হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক জাতীয় সংসদে কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিলের ঘোষণা, পরবর্তীতে কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে কেবিনেট সচিবকে প্রধান করে পর্যালোচনা কমিটি গঠন এ বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবকেই স্পষ্ট করে তুলেছিল। অনেকেই আশা করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে সরকার হয়তো আন্তরিকভাবেই কাজ করবে। কিন্তু সরকারের এ যাবত কালের পদক্ষেপে সে আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। বরং অতি সম্প্রতি সরকারি দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগের ধারাবাহিক হামলা বিষয়টিকে অধিকতর জটিলতার আবর্তে ঠেলে দেয়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্যে এটা অনেকের কাছেই প্রতীয়মান যে, তারা শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবেই গণ্য ও বিবেচনা করছেন।
বেশ কিছুদিন বিরতির পর গত ৩০ জুন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিল আন্দোলনকারীরা; কোটা সংস্কার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান জানতে চাওয়া এবং নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করাই ছিল সে সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা চালিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলন ভÐুল করে দেয়। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় অন্তত ১০ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়। ওই ঘটনায় একজন শিক্ষকও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ হামলার প্রতিবাদে পরদিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচী দিলে তাতেও ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা চালায়। পরদিনও একই ঘটনা ঘটায় তারা।
পরপর তিনদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা দেশবাসীকে যারপর নাই বিস্মিত করেছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে গড়ে ওঠা জনমতকে স্তব্ধ করতে ছাত্রলীগ কর্মীদের ওই আক্রমণকে কেউ-ই সমর্থন করতে পারছেন না। সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো, শিক্ষার্থীরা তাদের কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। এ বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নেবে এবং আন্দোলনকে প্রশমিত করার দায়িত্বও সরকারের। এখানে ছাত্রলীগ কেন নাক গলাবে? তারা কেন লাঠিয়াল বাহিনীর ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হবে? এটাতো তাদের দায়িত্ব নয়। এটা সর্বজনবিদিত যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন নয়। এটা রাষ্ট্রীয় একটি পদ্ধতির সময়োপযোগী সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন; যা ইতোমধ্যেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পেয়েছে। এ আন্দোলন যারা পরিচালনা করছে বা নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারাও কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়নি। তাছাড়া তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সাহায্য সহযোগিতাও চায়নি বা নেয়নি। নিজেদের দাবি আদায়ে নিজেরাই কর্মসূচী নির্ধারণ ও পালন করে চলেছে। দেশের তাবৎ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় পরিচালিত আন্দোলনকে বানচাল করতে ছাত্রলীগের সহিংস তৎপরতাকে তাই কেউ-ই মেনে নিতে পারছেন না। এসব হামলার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণও কেউ খুঁেজ পাচ্ছেন না।
সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলো, এ আন্দোলনকে বানচাল করা বা আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য সরকার ছাত্রলীগকে দায়িত্ব দিয়েছে কীনা। যদি তা না দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে সরকার, তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কেন কোনো পদক্ষেপ নিল না? বরং আমরা দেখতে পেলাম, পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপরই উল্টো চড়াও হয়েছে, গ্রেফতার করেছে নেতৃত্বদানকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পেছনে সরকারের মদত রয়েছে? বিষয়টি সরকারের স্পষ্ট করা দরকার।