Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পলিথিনে সয়লাব

আইন আছে প্রয়োগ নেই, পুরান ঢাকায় কারখানার সংখ্যা বাড়ছেই, নেপথ্যের নেতারা আঙুল ফুলে কলাগাছ

নূরুল ইসলাম : | প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

পলিথিন উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ। পলিথিনের প্রসার ও বহুমুখি ব্যবহার দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আইন করেও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। বরং প্রশাসনের উদাসীনতায় দিন দিন পলিথিনের প্রসার ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বেড়েছে। নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবসা করে অনেকেরই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পলিথিনের ব্যবসা করার সুযোগ দিয়ে সরকারদলীয় এক শ্রেণির নেতারা হয়েছেন কোটিপতি। পলিথিনে সারাদেশের পরিবেশ বিপর্যস্ত, ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ, ভরাট হচ্ছে নদী-খাল-বিল, পরিচ্ছন্নতা হারাচ্ছে সড়ক-গলিপথ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পলিথিন ছেড়ে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
গতকাল বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা ২০১৮’- এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেপ্রদানমন্ত্রী বলেন,এখন পাটের পলিমার থেকে পচনশীল ধরনের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। আমরা এটার নাম দিয়েছি সোনালী ব্যাগ। এই সোনালী ব্যাগ পরিবেশ দূষণ করবে না।কাজেই এই সোনালী ব্যাগটা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিনকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে স্যুয়ারেজ লাইন বন্ধ হযে যাবে, নদী মরে যাবে, প্রাণীজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে পরিবেশের মহাবিপর্যয় ঘটবে। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সাথে সময়োপযোগী আইন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে এখন নিষিদ্ধ পলিথিন কারখানা। সারাদেশে পলিথিনের বিস্তারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পলিথিনের কারখানা দিন দিন বাড়ছে। এখন কারখানার সংখ্যা তিনশ’ ছাড়িয়েছে। পুরান ঢাকার লালবাগ, কামালবাগ, ইসলামবাগ, দেবিদাসঘাট, শহীদনগর, খাজেদেওয়ান, কিল্লার মোড়, বেগমবাজার, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, ছোটকাট্ারা, বড়কাট্ারা, মৌলভীবাজার, রহমতগঞ্জ, মিটফোর্ড, ফরিদাবাদ, ইমামগঞ্জেই রয়েছে আড়াইশ পলিথিন কারখানা। এ ছাড়া কাওরানবাজার, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, তেজগাঁও এলাকাতে রয়েছে পলিথিন কারখানা।
সূত্র জানায়, গার্মেন্ট, লবণ ও চিনিসহ ২৩ প্রকার প্যাকেজিং ও মোটা পলিথিন উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে শত শত কারখানায় তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পরিত্যক্ত বিষাক্ত পলিথিন সামগ্রী। গ্যাস্ট্রিক, মিকশ্চার, পরিপ্রোফাইল, পলিইথাইল, এইচডিপিসহ বিভিন্ন নামে এসব পলিথিন বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার বাইরে গাজীপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রামসহ দেশের ৩০টি জেলায় এখন পলিথিন তৈরী হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে,পুরান ঢাকার চকবাজার থানার কাছেই বেগমবাজার, মৌলভীবাজার ও চকবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানার প্রকাশ্যে পলিথিন তৈরী হচ্ছে। এসব পলিথিন চকবাজারের পাইকারীদোকানসহ বিভিন্ন দোকানে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়। একজন পলিথিন ব্যবসায়ী জানান, চকবাজারের কোনো কারখানাই আগে পলিথিনের কারখানা বলে পরিচয় দিতো না। বিভিন্ন পণ্যের মোড়ক ও পলিব্যাগের নমুনা রাখা হতো পাইকারী দোকানের সামনে। ক্রেতা আসার পর অর্ডার দিলে গোডাউন থেকে পলিথিন প্যাকেট করা হতো। এখন সবকিছুই প্রকাশ্যেই চলে।
খুচরা বাজারের দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে পলিথিন ব্যাগে কোনো জিনিস দিতে গেলে দোকানদাররা এদিক-ওদিক দেখে নিতেন। এখন আর তার কোনো প্রয়োজন হয় না। শনিরআখড়া বাজারের এক দোকানদার বলেন, পলিথিন নিয়ে অনেক দিন ধরে কোনো ঝামেলা নেই। পাইকারী-খুচরা সবই পাওয়া যায় বাজারের দোকানগুলোতেই। ক্রেতারাও পলিথিনে জিনিস নিতে কোনো দ্বিধা করেন না।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এখন মাছ, গোশত থেকে শুরু করে তরি-তরকারী, সবজি, চাল, ডাল তেল, লবণ, সাবান সবকিছু বহন করা হচ্ছে পলিথিনে। সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার তিন শতাধিক কারখানায় তৈরী পলিথিন সারাদেশেই সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি কারখানা থেকে পলিথিন রাতে ইমামগঞ্জ আসে। সেখান থেকে মধুপুর ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। এই মধুপুর ট্রান্সপোর্টের মালিকও পলিথিন সিন্ডিকেটের সদস্য।
বেসরকারি এক সমীক্ষার তথ্য মতে, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। ওই হিসাবে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতিমাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪১ কোটি পিস। প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। এতে ড্রেন-নালা, খাল ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ লাইন ভরাট হয়ে রাস্তা উপর দিয়ে ময়লা আবর্জনা প্রবাহিত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এটা মহামারি আকারে দেখা দিলে রাজধানীবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়।অতি সূ² ইথিনিল পলিমার পলিথিন তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়, যা অপচনশীল। এতে করে জমির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়। এ ছাড়াপলিথিনে বহন করা যে কোনো ধরণের খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘক্ষণ থাকলে বিষক্রিয়ায় তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সরওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে সারাদেশেই আমাদের অভিযান চলছে। তবে ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভাবে ঢাকায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন,পুরান ঢাকার পলিথিন কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের উচ্চ মহলের একটা সিদ্ধান্ত দরকার। সিদ্ধান্ত পেলে পর্যাপ্ত র‌্যাব-পুলিশ নিয়ে লালবাগসহ পলিথিন কারখানাগুলো একেবারে ঘেরাও করে অভিযান চালানো যেতে পারে। তাতে কিছুটা হলেও পলিথিন উৎপাদন বন্ধ হবে।
উল্লেখ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত) ২০০২ অনুযায়ী, এই আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। আর বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। পরিবেশবিদদের অভিযোগ, পলিথিন নিয়ে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পলিথিন

১৪ আগস্ট, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