যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
ইমামুল হাবীব বাপ্পি
বিশ্ব ফুটবলে এখন বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের জয়গান। আর যদি লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অন্ধ ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। অনেকে আবার বায়ার্ন মিউনিখ, জুভেন্টাস, পিএসজি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, আর্সেনাল অথবা চেলসির মত বিশ্ব বিখ্যত ফুটবল ক্লাবের ভক্ত। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন দলের ভক্ত না হয়ে আপনি যদি শ্রেফ ফুটবলের ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয় চলতি মৌসুমে আপনার মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে প্রিমিয়ার লিগের একটি অখ্যাত দল, লেস্টার সিটি। পুরো নাম লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব। লিগের বাঘা বাঘা দলের ভিড়ে কি দারুরণভাবেই না নিজেদেও চেনালো দলটি। ‘অসাধারণ’ বিশেষণ দিয়েও যেন সেই লেস্টারকে পুরোপুরি চেনানো অসম্ভব!
মাত্র এক বছর আগে মৌসুমের ঠিক এই সময়ে যে দল লড়ছিল পয়েন্ট তালিকার অবনমন ঠেকাতে। বছরান্তেই পাল্টে গেল সব হিসাব-নিকাশ। পাল্টে গেল না বলে হিসাবটা শ্রেফ উল্টে গেল বলাই মনে হয় শ্রেয়। লিগের আর মাত্র ৫ রাউন্ড বাকি। শিরোপা দৌড়ে এগিয়ে ৭ পয়েন্টে তারা। এ যেন কল্পনাকেও হার মানানোর মত ইতিহাস। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে,শিরোপা যদি তারা হাতছাড়া করে তবে সেটাই যেন এখন বড় অঘটনের জন্ম দেবে!
লিগ শিরোপা তারা জিতবে কিনা তা নির্ভও করেছে অনেক ‘যদি’র ওপর। কিন্তু যে হিসাবটা তারা ইতোমধ্যেই মিলিয়ে ফেলেছে তা হল ইউরোপের সেরা ক্লাবগুলোর তালিকায় নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করা। যে সব বিশ্বখ্যাত দল নিয়েই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের আসর। শিরোপা জয় যদি নাও হয়, এই অর্জনটাই কি কম লেস্টারের মত অখ্যত একটি দলের কাছে!
মৌসুমের অর্ধেক সময় শীর্ষে কাটানোর পরও অধিকাংশ ফুটবল বোদ্ধার বিশ্বাসেই দোলুনি ছিল লেস্টারকে নিয়ে। কিন্তু সকল দোলুনি থামিয়ে ধীর পায়ে স্থিও লক্ষ্যে এগুচ্ছে ক্লাদিওর রেনিয়েরির দল। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন জেমি ভার্ডিকেও আবিষ্কার করেছে তারা। যে ভার্ডি প্রিমিয়ার লীগে টানা ১১ ম্যাচে গোল করে ভেঙ্গে দিয়েছেন সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলোয়াড় রুড ফন নিস্টারলয়ের সর্বোচ্চ টানা ম্যাচে গোল করার রেকর্ড। প্রিমিয়ার লীগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও (২১ গোল) তিনি। এমন লড়াইয়ে সহযোদ্ধা হিসেবে ভার্ডি পাশে পেয়েছেন রিয়াদ মাহরেজের মত আরেক যোগ্য খেলোয়াড়। যখনই ভার্ডির অভাব তখনই বুক চিতিয়ে এগিয়ে এসেছেন মাহরেজ। যিনি কিনা চলতি মৌসুমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সেরা উইঙ্গার হিসেবে। লেস্টার সিটির এই উইঙ্গার ২০১৪ সালে ফ্রান্সের দ্বিতীয় বিভাগের দল লা হুভরের হয়ে কিছুটা সুনাম অর্জন করেন। তবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে দ্বিতীয় বিভাগে খেলা এই আলজেরিয়ান খুব শীঘ্রই নিজেকে আক্রমণভাগে মেলে ধরেছেন অন্যরকম ভাবে। ছোট ছোট পায়ে বলকে নানাভাবে ঘুড়িয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দ্বিধায় ফেলে দিয়ে নিজের কাজটা ভালোভাবেই সারেন মাহরেজ। পুরো মাঠ জুড়ে বল নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোতে জুড়ি নেই তাঁর। বাম পায়ের এই ফুটবলার সাধারণত মাঠে ডানে খেললেও মধ্যমাঠ থেকে গোল করারও ক্ষমতা আছে তাঁর। প্রিমিয়ার লীগে মৌসুমে তাঁর নিজের ১৬ গোলের পাশাপাশি ১২ গোলে সহায়তা। গোলের সহায়তায় মৌসুমে তার ওপরে রয়েছে কেবল আর্সেনালের জার্মান মিডফিল্ডার মেসুত ওজিল। এছাড়া তাঁদের এমন কিছু ফুটবলার আছে যারা যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। প্রতিনিয়তই রক্ষণ এবং আক্রমনভাগে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। গোলরক্ষকে খুব কাছ থেকে পরাজিত করা এবং গোলপোস্টের ফাঁক খুঁজে গোল বারে বল পৌঁছে দেওয়ার কাজটাও তার করছে বেশ দক্ষতার সাথে। আর এই কাজে ভার্ডি-মাহরেজদেও পূর্ণ সহায়তা করছে তাঁদের সতীর্থরা।