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটি প্রয়াস লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। শাসকদলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা ক্রমাগত বলে চলেছেন যে, এ আন্দোলনের পেছনে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র রয়েছে। এমন কি একটি বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পর্যন্ত একই ধরনের মন্তব্য করে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছেন। গত ৬ জুলাই রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এম আবদুস সোবহান বলেছেন, কোটা সংস্কারের নামে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান আরেক ধাপ এগিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করেছেন। গত ৮ (আট) জুলাই সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, জঙ্গিদের কর্মকাÐের সঙ্গে এদের কাজের মিল আছে। এরাও জঙ্গিদের মত ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করছে। ভিসি আখতারুজ্জামানের এ মন্তব্য দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তাদের একটি বিরাট অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। তো নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জঙ্গির সঙ্গে তুলনা করা তার কতটুকু সমীচীন হয়েছে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। তিনি এহেন মন্তব্য করে পদের অমর্যাদা করেছেন বলে সচেতন মহল মনে করেন। শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃত একজন শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের কণ্ঠে যখন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না অন্তরালে কোন নাটকের রিহার্সেল চলছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এর গায়ে রাজনৈতিক চাদর জড়ানোর উদ্যোগ-আয়োজন যে বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ২ জুলাই আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোটা সংস্কারের সঙ্গে আসলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সুবিধা করতে পারেনি। এখন ছাত্রদের কোটার নামে মদত দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে।’ এর পরদিন সিরাজগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে গিয়ে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, চাকরিতে কোটা আন্দোলনের নামে একটি মহল দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের পাঁয়তারা করছে। আর গত ৬ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সরকারবিরোধী কুচক্রী মহল কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া। তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে রুখতে ষড়যন্ত্র করছে।
সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারদলীয় নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের উপরোক্ত বক্তব্য-মন্তব্য কিসের ইঙ্গিত বহন করে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বাতাবরণ দিয়ে অনেক জনহিতকর ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলন নস্যাৎ করার নজির আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। যদি এ আন্দোলনের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি না-ই থাকত, তাহলে সরকার কেন কেবিনেট সচিবকে প্রধান করে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করল? যে কমিটির প্রথম বৈঠক গত ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে সরকার কোটা সংস্কার প্রশ্নে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেবে, অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রীরা আন্দোলনকে রাজনৈতিক রঙ দেয়ার চেষ্টা করবেন, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আঙুল তুলবেন আর তাদেরই ছাত্র সংগঠনের কর্মী-ক্যাডাররা আন্দোলনরতদের ওপর হামলে পড়বে- এসবকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া কষ্টকর। বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, সরকারের ভেতরের কোনো একটি মহল কোটা প্রশ্নে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ থেকে তারা কী ধরনের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের আশা করছে তা আমজনতার জানার কথা নয়। তবে, এতে যে সরকারের সদিচ্ছা এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জনমনে নেতিবাচক ধারণা আরো পোক্ত হচ্ছে সে কথা না বললেও চলে।
পূর্বাহ্নেই বলা হয়েছে, সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক একটি আন্দোলন। কোটা সংস্কার এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে বহু পরামর্শ দিয়েছেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ‘নিপীড়ন বিরোধী শিক্ষকবৃন্দে’র ব্যানারে গত ৮ জুলাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে পদযাত্রা। প্রতিবাদী এ পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। পদযাত্রার শুরুতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার বক্তৃতায় বলেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক, লজ্জাজনক ও অবিশ^াস্য। তিনি আরো বলেছেন, কোটা আন্দোলন যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। এ জন্য ছেলে, মেয়ে, অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাই তাতে সমর্থন দিয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন কোনো বিশেষ সরকার, দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। এটি একটি সিস্টেমের যুগোপযোগী সংস্কারের