হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
সুসংবাদ বটে। দেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। প্রায় ছয় মাসের ব্যবধানে ১৩১৬ ডলার থেকে বেড়ে ১৪৬৬ ডলার হয়েছে। জিডিপির হারও বেড়েছে। ৬-এর বৃত্ত থেকে বের হয়ে ৭-এর উপরে গেছে। এ থেকে যে কারো মনে হতে পারে খুব দ্রুতই দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগুচ্ছে। অবশ্য দেশ এগিয়ে যায় না, দেশের মানুষ এগিয়ে যায়। দেশের মানুষের জীবনযাত্রা এগিয়ে যাবে, থেমে থাকবে না-এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে এই জীবনযাত্রার গতি কীভাবে এগিয়ে যায় তা কোনো গতিমাপক যন্ত্র দিয়ে মাপা যায় না। এটা অনেকটা ধারণার ওপর নির্ভরশীল। এটা বোঝা যায়, মানুষ তার জীবনযাপন নিয়ে কতটা সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট। স্বচ্ছন্দে চলছে, নাকি টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে। আবার এটা মানুষের চাহিদার ওপরও নির্ভর করে। অর্থনীতির ভাষায় মানুষের চাহিদার শেষ নেই। তার চাহিদা ক্রমবর্ধমান। তাকে পৃথিবীর অর্ধেক দিয়ে দিলেও নাকি সে খোঁজ করবেÑ বাকি অর্ধেক কোথায়? আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা অল্পতে তুষ্ট হয়। দুবেলা দুমোঠো ভাত খেতে এবং একটু ভদ্রস্থভাবে চলতে পারলে তাদের আর বেশি কিছু লাগে না। আগে দেখা যেত গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষ খাওয়া-পরার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারলে গানবাজনাসহ বিভিন্ন আনন্দদায়ক আড্ডায় মেতে উঠত। এখন সময় বদলেছে, পুঁজিবাদের প্রসার ঘটায় প্রত্যেকের মধ্যে চাওয়ার এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। প্রত্যেকের মধ্যেই ‘চাই চাই’ প্রবণতা ঠাঁই করে নিয়েছে। আমাদের যারা শাসন করেন, তারা ক্রমাগত উন্নতির কথা বলে এবং স্বপ্ন দেখিয়ে চাহিদাকে উস্কে দিয়েছেন। এটা দোষের কিছু নয়। মানুষের জীবনযাপনের উন্নতি ঘটবে, চাহিদা বাড়বে, চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কর্মমুখী হবে এবং এগিয়ে যাবে- এটা যুগের ধর্ম। আমরা এখন চাহিদা পূরণ করার জন্য শুধু অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিযোগিতা করছি না, এই প্রতিযোগিতাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিয়ে গেছি। কথায় কথায় বলছি, আমরা অচিরেই উন্নত দেশে পরিণত হবো। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নতির এই মাপকাঠিটা কি? কিভাবে বুঝব আমরা উন্নতি করছি? অর্থনীতির জটিল হিসাব-নিকাষে এর কিছু থিওরি রয়েছে। তার মধ্যে সহজটি হচ্ছে, দেশের মানুষের গড় আয় হিসাব করা। যে দেশের মানুষের গড় আয় যত বেশি, সে দেশ তত উন্নত। এছাড়া শহর-বন্দর-গ্রামের বিভিন্ন অবকাঠামোর বাহ্যিক সৌন্দর্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, সুশাসন, সামাজিক সূচকের অগ্রগতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকেও উন্নতির সূচক হিসেবে ধরা হয়। আমরা যদি ইউরোপ-আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে তাদের চাল-চলন, বেশ-ভুষা, স্থাপত্য সৌন্দর্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব ও মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে সহজেই বুঝতে পারি, তারা কত উন্নত। তাদের মাথাপিছু আয় আমাদের তুলনায় শত গুণ বেশি। তাদের আয়ের মধ্যেও খুব একটা ফারাক নেই। এমনকি তাদের গড় আয়ের যে লেবেল তার চেয়েও যদি কারো আয় কম হয় তাতেও তাদের জীবনে টানাপড়েন দেখা দেয় না। যতটুকু আয় করে তা দিয়েই স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে পারে। তাদের এই শেষ লেবেলের গতির তুলনায় আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাপনের গতি কচ্ছপতুল্য। তবে আমাদের সরকারের লোকজনের উন্নয়নের কথার গতির সাথে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নতির গতি কোনোভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে আমাদের সরকার চ্যাম্পিয়ন।
দুই.
