ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
বর্ষা মৌসুমে কাঠফাটা রোদ আর প্রচন্ড গরমে জীবনযাত্রা প্রায় স্থবির। বিষয়টি মোটেও সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। প্রতিদিনই তাপমাত্রা বাড়ছে। ঘনঘন বৃষ্টি ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আপাতত কোনো উপায় দেখছি না। মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হলেও কমছে না তাপমাত্রা। আমরা জানি, এ সময়ে সাধারণত বছরের অন্য সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা একটু বেশিই থাকে। কিন্তু এতটা বেশি কখনই দেখা যায় না। দেশে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে; তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না।
আমি ঢাকা শহরে কয়েক বছর ধরেই বসবাস করছি। কিন্তু ১৯ জুলাইয়ের মত তীব্র গরম কোনো দিন লক্ষ করিনি। বলা চলে, তীব্র তাপদাহে রাজধানী ঢাকা পুড়ছে। বাসা থেকে বের হলেই তেজদীপ্ত সূর্যকিরণ আক্রমণ করছে। ছাতা ভেদ করে সূর্যরশ্মি শরীরে লাগছে। ঘরের ভেতরেও শীতলতা নেই। ফ্যানের বাতাস ছাড়া প্রকৃতির বাতাস যেন ঘরে পাওয়া দুষ্কর। খবরে পড়লাম, ১৯ তারিখে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৩৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছিল। শুধু কি তাই, বৃষ্টিহীন দিন হওয়ার কারণে বাতাসে জলীয়বাষ্পের আর্দ্রতাও বেশি ছিল। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি থাকা মানে তাপমাত্রার চেয়ে তীব্র গরম অনভ‚ত হওয়া, বৃষ্টিপাত না হওয়া। পরিবেশের উপর বাতাসের এমন বৈরী আর্দ্রতা কিসের ইঙ্গিত দিয়ে যায়, তা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি?
বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপর দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের যোগসূত্র আছে। যখন বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের সৃষ্টি হয়, তখন দেশে বৃষ্টিপাত অনেকাংশে কমে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তরও এমনটাই বলছে। কিন্তু এমন বৃষ্টিহীন অবস্থা দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে থাকলে পানি শূণ্যতায় দেশ অচিরেই মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে। বর্ষাকাল, অথচ নেই পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, রোদের প্রখরতা বেশি, অসহনীয় রকম তাপমাত্রা আর নদী-নালা, খাল-বিলে পানি স্বল্পতা। যথাসময়ে নদীতে পানি না এলে বর্ষাকাল যেমন বিলম্বিত হবে, আবার দীর্ঘও হবে। নি¤œাঞ্চলের কৃষকেরা চরম ভোগান্তিতে পড়ে যাবে। তারা যথাসময়ে চাষাবাদ করতে পারবে না। মৌসুম ছাড়া ফসল আবাদের কারণে ফসলের ফলন কম হবে। দেশে দ্রব্যমূল্য অধিকহারে বেড়ে যাবে। দরিদ্র জনপদগুলোতে অভাব দেখা দেবে। দুর্ভিক্ষ যে লাগবে না, তার নিশ্চয়তা কি!
বিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। এটি অনেক পুরনো খবর। কিন্তু নতুন খবরও আমাদের জানা দরকার। পৃথিবীর মানচিত্রে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ তথা আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তাপমাত্রার পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই সাথে চরম বৃষ্টিহীনতা দেখা দিতে পারে। আমরা জানি, বৃষ্টি হওয়ার পিছনে অনেকাংশেই পৃথিবীপৃষ্ঠে সূর্যের উত্তাপের জমাটবদ্ধতা দায়ী। কিন্তু বর্তমানে এ জমাটবদ্ধতার মাত্রা অনেক কম। এছাড়া ভূপৃষ্ঠ থেকে সৌরকিরণের বিকিরণও বৃষ্টি হতে সাহায্য করে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের অতি উচ্চতাসম্পন্ন এলাকাগুলোতে মেঘের জমাট বাঁধার কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, গত কয়েক দশক ধরে মেঘের গতিবিধিতে বেশ কিছুটা হেরফের হচ্ছে যা বৃষ্টিপাতের পরিমাণেও তারতম্য ঘটাচ্ছে। এসব কারণে বৃষ্টিপাত কমছে। বিপরীতে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে।
