রিট করলে দায় নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, দুর্ঘটনার জন্য কার কতটুকু দায় তা নিরূপণ করে দুই মাসের মধ্যে ওই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর আগে ৭ দিনের মধ্যে নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ১০ লাখ ক্ষতি পূরণ দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে তাদের পরিবারকে ২ কোটি টাকা করে কেন ক্ষতি পূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবেনা, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এর আগে গত ১৭ মে খিলগাঁওয়ের প্রকাশনা ব্যবসায়ী নুরুল আমিনের ডান পা ছয় নম্বর বাসের চাপায় থেঁতলে হাঁটুর নিচ থেকে মাংসপেশি খসে পড়ে যায় নুরুল আমিন চৌধুরী। বিষয়টি নিয়ে রিট দায়ের করলে ১০ জুন দেড় কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ ঘটনায় দায় ও ক্ষতিপূরণ নিরুপণে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেয়া হয়।
এছাড়াও বেপরোয়া গতির বাসের চাপায় নিহত ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী নাজিম উদ্দিনের পরিবারকে কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। ২২ মে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। এর আগে ১৭ মে শ্রাবণ সুপার ও মনজিল নামের দুটি বাসের রেষারেষির মধ্যে শ্রাবণ বাসের চাপায় নাজিম উদ্দিন নিহত হন। দুই বাসের চাপায় গত ৩ এপ্রিল হাত হারানোর পর মারা যাওয়া কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের ঘটনায় দায়ীদের ক্ষতিপূরণ নিরূপণ করতে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের মালিককে নির্দেশ দেন। কিন্তু বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন আপিল করলে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করা হয়।
এর আগে ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীরসহ ৫ জন। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বাস মালিক, চালক ও বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। গত বছরের ৩ ডিসেম্বরে তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। রায়ের বিরুদ্ধে বাস মালিকপক্ষ আপিল দায়ের করে। যা শুনানির জন্য আগামী ৮ অক্টোবর দিন ধার্য রয়েছে।
এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলার ক্ষেত্রে প্রথম নিষ্পত্তি হয় একটি জাতীয় দৈনিকের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর। ১৯৮৯ সালে রাজধানীর শান্তিনগরে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন তিনি। তার স্ত্রী ১৯৯১ সালে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিন্ম আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের রায় দেন। ২৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নিন্ম আদালতের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ২০১৬ সালে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেন। তবে এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি মন্টুর স্ত্রী রওশন আরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