Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্বাচনের বছর ‘সংযত’ মুদ্রানীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০১ এএম

বেসরকারি খাতে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি রেখে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে হিসেবে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। বরাবরের মতো এবারও নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার আগে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেষ্টা এস কে সুর চৌধুরী, ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান, আহমেদ জামালসহ প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭.৬০ শতাংশে। আগের মাস এপ্রিল শেষে যা ছিল ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। স¤প্রতি বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ প্রবৃদ্ধি হয় গত বছরের নভেম্বরে। ওই মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কাক্সিক্ষত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বাজারে কী পরিমাণ টাকা ছাড়া হবে, তার একটি ধারণা দিতে প্রতি ছয় মাসের আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত জানুয়ারিতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এই বছরের জুনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয় ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, গত মে পর্যন্ত বেসরকারি খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৯২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। আগের বছরের মে শেষে যা ছিল সাত লাখ ৫৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এতে এক বছরে ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর নতুন মুদ্রানীতিতে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৯২৩ দশমিক ৩০৪ কোটি টাকা।
সামগ্রিকভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, যা জানুয়ারি-জুলাই মেয়াদের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশের চেয়ে বেশি।
গভর্নর ফজলে কবির এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বলেন, আগের ধারাবাহিকতায় প্রবৃদ্ধিবান্ধব এবং একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখার লক্ষ্যে সংযত ধরনের মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়েছে। গভর্নর বলেন, নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক আট শতাংশ, সরকারি খাতে ১০ দশমিক চার শতাংশ।
এক প্রশ্নের উত্তরে ফজলে কবির বলে, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি যদিও গতবারের মুদ্রানীতির মত ১৬ দশমিক আট শতাংশ ধরা হয়েছে, কিন্তু সরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের চাহিদা কম থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণের উচ্চতর প্রবৃদ্ধি হওয়ার সুযোগ থাকবে।
মুদ্রানীতিতে বিধিবদ্ধ জমার (কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ জমা রাখার হার) অনুপাত বা সিআরআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তহবিল আহরণের রেপো সুদের হারও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
বর্তমানে সিআরআর আছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। রেপো সুদের হার ছয় শতাংশ। ব্যাংকগুলোর অর্থ সংকট কাটাতে গত এপ্রিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত সিআরআর ও রেপোর হার কমিয়ে আনে। গভর্নর বলেন, আগের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ, তা অর্জিত হয়নি। এ বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ জন্যই মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাবাচন সামনে রেখে সংযত মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে কিনা-এ প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান বলেন, সরকার বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্য ধরেছে, তা বাস্তবায়নে সহায়তা করতেই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
গত অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল সাত দশমিক চার শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশে আটকে রাখার আশা করা করা হয়েছিল।
অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাত দশমিক ৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। আর পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল পাঁচ দশমিক ৫৪ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
সরকার চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে সাত দশমিক আট শতাংশ; আর গড় মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশে আটকে রাখার আশা করছে। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ঘোষিত আর্থিক নীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতি অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোনা গরমিল প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা (কাস্টমস) বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে যেভাবে সোনা জমা দিয়েছে সেভাবেই আছে। ফজলে কবীর আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ছয় স্তরের নিরাপত্তা রয়েছে। ৪২টি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা মনিটরিং করা হয়। তাই, কাস্টমস যেভাবে জমা রেখেছিলো সোনা সেভাবেই আছে।
গভর্নর বলেন, ব্যাংকের সুদের হারের সাথে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমিয়ে আনা হবে। একই সঙ্গে বিদেশে যেন টাকা পাচার না হয় সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং সেল। এছাড়া, এডিআর সংশোধনের বিষয়ে বলেন, অর্থনীতির সুবিধার জন্য এডিআর সংশোধন করা হয়েছে। তবে বাজারে যথেষ্ট নগদ টাকার প্রবাহ আছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, শেয়ার বাজারের জন্য এখন ইতিবাচক সময় চলছে।
এদিকে ডেপুটি গভনর্র আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান জানান, চলতি ছয় মাসে চার হাজার কোটি টাকা পাচারের সুনিদির্ষ্ট তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেয়া হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া, রিজার্ভের সব টাকাই আইনিপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেরত আনা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন মুদ্রানীতিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। কারণ, এই বছর জাতীয় নির্বাচনের কারণে কালো টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল গত অর্থবছরের (জানুয়ারি-জুন) দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে। এছাড়া ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্রারিক্ত বাড়ার কারণে ঋণের লাগাম টেনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণ আমানত অনুপাত কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে ব্যাংকগুলোর চাওয়া অনুযায়ী নতুন এ হার কার্যকরের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
এদিকে ঘোষিত মুদ্রানীতি পুঁজিবাজার স¤প্রসারণ তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখবে বলে মনে করছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ডিএসইর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। গতকাল ডিএসইর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অভিনন্দন জানানো হয়।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে পুঁজিবাজারকে কর্পোরেট গ্রাহক ও প্রবাসী বাংলাদেশির কাছে আরও গ্রহণযোগ্য ও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার প্রয়াসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ ব্যাংককে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছে। মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমর্থনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের স¤প্রসারণ তথা সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখবে। এতে বলা হয়, গত অর্থবছরের শেষের দিকে ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ জমার অনুপাত বা সিআরআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রোপ সুদহার কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া সরকারি সংস্থার তহবিল বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহে উন্নতি হয়।
মুদ্রানীতিতে তারল্য প্রবাহ উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিবস্থার সহায়তার প্রতি জোর দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, স¤প্রতি চীনের কনসোর্টিয়াম সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর কৌশলগত বিনিয়োগকারী হয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। আর্থিক ব্যবস্থার প্রবৃদ্ধির ভারসাম্যের জন্য বন্ড মার্কেটকে আরও বৃহত্তর ভ‚মিকা রাখতে হবে যা বাংলাদেশ বিনিয়োগ এবং প্রবৃদ্ধির গতিপথকে উন্নিত করবে।###



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুদ্রানীতি

৩০ জানুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