হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
অনেকে ধর্ম পালন করে, অনেকে পালন করে না, আবার অনেকে ধর্ম বিশ্বাসই করে না। একদল লোক রয়েছে যারা ধর্ম আছে কি নাই এ মর্মে চিন্তাভাবনাও করে না। নানা রকম ভেদ-বিভেদে আছে এ পৃথিবীর মানুষ। মানুষ তার নিজ ধর্ম ছাড়াও অনেক কিছু করে যা ধর্মের সাথে সাংর্ঘষিক। অন্যদিকে নিজ নিজ বিশ্বাস তথা ধর্মের অনুশীলন থেকে এক চুল পরিমাণ পিছাবে না এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। নিজ নিজ ধর্মেও দল, উপদলে বিভক্তি অনেক। এমন কোন ধর্ম নাই যেখানে অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি হয় নাই। ফলে এ বিভক্তিতে যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত ঘটেছে। বিভক্তির কারণে একই মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ার পরও একে অপরকে খুন করছে দুনিয়া ও পরকালে গৌরবান্বিত হওয়ার প্রত্যাশায়। ধর্মীয় অর্ন্তদ্ব›দ্ব ও বিবাদ অনেক নির্মম ও মর্মান্তিক। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-কে ফোরাত নদীর তীরে পানিবিহীন অবস্থায় নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল মুসলমান নামধারী ইয়াজিদ। হিন্দু ধর্মের মধ্যে উঁচু-নীচু বর্ণ বিদ্বেষ অনেক বেশি। ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও তার স্ত্রী সবিতা কোবিন্দ নি¤œজাতের হিন্দু হওয়ার কারণে উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরে উচ্চজাতের উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা হেনস্থার শিকার হয়েছেন। খ্রিস্টান ধর্ম ক্যাথলিক ও প্রটেস্টেন্ট দুই ভাগে বিভক্ত হলেও যথেষ্ট পরিমাণ উপদল রয়েছে। জীব হত্যা মহাপাপ বৌদ্ধ ধর্মের মূলমন্ত্র। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধরা মুসলমানদের অকাতরে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ করে যাচ্ছে, অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখানে ধর্ম তাদের নিকট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় না। কার্যত মনে হচ্ছে যে, মিয়ানমারের মুসলমানরা জীব বা প্রাণি নয়! কোন ধর্মকে ছোট করে দেখার অবকাশ নাই। তবে নিজ ধর্ম সঠিকভাবে পালন করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্চনীয়।
প্রবাদ রয়েছে যে, রণে-বনে প্রেমের কোন নীতি বা ধর্ম নাই। রণে (যুদ্ধে) জয় লাভের জন্য যা করা দরকার তাই তখনকার ধর্ম, বনে (জঙ্গলে) বেঁচে থাকার প্রয়োজনে যা করা দরকার তাই ধর্ম এবং প্রেমে আত্মতৃপ্তি পাওয়াই ধর্ম। অন্য প্রবাদ রয়েছে, সব ধর্মই ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু প্রেম, ভালোবাসার কোন ধর্ম নাই, প্রেম, ভালোবাসা বড়-ছোট, জাত-বিজাত, বাদশা-ফকির মানে না। এতো গেল মানব জাতির কথা যারা পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা হিসেবে পরিচিত। শুধু মানুষই কি ধর্ম পালন করে? নাকি প্রতিটি সৃষ্টি বা প্রাণি বা বস্তুর নিজস্ব ধর্ম রয়েছে?