এ তো মাঠের লড়াই। কিন্তু আরো একজন যে মাঠে না নেমেও লড়াইয়ের মধ্যমনি। শিষ্যদের নিত্য কাজ যে মানুষটি সহজভাবে বর্তে দেন সেই কোচ রেনিয়েরি হয়তো একটু আড়ালেই রয়ে গেছেন। কিন্তু নি¤œ মানের একটি দল নিয়েও যে হাতের ছোঁয়াই পাল্টে গেল পুরো দলের ভাগ্য তাঁর কথা তো একটু অন্যবাবে বলাই লাগে। এর আগে জুভেন্টাস, রোমা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, চেলসিসহ বেশ কয়েকটি দলের কোচের দায়ীত্ব পালন করেছেন তিনি। লেস্টারের দায়ীত্বে এসেছেন চলতি মৌসুমেই। প্রথম বছরেই এই ইটালিয়ান কোচ তাঁর দলকে এমনভাবে সাজিয়েছেন যেন দলের সেরা দুইজন ফুটবলার তাঁদের সেরা খেলাটা বের করে আনতে পারে। খেলোয়াড়দের কানে বর্তে দিয়েছেন খেলাকে উপভোগ করার মন্ত্র। আর তাতেই বাজিমাৎ। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে তড়িৎ বল নিজেদের দখলে নিয়ে দলীয় মুহুর্তেই প্রতিআক্রমণের মন্ত্রটা তো তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আর এই কাজে বেশিভাগ সময় মূল ভুমিকা পালন করেন মাহরেজ। প্রতিপক্ষের রক্ষনভাগের ধরণের উপর নির্ভর করে তিনি শট নিবেন কিনা নাকি কোন সতীর্থকে বল দিয়ে সাহায্য করবেন সেটিও এখন মাঠে তাদের নিত্য জানা বিষয়। লেস্টার সিটি মূলত দলীয় আক্রমণ অর্থাৎ কাউন্টার এ্যাটাকিং ফুটবলেই বিশ্বাসী। বলের দখলে খুব একটা বিশ্বাসী নয় তারা। যদিও ভার্ডি এবং মাহরেজ দলের মূল তারকা তবে লেস্টারের প্রতিটি ফুটবলারই তাঁদের নিজেদের জায়গা থেকে যার যার কাজটি ঠিকমত করে যাচ্ছেন। মধ্যমাঠে এন’গোলো ক্যাৎ বল দখলে রাখছেন। তাঁর সহযোগী ড্যানি ড্রিঙ্কওয়াটার মধ্যমাঠ পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখছেন। ভার্ডি এবং মাহরেজের মধ্যকার বোঝাপড়াকে ঠিকভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। মাহরেজের বিপরীত পাশে খেলা মার্ক আলব্রিটন অনেকটা বোঝাপড়ার ভূমিকা পালন করেন। ডিফেন্ডার রবার্ট হাথ এবং ওয়েস মরগান রক্ষনভাগকে শৃঙ্খলিত রাখতে মূল ভূমিকা পালন করেন। সব মিলিয়ে গত মৌসুমে ধুঁকতে থাকা একটি দলকে এভাবে এক সুতোয় গেঁথেছেন রেনিয়েরি। এমন অসাধ্য সাধনের জন্যে প্রশংসা পেতেই পারেন লেস্টার গুরু। নিজেদের ভুল থেকে শিখে লেস্টার সিটি নিজেদের খেলার আরও উন্নতি করছে। সামনের লক্ষ্যে এগিয়েও চলেছে বীর দর্পে। যা আসলে রুপকথার মতই। ফুটবলের ভক্ত হয়ে মৌসুম শেষে এমন একটা দলের হাতে শিরোপা দেখতে কার না ভালো লাগে।
তবে শিরোপা স্বপ্নের ফয়সলা হতে এখনো ঢের বাকি। আপাতত ইউরোপ সেরাদের সারিতে নিজেদের নাম তুলতে পেরেই যেন আত্মহারা ফক্স গুরু। স্বপ্নটা এভাবে সত্যি হতে যাচ্ছে ভেবে আবেগ চেপে রাখতে পারেননি রেনিয়েরিÑ ‘অবিশ্বাস্য। একবার ভাবুন তো বার্সেলোনা আমাদের মাঠে খেলতে আসছে। আমাদের সমর্থকেরা প্রথমবারের মতো নিজেদের মাঠে বসে মেসি-নেইমারদের দেখবে। আমরা তাদের বিপক্ষে খেলব। অবিশ্বাস্য! আমি এই অনুভূতিটা পেতে চাই।’ ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় এবারই অবশ্য নতুন নয়, এর আগেও খেলেছে তারা। তবে সেটাও প্রায় অর্ধ শতাব্দি আগে (১৯৬১-৬২)। ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপে খেলেছে তারা। ১৯৯৭-৯৮ সালে খেলেছে উয়েফা কাপে। এরপর ২০০০-০১ সালে একই টুর্নামেন্টে আরও একবার। তবে কোনোবারই প্রথম রাউন্ড পেরোতে পারেনি তারা। সেই জায়গা থেকে আগামী মৌসুমে বিশ্বের সেরা সব ক্লাবের সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ তো অসাধারণ অর্জনই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।