Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

গডফাদার-কারবারি অধরা

২৫ হাজার ৫৭৫ মামলা, নিহতের সংখ্যা ২১০ ছাড়িয়েছে, ৩৭ হাজার ২২৫ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

সাখাওয়াত হোসেন : | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

দেশব্যাপী আইন-শৃংখলা বাহিনীর মাদকবিরোধী সাড়াশি অভিযান চললেও মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষক ও বড় কারবারীরা বহালতবিয়তে। গত ১৮ মে থেকে পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত অন্তত নিহতের সংখ্যা ২১০ জন ছাড়িয়ে গেছে। এ যাবত ৩৭ হাজার ২২৫ জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৫ হাজার ৫৭৫টি নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে মাদক বিরোধী অভিযান চলার সময়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। 

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সারাদেশব্যাপী চলমান এ অভিযানে এখনো বড়মাপের কোনো মাদক কারবারীর গডফাদার কিংবা পৃষ্ঠপোষক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়েনি। বিভিন্ন জেলা পর্যায় থেকে এসব গডফাদার ঢাকায় ও রাজধানীর তালিকাভুক্ত ব্যক্তিরা ঢাকার বাইরে অবস্থান করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।
গত ১৮ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অনেককে সাজা দেয়া হয়েছে। চিহ্নিতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যার কারণে মাদকবিরোধী অভিযান অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে কারাগারে আছে ৮৯ হাজার ৫৮৯ জন, তার ৪২ শতাংশই মাদকবিরোধী অভিযানে ধরা পড়েছে। এ যাবত ৩৭ হাজার ২২৫ জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযান কতোদিন চলবে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা যতোদিন সম্পূর্ণভাবে নিরসন না করা যায়, ততোদিন পর্যন্ত চলবে। তিনি বলেন, মাদকের পাচার রোধে বিজিবি সতর্কাবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মূল ব্যাপার আইন-শৃঙ্খলাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং মাদক নিরসন। যেটার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও জিরো টলারেন্সের কথা বারবার বলছেন। আমরাও মনে করি দেশকে যেভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সে থেকে উত্তরণের জন্য মাদকবিরোধী অভিযান অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে এগিয়ে যাক, তার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি। কক্সবাজারের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, প্রমাণ পেলে তাকেও ছাড়া হবে না।
তবে পুলিশ ও র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারার দাবি করছেন, অভিযান শুরুর পর পালিয়ে বেড়ানোর কারণে মাদক কারবারীর পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বড় মাপের মাদক কারবারী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। মাদকের গডফাদার কিংবা পৃষ্ঠপোষকরা রেহাই পাবে না। মাদকের সাথে জড়িতরা পর্যায়ক্রমে আইনের আওতায় আসবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাদক বিরোধী অভিযানে যারা সরাসরি মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তারা ধরা পড়ছে বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে। এসব ঘটনা মামলা হচ্ছে। কিছু কিছু মামলা পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব তদন্ত করছে। তদন্তে অর্থলগ্নিকারী ও যারা এর নেপথ্যে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সবার আইনের আওতায় আসবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে থাকা তালিকায় টেকনাফের ৬০ গডফাদারের অনেকে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তারা তাদের পৃষ্ঠপোষক শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে আশ্রয় পাচ্ছে। মাদকের প্রতি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকরাও নিজেদের আড়াল করে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। গোয়েন্দাদের হাতে রাজধানীসহ সারাদেশের ১০২ জন বড় মাপের মাদক কারবারীদের পৃষ্ঠপোষকের নামের তালিকা রয়েছে। রাজধানীকে মাদকের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে তারা। টেকনাফ থেকে কক্সবাজার হয়ে সরাসরি মাদক ঢাকায় চলে আসার ক্ষেত্রে এসব পৃষ্ঠপোষকরা সহযোগিতা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সড়ক পথের পাশাপাশি নৌপথ দিয়েও রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে মাদক পৌঁছায়। ওই সূত্র আরো জানায়, রাজনীতিক, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থাকা ওই পৃষ্ঠপোষকরা খুবই ক্ষমতাধর। মাঠ পর্যায়ের মাদকের টাকা থানার কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনীতক ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের পটেকে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ৪৩টি পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী প্রায় ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগর পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আমদানি করা গাছের মধ্যে খোড়ল কেটে ও মাছের প্যাকেটের মধ্যে ইয়াবা আনা হয়। ইয়াবার এই ৬০ জন গডফাদারের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা জড়িত। ওই সকল কর্মকর্তা এসব গডফাদার থেকে নিয়মিত পাচ্ছেন মাসোহারা। এছাড়া কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠান ও বিদেশে যাতায়াতের ব্যয়ভারও এই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা বহন করে থাকে। এর বদৌলতে ইয়াবা পাচারের রুটগুলো সুরক্ষিত রাখতে ভূমিকা রাখছেন। অপরদিকে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ অনেক নেতা, এমপিদের নির্বাচনী ব্যয়ভারও এই শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বহন করে থাকেন। এজন্য এসব গডফাদাররা আইনের ঊর্ধ্বে। তাদের দাপটে স্থানীয় থানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা রীতিমতো ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। ইয়াবা পাচারে সব জায়গায় তাদের প্রভাব রয়েছে। কেউ গ্রেফতার হলে তার জামিনও তারা পাইয়ে দেন। এদিকে দেশজুড়ে ইয়াবাসহ মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকলেও কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে এখনো এরা অপ্রতিরোধ্য। এ পর্যন্ত বড় কোনো ইয়াবা কারবারি আটকের খবরও পাওয়া যায়নি। সীমান্তের ইয়াবা গডফাদাররা রয়েছে বহাল তবিয়তেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গডফাদার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