কাঠের ধর্ম নিজে পোড়া, আগুনের ধর্ম অন্যকে পোড়ানো। ঐশ্বরিক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কুকুরের ছোঁয়া লাগলে পবিত্রতা নষ্ট হয়। অন্যদিকে কুকুরকে কোলে নিয়ে ঘুরে বা বিছানায় জায়গা দেয় এমন জনগোষ্ঠিও রয়েছে। মানুষ সৃষ্টির সেরা, কিন্তু ‘বিশ্বস্থতার’ প্রশ্নে মানুষের চেয়ে কুকুর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। কুকুর মনিবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু মানুষ বিশ্বাসভঙ্গ করেছে যার প্রমাণ রয়েছে ভ‚ড়ি ভ‚ড়ি। বিশ্বস্থতার চেয়ে বিশ্বাসভঙ্গের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবে বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি ভালো হয় নাই। মীর জাফরের মৃত্যু হয়েছে কুষ্ঠ রোগে, তার পুত্র মীরনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে, রবার্ট ক্লাইভ আত্মহত্যা করেছিল, মানুষ যাদের ঘৃণাভরে স্মরণ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, আচরণের কারণে কুকুরের চেয়ে মানুষ নিকৃষ্ট হয়ে যায়। তবে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহ এক কথা নয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে প্রকাশ্য বিরোধিতার নাম বিদ্রোহ, অন্যদিকে সাথে থেকে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য গোপনে বিরোধিতা করার নাম বিশ্বাসঘাতকতা। দেশে দেশে, গ্রামে-গঞ্জে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, এমন কি পারিবারিক পর্যায়েও চলছে বিশ্বাসঘাতকতার হিড়িক, যার পরিণাম প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধ, খুন আর খুন।
পুলিশ ও আমলাদের ধর্ম কি হওয়া উচিৎ? গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এবং ২১(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ পুলিশ ও আমলারা কি সেবার মনোভাব নিয়ে কাজ করার মানসিকতা প্রমাণ করতে পেরেছে? মোটা দাগে পুলিশ ও প্রশাসনের ধর্ম কী? বাস্তবতার নিরিখে যদি বলতে হয় তবে বলতে হবে পুলিশ ও আমলারা ‘শক্তের ভক্ত, নরমের জম’। আপনি যদি কোন পুলিশ বা আমলার শরনাপন্ন হন, তখন দেখবেন কত ধানে কত চাল?
সকল মানুষই এই রাষ্ট্রের নাগরিক যার মর্যাদা, সম্মান, অধিকার, প্রভৃতি সংবিধান ও আইন দ্বারা সংরক্ষিত ও নিশ্চিত। তদুপরি সংবিধানই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বিবেচিত। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।’ এ সত্তে¡ও কোন নাগরিক তার ন্যায্য অধিকার রক্ষা বা প্রাপ্তির জন্য যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোন আমলার শরনাপন্ন হয় তবে তাকে হেনস্থা হতে হবে যদি তার টাকা দেয়ার মানসিকতা না থাকে বা মামা, খালু বা কোন আত্মীয়ের রেফারেন্স না থাকে বা যদি না সে সরকারি দলের লোক না হয়। নাগরিকের ন্যায্য অধিকার পেতে হলে খুঁটির জোর থাকতে হবে, খুঁটির জোরবিহীন নাগরিকদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে সংবিধান ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন পুলিশ এবং আমলারা দুইভাবে প্রয়োগ করে। যার খুঁটির জোর নাই আমলাতন্ত্র তাকে জুতার শুকতলী মনে করে। পক্ষান্তরে যার খুঁটির জোর আছে তাকে একই বিষয়ে পদলেহন করে তরিৎ গতিতে চাহিদা পূরণ করে দেয়। অতএব, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের ধর্ম যখন যেমন তখন তেমন। একই বিষয়ে কাউকে লাথি মারে, আবার কাউকে মাথার মুকুট বানিয়ে কুর্নিশ করে। খুঁটিওয়ালা ও টাকাওয়ালাদের জন্য বাংলাদেশ একটি স্বর্গরাজ্য, আর খুঁটিবিহীনদের জন্য নরক। আমলাদের এ ধর্ম উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত।
কী আর্শ্চয, এ দেশে জলজান্ত ঘটনাকে কথিত বুদ্ধিজীবিরা মিথ্যার আবরণে অনর্গল বলে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ মিথ্যা শুনতে শুনতে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিকারের প্রত্যাশা করে না। কথিত আছে যে, এ দেশে সকল বিকাল জোয়ার ভাটা হয় বলে বাদশা জাহাঙ্গীর (যার নামানুসারে জাহাঙ্গীর নগর) ঢাকা প্রবেশ না করে মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন ষাটনল থেকে বজরা (বিলাস বহুল পানসি নৌকা) দিয়ে দিল্লীতে ফিরে যান। একটু সুযোগ সুবিধার জন্য বুদ্ধিজীবিদের রং পরিবর্তন, মিথ্যাকে সত্যে রূপান্তর, অধিকন্তু জনগণকে বোকা মনে করে ধোকা দেয়া এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। জাতি এখন আর আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। রক্ষকই যেখানে ভক্ষক হয় এবং রক্ষক যখন সব কিছু নিজের মত করে গিলে ফেলার ‘ধর্ম’ গ্রহণ করে তখন জাতি আশ্রয় নেবে কোথায়?