গত ১৮ মার্চ প্রকাশিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি এবং আমাদের অগ্রগতি’ শীর্ষক নিবন্ধে বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির একটি চিত্র তুলে ধরেছিলাম। আমাদের দেশে যে এখন অর্থের ছড়াছড়ি, বেসুমার লুটপাট করেও তা শেষ করা যাচ্ছে না এবং হেনরি কিসিঞ্জারের বটমলেস বাস্কেট উপাধি যে সঠিক ছিল না এমন একটি বিষয় তুলে ধরেছিলাম। এ নিবন্ধের সাথে অনেকটা একমত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক বাংলাদেশের মাহমুদ সুহাইমি, যিনি দেশে থাকতেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, বিভিন্ন তথ্য দিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছেন। তার ইংরেজিতে লেখা প্রতিক্রিয়া বাংলা তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে আমরা কোথায় যাচ্ছি? শেয়ারমার্কেট, হলমার্ক, বিভিন্ন ব্যাংক কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথাকথিত হ্যাকিং, দেশের আইটি বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে রাকেশ আস্থানার মতো এক বিদেশীকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনসহ সব ধরনের নির্বাচনের অস্বচ্ছতা, এসব কিসের আলামত? আমাদের কিছু সুরম্য অট্টালিকা আছে কিন্তু আমাদের আত্মা কোথায়? কোথায় আমাদের একতা, কোথায় ন্যায়বিচার, কোথায় শান্তি? আমি শুনেছি, আমাদের দেশের মানুষ বাইরে থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ, রসুন, আদা থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই, যা ব্যবহার করছে না। বাইরে থেকে বিপুল পরিমাণ চাল, গম আমদানি করছে। তারপরও আমরা বলছি, আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আসলে খাদ্যের সংজ্ঞাটি কি? নিবন্ধে হেনরি কিসিঞ্জারের সমালোচনা করার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, কিসিঞ্জারকে তিরস্কার করার কি কোনো কারণ আছে? তিনি যখন বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলেছিলেন, সে সময়ের জন্য তা ঠিকই ছিল এবং দুঃখের সাথে বলতে হয়, তার এ কথার পুনরাবৃত্তিই নিকট ভবিষ্যতে হতে যাচ্ছে। অধ্যাপক সাহেবের এই মতামতের সাথে পাঠক একমত হবেন কি হবেন না, এটা একান্ত তাদের স্বাধীন মতের উপর নির্ভর করছে। তবে এ কথা মানতেই হবে, অধ্যাপক সাহেব যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন তা অস্বীকার করার খুব একটা সুযোগ নেই। আসলেই তো, আমাদের সরকার যে কথায় কথায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলছেন, এটা কতটা সত্য? কেবল ধান-চাল উৎপাদনে রেকর্ড করলেই কি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বোঝায়? খাদ্যের সংজ্ঞা কি? অবশ্য এর একটা সংজ্ঞা পাওয়া যায়, আমাদের এক মন্ত্রীর কথা থেকে। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে।’ তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলতে তিনি শুধু চালের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বোঝাচ্ছেন। অর্থাৎ দেশে পর্যাপ্ত চাল থাকলে আর কোনো খাদ্য লাগে না। এ সংজ্ঞার সাথে বোধ করি, নুন-ভাত খায় এমন একজন ভিখারিও একমত হবে না। কারণ ভাত খেতে তরকারি জাতীয় কিছু লাগে। এক্ষেত্রে কি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ? আমরা যদি একটু খেয়াল করি, তাহলে দেখব, শুধু আদা, রসুন, পেঁয়াজ নয়, মাছ-গোশত, মশলা, মুরগী, ডাল, তেল, ফল-ফলাদি, সাবান, শ্যাম্পু, টুথপেস্ট, চকলেট-বিস্কুট, শাড়ি, থ্রিপিস, স্যান্ডেল-জুতা থেকে শুরু করে হেন জিনিস নেই যা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় না। এখন আমাদেরকে বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দেশী জিনিস মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। জিনিসগুলো দেশী কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক কসরত করতে হয়। অর্থাৎ দেশী জিনিস এখন বাজারে দুর্লভ হয়ে পড়েছে। কিনতে গেলেই দেখা যায়, বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমদানি করা। এ-তো গেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কথা। এখন বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলও আমদানি করতে হচ্ছে। গ্যাসও আমদানি করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমরা একটি আমদানিনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছি। যে দেশ আমদানি ও