এভাবে ক্রমশ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ও বৃষ্টিপাত কমাটা জলবায়ুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। যেহেতু জলবায়ুর বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদের প্রসঙ্গ; তাই এই প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে বৃষ্টিপাতই আমাদের প্রাণীকুলের ভরসা। আবার যেহেতু বৃষ্টিপাত নাই; তাই এর প্রতিকারের জন্য জনসচেতনতা ছাড়া বিকল্প কোনো পথও দেখছি না। প্রকৃতির এমন বিরূপ আচরণে মানুষের সরাসরি কোনো হাত নেই সত্য। এমন অবস্থা প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও কারও নেই। বস্তুত মনুষ্য সৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানা কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুর আচরণ বিরূপ হতে চলেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারণা করা যায়, এটি কার্বন বৃদ্ধিজনিত জলবায়ু পরিবর্তনেরও একটি প্রভাব। প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক অবস্থায় না রাখার কারণে এমন বিরূপ আচরণ শুরু করেছে। অথচ আমরা মনুষ্যজাতি ভবিষ্যৎ পরিণাম না ভেবেই নির্বিচারে গাছপালা কেটে চলেছি, বন-জঙ্গল উজাড় করে অনিরাপদ শিল্পকারখানা, ইটভাটা তৈরি করছি।
দৃশ্যতঃ আমরা এটা উপলদ্ধি করতে পারছি যে, তাপমাত্রা যথাসম্ভব কমিয়ে আনতে এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ার জন্য আমাদেরই কিছু করতে হবে। আমাদের জীবনে যেমন প্রাত্যহিক অভ্যাসগত পরিবর্তন আনতে হবে, তেমনি সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেমন- বৃহত্তর বনায়ন কর্মসূচী নিতে হবে। দেশের বিদ্যমান বনাঞ্চল সংরক্ষণ করতে হবে। বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। (খবরে পড়লাম- মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদদের স্মরণে দেশব্যাপী ত্রিশ লাখ বৃক্ষরোপণের কর্মসূচী সরকার হাতে নিয়েছে। সরকারের এমন প্রসংশনীয় উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই।), কৃষিকাজে পরিমিত মাত্রার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পাশাপাশি জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি প্রযুক্তি অবলম্বন, চারণ ও তৃণভূমি সংরক্ষণ, ফসলের ক্ষেতের আইলে বৃক্ষরোপণ, উপক‚লীয় জলাভূমি ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সংরক্ষণ করাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবী। আশা করা যায়, উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়ার মাধ্যমে আমরা অচিরেই এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব। গাছপালার আধিক্যে তখন বৃষ্টিপাতও আশানুরূপ হবে। প্রকৃতিতে শীলতা বিরাজ করবে। প্রাণীকুলও সংরক্ষিত থাকবে।
পরিতাপের বিষয় হল, সরকার দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবনের কাছে একটি ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে! তাছাড়া এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যেই হুমকীর সম্মুখীন দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার স্থানীয় অধিবাসীর জীবিকাকে ধ্বংস করবে। আইপিসিসি’র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে এদেশের দক্ষিণাাঞ্চল (যেখানে দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশের বসবাস) সম্পূর্ণভাবে বসবাসের অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। পরিবেশবাদীরা এ নিয়ে অনবরত আন্দোলন করে যাচ্ছে, বিশ^ জনমত তৈরি করছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নিয়ে তাদের গৃহিত সিদ্ধান্তে অটল আছে। এভাবে যদি সর্বত্র পরিবেশের উপর আঘাত হানা হয় তাহলে কি আর পরিবেশ পরিস্থিতি অনুক‚লে থাকে? সুতরাং এখনই সচেতন হওয়ার সময়। নয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেওয়ার কারণে এই পৃথিবী আমাদের ক্ষমা করবে না!
আমরা জানি, গরমে দেহ হতে ঘাম ঝরে; ফলে পানির চাহিদা প্রচুর পরিমানে বেড়ে যায়। শরীর থেকে লবণ জাতীয় পদার্থ নিঃসরণ হয়। কিন্তু নিরাপদ পানির সংকটময় এদেশে বিশুদ্ধ পানি না পাওয়ায় যত্রতত্র পানি পানে মানুষজন পানিবাহিত রোগ- ডায়রিয়া, কলেরা, জন্ডিস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা। পানিবাহিত এই রোগে আক্রান্তদের একটা বড় অংশ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। পরিবেশগত কারণে তারা দূষিত পানির শিকার। আবার গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার খাওয়াও এ জন্য দায়ী। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। বর্তমান উষ্ণতর পরিস্থিতি এক দিনে রোধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী নানা পদক্ষেপ। সেই সাথে প্রয়োজন জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা করা।
লেখক: পরিবেশবাদী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।