গাছের জীবন আছে, একথা স্বীকৃত। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে যে, গাছ আল্লাহকে সেজদা করে। স্যার জগদীস চন্দ্র বসু গবেষণা করে বলেছেন যে, গাছের প্রাণ রয়েছে। পানির অপর নাম জীবন, পানি মানুষের জীবন রক্ষা করে, কিন্তু পানির জীবন বা প্রাণ আছে কি না তা কেউ এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন কি না জানা নাই। তবে পানির একটি নিজস্ব ধর্ম হলো, পানি বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণা করে না, যদি না পানির সাথে কেউ প্রতারণা (দূষিত) করে। অথচ সৃষ্টির সেরা মানুষের একটি প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা, যার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই। দিন যত যাচ্ছে, মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, বিজ্ঞান যত এগিয়ে যাচ্ছে ততই জ্যামেতিক হারে প্রতারণার রকম/আকার/পরিধি/পদ্ধতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বিপাকে রয়েছে সরল-সোজা জীবন যাপনে অভ্যস্থ মানুষগুলি।
‘ক্ষমতার’ ধর্ম কী? ক্ষমতার অনেক ধরন রয়েছে, কিন্তু এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো ‘অন্ধত্ব’। ক্ষমতার অন্ধত্বের কারণে যাদের আশ্রয়দাতা হওয়ার ছিল তারাই হয়ে যান শ্রেষ্ঠ নির্যাতনকারী। প্রতিপক্ষকে সহ্য করতে না পারাও ক্ষমতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতা খালি চোখে দেখা না গেলেও এর অ্যাকশন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। সম্প্রতি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীদের যখন পুলিশের বুটের নিচে দেখা যায় তখনই বুঝতে হবে যে, ক্ষমতার ধর্ম ও রং কী ও কত প্রকার? ‘রাজার’ বিরুদ্ধে কথা বললেই অপরাধ, লিখলেতো অপরাধের শেষ নাই। তখনই বুঝা যায় ক্ষমতার রূপ বা চেহারা কী হতে পারে, যেমনটি বুঝে ছিলেন সক্রেটিস। রাজনীতিক, কর্ণধার, সুশীল সমাজ, নেতা, পাতি নেতাদের মঞ্চের বক্তব্য ও ব্যক্তিজীবন মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে আকাশ পাতাল ফারাক। অনেক ক্ষেত্রে মঞ্চের বক্তব্যে যতটুকু শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়, ব্যক্তি চরিত্র জানতে পারলে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা জন্মে।
ধর্মের সাথে প্রকৃতির সামঞ্জস্য রয়েছে। শুধু প্রকৃতি এবং একমাত্র প্রকৃতিই ধর্ম পরিবর্তন করে না। প্রকৃতি দয়া করে, লালন-পালন করে, কিন্তু প্রকৃতির ধর্ম কঠিনভাবে প্রতিশোধ নেয়া, প্রকৃতি প্রতিশোধ পরায়ন এবং প্রতিশোধ গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর। প্রকৃতিকে ইট দিয়ে আঘাত করলে পাটকেল দিয়ে জবাব দেয়, তাও খুব নির্মমভাবে। ‘প্রকৃতি’ নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেয় মানুষের কর্মফলের।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।