অন্যের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, সে দেশকে ভাসমান ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! আমরা দেখেছি, কয়েক মাস আগে নেপালের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে। নেপাল খাদ্য পণ্যের দিক থেকে প্রায় পুরোপুরি ভারতনির্ভর। নেপাল তার ইচ্ছামতো সংবিধান সংশোধন করায়, ভারত তাতে নাখোশ হয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এতে নিদারুণ কষ্টে পড়ে নেপালের জনগণ। তাদের না খেয়ে মরার উপক্রম হয়। আমরা ধান-চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি এ কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও বাকি প্রায় সব খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে যে ভারতনির্ভর হয়ে পড়েছি এ কথাটি উল্লেখ করা হয় না। আমরা প্রায়ই দেখি পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, মশলা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। এর কারণ সম্পর্কে যে কথাটি দোকানিরা বলেন তা হচ্ছে, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় এই মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। এখন ভারত যদি কখনো দীর্ঘ সময় এসব পণ্য রপ্তানি বন্ধ রাখে, তাহলে কি অবস্থা দাঁড়াবে? আমরা নিজেদের উৎপাদিত এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী দিয়ে কি প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারব? কোনোভাবেই না। যাদের অঢেল সম্পদ রয়েছে কেবল তারাই এক কেজি পেঁয়াজ-রসুনের দাম ৫০০ টাকা হলেও কিনতে পারবে। সাধারণ মানুষকে দেশে উৎপাদিত নুন-ভাতই খেতে হবে। তাহলে খাদ্যে আমরা কিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলাম?
তিন.
আসলে আমাদের সরকার স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসে। স্বপ্নেই মানুষকে মিষ্টি খাওয়াতে চায়। সেই দুঃখিনী মায়ের গল্পের মতো যে চুলায় খালি পাত্র বসিয়ে খাবার রান্না হচ্ছে বলে সন্তানদের সান্ত¡না দিয়ে যায়। স্বপ্ন দেখা এবং দেখানো কোনো দোষের কিছু নয়। যে জীবনে স্বপ্ন নেই, সে জীবন স্থবির, অচল। তবে যে স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দেয় না, সে স্বপ্ন না দেখা বা দেখানো কি উচিত? বাংলাদেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জিডিপি বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে এ নিয়ে তো অর্থনীতিবিদরা কোনোভাবেই একমত পোষণ করতে পারছেন না। সরকার যেভাবে স্বপ্নের মতো করে এসব সূচক বৃদ্ধির কথা বলছে, বাস্তব পরিস্থিতি যে তা নয়, এটা অর্থনীতিবিদরা বারবারই বলছেন। সরকারের এসব কথাবার্তায় যে স্ববিরোধিতা ও অর্ধসত্যের মিশেল রয়েছে তা বাস্তব পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে। জিডিপির বিষয়টি ধরা যাক। এটি এমন এক বিষয় যে ৭ বা ৮ হলো কিনা তা বাস্তবে প্রমাণ করা অসম্ভব। কে প্রমাণ করতে যাবে? আর সাধারণ মানুষের পক্ষে তো অর্থনীতির এই জটিল হিসাব বোঝা এক প্রকার অসম্ভব। কাজেই ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’ বা রাজা-বাদশা যা বলে তাই ঠিক এটা মেনে নেয়া ছাড়া জনগণের গত্যন্তর থাকে না। সরকার সম্প্রতি জিডিপি ৭.০৫ শতাংশ হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে অথচ এই কয়েক দিন আগেই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলেছে জিডিপি হবে ৬.৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে ৬.৩ শতাংশ। এখন কারটা ঠিক আর কারটা বেঠিক এটা প্রমাণ করতে যাবে কে? এ এক গোলক ধাঁধার চক্কর। তবে অর্থনীতির জটিল এই সংখ্যা গণনা নির্মোহভাবে যারা করেন তাদেরটা আপেক্ষিকভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে। এতে জনসাধারণকে অবুঝের মতো মাথা নাড়িয়ে মেনে নেয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি অবশ্য হিসাব করা সহজ। কারণ যে আয়-রোজগার করে, সে তা হাতেনাতে প্রমাণ দিতে পারে। সরকারের হিসেবে এখন মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার। প্রায় ছয় মাস আগেও এই আয় ছিল ১৩১৬ ডলার। তাহলে ছয় মাসের মধ্যে এই আয় এক লাফে ১৫০ ডলার বা ১২ হাজার টাকা বেড়ে গেল কিভাবে! এটা কি বাস্তবসম্মত? বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একজন বেকার যার কোনো আয়ই নেই, গড় হিসেবে তার মাথাপিছু আয়ও ছিল ১৩১৬ ডলার। সেই তারই আয় ছয় মাসের মাথায় আরো ১৫০ ডলার বেড়ে গেছে। কী বিস্ময়কর ব্যাপার-স্যাপার! এ তো স্বপ্নের মতো! একজন বেকার জীবনযাপনের তাগিদে এই আয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে। তবে স্বপ্ন ভেঙ্গে বাস্তবে যখন দেখে তার পকেটে একটি টাকাও নেই তখন সে তো প্রশ্ন করতেই পারে আমার ১৪৬৬ ডলার বা ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা কোথায়? গড় আয়ের এই হিসাব তখনই সঠিক হতো যখন দেশে কর্মপোযোগী একজনও বেকার না থাকত। উন্নত বিশ্বে যে বেকার থাকে না, তা নয় তবে এই বেকারদের জন্য সরকার বেকার ভাতার ব্যবস্থাও করে। অবশ্য তাদের দেশের বেকারদের আত্মসম্মানবোধ বেশ টনটনে। তারা বেকারভাতা নিতে চায় না। আর আমাদের দেশে বেকার ভাতা দেয়া দূরে থাক, লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানেরই সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবেই তো বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩১ হাজার। এই বেকারের সংজ্ঞাও বিচিত্র। বিবিএস বেকারত্বের এ হিসাব করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদ- অনুযায়ী। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ যদি সপ্তাহে নিদেনপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ না করে, তবে সে বেকার। আর সপ্তাহে যারা এক ঘণ্টা কাজ করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় বা কর্মরত হিসেবে ধরা হয়। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে কর্মরত এমন লোকের সংখ্যা ৫ কোটি ৮৭ লাখ। এর মধ্যে ৭২ লাখ ৮৭ হাজার জন গৃহস্থালির কাজে পরিবারকে সাহায্য করে তবে মজুরি পায় না। সপ্তাহে কেউ যদি এক ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজকর্ম করে তাকে বেকারের পর্যায়ে রাখা হয় না। এ হিসেবে দেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা এক কোটির উপরে। এরা কোনো আয়ই করে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার! একজন সপ্তাহে যদি একবার গৃহস্থালির ঝাড়পোছ করে তাকে বেকার বলা যাবে না। অথচ সাধারণ অর্থে বেকার বলতে আমরা বুঝি বেতনভুক্ত হয়ে কোনো পেশায় নিযুক্ত না হওয়া। গৃহস্থালির কাজ করা আর আয়রোজগারের কাজ যে এক নয়, এটা তো সবাই জানে। এখন আইএলওর সংজ্ঞা দিয়ে বিবিএস বেকারত্বের যে হিসাব দিয়েছে তাতে এক কোটির উপরে বেকার যদি এখন মিছিল করে বলে আমার ১৪৬৬ ডলার কোথায় বা সরকারের কাছে দাবি করে বসে তখন সরকার কী জবাব দেবে? বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৫ বলছে বেকারের সংখ্যা এখন দেড় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বেকারদের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। কর্মসংস্থান না বাড়ার কারণে বেকারত্ব বাড়ছে। দিন দিন কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। এত গেল ফ্রেশ বেকার বা যারা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে তাদের হিসাব। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ কর্মজীবী যে বেকার হয়েছে তার হিসাব এখনও করা হয়নি। কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় একটি খাত গার্মেন্ট শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। অনেকে বেকার হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অনেক শ্রমজীবী মানুষ কাজের আশায় বসে থেকেও কাজ পাচ্ছে না। গত ১১ এপ্রিল ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাভারে দিনমজুররা কাজের অভাবে চরম দুর্দিনে পড়েছে। একই দিনে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নীলফামারী থেকে মাস্টার্স শেষ করে তিন-চার মাস আগে হুমায়ূন কবির নামে এক যুবক চাকরির আশায় রাজধানীতে আসে। চাকরি না পেয়ে রাজমিস্ত্রীর কাজও শুরু করে। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে সে আত্মহত্যা করে। মীরপুরের রূপনগরে আশিক নামে এক তরুণ তিন-চার বছর আগে বিদেশ থেকে এসে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নেয়। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে বেকারত্বে হতাশ হয়ে সে আত্মহত্যা করে। ঘটনাগুলোকে সরকারি মহল থেকে বিচ্ছিন্ন বা অন্য কোনো কারণে ঘটেছে বলে উড়িয়ে দিতে পারে। তবে সচেতন মহল নিশ্চিত, হুমায়ূন ও আশিক বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতেই আত্মহত্যা করেছে। তারা বেকারদেরই অংশ ছিল। এ যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না বলেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। যারা জীবিত বেকার, তাদের বেকারত্বের যন্ত্রণা এই মৃত্যুর চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। এরই মাঝে সরকারের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ঘোষণা নিশ্চিতভাবেই তাদের কাটা গাঁয়ে নুনের ছিটা হয়ে যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। তাদের কাছে সরকারের উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘোষিত অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের গ্রাফ প্রহসন ছাড়া আর কিছু মনে হতে পারে না। আরেকটি প্রহসনমূলক ঘটনা হচ্ছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি। গত ৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের শুরুতে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ চাল আমদানিকারক না রপ্তানিকারক দেশ? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে প্রতিবেদনে যে তথ্য উল্লেখ করা হয় তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকারিভাবে চাল রপ্তানি করলেও বেসরকারিভাবে বিপুল পরিমাণে চাল আমদানি করা হচ্ছে। রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ ৩০ গুণ বেশি। গত বছর বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি করেছে ৫০ হাজার টন। এ বছর লিবিয়াসহ আফ্রিকার সাতটি দেশে চাল রপ্তানির আলাপ-আলোচনা চলছে। এর বিপরীতে গত অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি করেছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার টন। এখনও আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের কথা অনুযায়ী যদি লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয় তাহলে একে কি খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বলা যায়? একি জনগণকে শুভংকরের ফাঁকি দেয়া নয়? এতে কি সরকারের প্রতি জনগণের অবিশ্বাস জন্মাচ্ছে না?
চার.
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে পিরামিডের উল্টোচিত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায়। উপর দিক থেকে প্রসারিত হয়ে নিচের দিকে চোঙ্গাকৃতি ধারণ করার মতো। একদিকে প্রভাশালী একটি গোষ্ঠী এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা দিন দিন সরু হচ্ছে। এই যে মাথাপিছু আয় এবং জিডিপি বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, এটা যে হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির কারণে, তা অর্থনীতিবিদরা তো বটেই একজন সচেতন মানুষও বুঝতে পারছে। এই একটি শ্রেণী বা গোষ্ঠীর উন্নতিকেই সরকার সারাদেশের মানুষের উন্নতি দেখিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে। এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কী করার থাকতে পারে! মানুষ দেখছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার নামে দেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির নামে বৈষম্যমূলক উন্নতির প্রবণতা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় বড় প্রকল্পের কাজ শুরু করে উন্নতির প্রতীক হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পকে ঘিরে দুর্নীতির পরিধিও বৃদ্ধি হচ্ছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরিবর্তে সংকুচিত হচ্ছে। বেকারত্বের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না, হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না কমিয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের ব্যবসা করার মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছে। এতসব সমস্যার মধ্যে থেকেও সরকার পুষ্পের হাসি হাসছে। উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে চলেছে। কাগজে-কলমে পরিসংখ্যান বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নতির কথা বলছে। এ যেন গল্পের অবিবাহিত তরুণ ডিম বিক্রেতার স্বপ্নের মতো। যে তরুণ মাথায় ডিমের ঝুড়ি নিয়ে বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশে যেতে যেতে স্বপ্নে বিভোর হয়ে কল্পিত স্ত্রীর সাথে অভিমান করে ‘নেহি খায়েঙ্গে’ বলে মাথা ঝাকিয়ে উঠে। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখে তার সব ডিমের সাথে তার স্বপ্নও ভেঙ্গে চুরমার হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।