দাবিতে পরিচালিত অহিংস আন্দোলন। আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগের পরিবর্তে অন্য কোনো দল থাকলে তাদের কাছেও শিক্ষার্থীরা একই দাবি উত্থাপন করত। বর্তমান সরকার যদি কোটা সমস্যার সমাধান না করে, তাহলে পরবর্তীতে যে সরকার আসবে তাদেরকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। সুতরাং এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, কোটা সংস্কার আন্দোলন কোনো বিশেষ দল বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাছাড়া এ আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত হয়নি। ক্ষমতাসীনদলের পক্ষ থেকে বিএনপির দিকে আঙুল তোলা হলেও এ পর্যন্ত দলটির পক্ষ থেকে চলমান এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া বা মদত দেয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং সরকারি দলের নেতাদের অভিযোগের জবাবে গত ৭ জুলাই বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘বিএনপি অন্যের হাতে খাবার খায় না, নিজের হাতে খাবার খায়। সবাই জানে কোটা আন্দোলনের মূল নেতারা ছাত্রলীগের।’ বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্যের যর্থাথতার প্রমাণ রয়েছে চলমান আন্দোলনের অতীত ঘটনাবলীতে। কারণ, কোটা সংস্কারের দাবিতে যেসব মিছিল সমাবেশ হয়েছে এবং হচ্ছে সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুর ছবি সংবলিত ব্যানার ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
এটা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয় যে, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যেই ক্ষমতাসীন দলের নেতারা কোটা আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত করতে চাচ্ছেন। এটা করা গেলে ‘দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা’র অজুহাতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর যেমন আরেক দফা নিপীড়ন-নির্যাতনের মওকা পাওয়া যাবে, তেমনি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধেও সরকারের বিরোধী ষড়যন্ত্রে অভিযোগ এনে দমননীতির প্রয়োগ ঘটানো যাবে শক্তভাবে।
আর ছাত্রলীগের কর্মকান্ড নিয়ে খোদ সরকার প্রধানই অনেকবার বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কয়েক বছর আগে তিনি এ জন্য ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই এদের অতি উৎসাহী কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্যক অবগত। অন্তত দেশবাসীর ধারণা সেটাই। আর সেজন্যই তারা আশা পোষণ করেন যে, এসব বেআইনী তৎপরতার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করবে। ক’দিন আগে ছাত্রলীগের এক নেতার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস অলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, ভাইরাল হওয়া ওই স্ট্যাটাসে বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা খায়রুল হাসান সৈকত তার ফেসবুক টাইম লাইনে লিখেছেন, ‘অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, কোটা আন্দোলনের নামে সরকারি বিএম কলেজের শান্ত পরিবেশকে অস্থিতিশীল করা হলে বিএম কলেজ ছাত্রলীগ কঠোর রূপ ধারণ করতে বাধ্য হবে। সরকারবিরোধী কর্মকান্ডে জামায়াত-শিবির ঐক্যবদ্ধ হয়ে অরাজকতা করবে, আর ছাত্রলীগ আঙুল চুষবে সেটা ভাবা বোকামী। আজ জীবনের সর্বোচ্চ ধৈর্যটুকু ধারণ করেছিলাম। পরবর্তী দেখায় গণধোলাইায়ে কেউ নিহত হলে দয়া করে ভুল ভাইবেন না।’ (সূত্র: যুগান্তর, ৬ জুলাই, ২০১৮)
খবরটি প্রকাশের পর বেশ ক’দিন অতিবাহিত হয়েছে। প্রকাশ্যে সন্ত্রাস ও হত্যার হুমকি দেয়া সত্তে¡ও ওই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। যেখানে পান থেকে চুন খসলেই আইসিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের হয়ে যায়, গ্রেফতার হয়ে যায় অভিযুক্ত ব্যক্তি, সেখানে সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পরও বরিশালের ওই ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এটাকে যদি কেউ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের ‘অ্যাকশনে’র প্রতি সরকারি মহলের প্রচ্ছন্ন মদত বা মৌন সমর্থনের উদাহরণ হিসেবে মনে করেন, তাহলে কী তা অযৌক্তিক হবে?
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারি মহলের বিষোদগার এবং এ আন্দোলন দমনের জন্য পেশিশক্তির ব্যবহার ক্রমেই প্রকট রূপ ধারণ করছে। একদিকে চলছে পুলিশি অ্যাকশন, অন্যদিকে চলছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনটির তাÐব। এ যেন শান্তিপূর্ণ একটি আন্দোলনকে জোরপূর্বক সহিংস করে তোলার সম্মিলিত অপপ্রয়াস! বলা নিষ্প্রয়োজন, এ ধরনের অপপ্রয়াসের ফল কখনোই হিতকর হয় না। যেহেতু কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারবিরোধী বা সরকার পতনের আন্দোলন নয়, তাই এ আন্দোলনকে পেশিশক্তি দিয়ে দমনের চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তাতে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।