বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
‘ক্রুস ও ক্রিসেন্টের মধ্যে যুদ্ধের জন্য বিশ্বকে পরিচালিত করতে পারে’ বলে অস্ট্রিয়ার সাম্প্রতিক ভূমিকায় আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্ক করে দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট ‘এরদোগান’। অতীতের দুই শ’ বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তুরস্কের এ সতর্কবার্তা প্রেসিডেন্ট এরদোগান বিশেষভাবে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কেন দিয়েছেন তা সহজেই বোধগম্য। অতীতের সাতটি বড় বড় ক্রুসেড যুদ্ধের অধিকাংশেই মুসলমানদের নিকট ক্রুসেডাররা শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো বিস্মতি হতে পারেনি বলে তারা নিজেদের পরিচালিত সেই ধর্মযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পৃহার অসংখ্য প্রমাণ মধ্যপ্রাচ্যে প্রদর্শন করে যচ্ছে এবং মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ, বিসংবাদ ও অনৈক্যের সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করছে না এবং তাদের ধর্মীয় উন্মাদনার রণকৌশল পরিবর্তন করে তাদের স্বার্থেই কখনো মুসলমানদের বন্ধু ‘খয়ের খা’, কখনো মুসলমানদের বিবদমান পক্ষগুলোকে সুকৌশলে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে তামাসা প্রত্যক্ষ করে, আবার সুযোগ বুঝে কোনো এক পক্ষের সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে এবং মুসলমানগণ পরস্পর রক্তপাত, হানাহানি ও ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিজেদের জানমাল ও অর্জিত সমর-শক্তির বিনাশ সাধনে লিপ্ত।
‘ওআইসি.’ নামক মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর সংস্থাভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর যে সব সদস্য পরস্পর আত্মকলহে লিপ্ত বিবদমান এসব রাষ্ট্রের জানমাল নিয়ে নানা স্থানে যে ‘হোলি খেলা’ চলছে ‘ওআইসি’ নীরবে তা উপভোগ করে অথবা নিন্দা প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু ফলাফল হয় শূন্য। বলতে গেলে ‘আত্মভোলা’ মুসলমানদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ, বিসংবাদ এবং অনৈক্য ঐ ক্রসধারীদেরকে নতুনভাবে যুদ্ধ উন্মাদনার খোরাক যোগাচ্ছে এবং মাঝে মধ্যে পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করতেও দেখা যায়।
তুর্কি প্রেসিডেন্টের মুখে ধ্বনিত সতর্কবাণীর কথায় আসা যাক। তিনি বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির গতিধারা সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং এ গতিধারার সাথে তার নেতৃত্বে পরিচালিত তার দেশ তুরস্কও কোনো না কোনো প্রকারে জড়িত। তাছাড়া ঐতিহাসিক দিক থেকে তুরস্ক দুই শতাব্দী কাল ধরে স্থায়ী ক্রুসেড যুদ্ধগুলোরও একটি ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষ সাক্ষী। প্রধান ক্রুসেড যুদ্ধ ধর্মের নামেই পরিচালিত হয়েছিল এবং প্রায় সব যুদ্ধেই ক্রুসেডারদের পরাজয় ঘটেছিল। বর্তমান তুরস্ক সেই বিস্ময়কর বিজয় অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সুতরাং, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, অস্ট্রিয়ার পদক্ষেপ বিশ্বকে ধর্মযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, তখন বুঝতে হবে নব পর্যায়ে আরো একটি ক্রুসেড যুদ্ধের পদধ্বনি শুনা যাচ্ছে এবং সে যুদ্ধের ইন্ধনদাতা কি অস্ট্রিয়া হতে চায়? কেন না, রাষ্ট্রটি সম্প্রতি সেখানকার মুসলমানদের সাথে যে বিদ্বেষাত্মক আচরণ করে চলছে, বিক্ষুব্ধ মুসলমানগণ তা নীরবে মেনে নিতে পারবে না। তুর্কি প্রেসিডেন্ট বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন; ‘আমার ভয় হচ্ছে, তার (অস্ট্রিয়ার) এই পদক্ষেপ ক্রুস ও ক্রিসেন্টের মধ্যে যুদ্ধের জন্য বিশ্বকে পরিচালিত করতে পারে।’ ক্রুস ও ক্রিসেন্ট কি তা অনেকেরই জানা কথা। এরদোগান সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ক্রিসেন্ট প্রতীকটি ইসলামের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্য দিকে ক্রুস হচ্ছে খ্রিষ্টীয় প্রতীক। পরস্পরবিরোধী এ দুই প্রতীকের ইতিহাসের সাথে বহু রক্তাক্ত রণাঙ্গন জড়িত। তাই তুর্কি প্রেসিডেন্ট সেই রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অস্ট্রিয়া বিদেশে অর্থায়নে পরিচালিত সাতটি মসজিদ বন্ধ ও ৬০ জন ইমামকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তুরস্ক সরকার এবং বলেছে, এ সিদ্ধান্ত ইসলামবিদ্বেষী, বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছেন, এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ইসলামবিরোধী এবং তা ধর্মযুদ্ধের দিকে বিশ্বকে ধাবিত করতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেছেন। উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে অস্ট্রিয়ায় মুসলিম মহিলাদের প্রকাশ্য স্থানে পুরো মুখ ঢাকা নিকাব বা বোরকা পরা নিষিদ্ধ করা হয়। অস্ট্রিয়া সরকারের ইসলামবিরোধী এসব পদক্ষেপের জোরালো প্রতিবাদ সমালোচনা মুসলিম বিশ্বে তেমন দেখা না গেলেও তুরস্ক এ ব্যাপারে খুবই সোচ্চার। প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেন, অস্ট্রিয়া সরকার বলছে, ‘তারা আমাদের ধর্মীয় নেতাদের দেশটি থেকে বের করে দিতে যাচ্ছেন। আপনারা কি মনে করছেন যে, আপনাদের এই ধরনের পদক্ষেপে আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাব না?’ তিনি বলেন, ‘এর অর্থ হলো, আমরাও কিছু করতে যাচ্ছি।’ তিনি ‘কিছু’ কি করতে যাচ্ছেন সে ব্যাপারে কিছু বলেননি। অস্ট্রিয়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে এত বড় একটি ঘটনা সরকারিভাবে ঘটানো হলো অথচ এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মুসলমানদের মধ্যে তুরস্ক ব্যতীত অপর কোনো মুসলিম দেশে তেমন পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানা যায় না। এটি মুসলিম অনুভ‚তির করুণ দশা ছাড়া আর কি হতে পারে? সারা বিশ্বে নবপর্যায়ে মুসলিম পূনর্জাগরণ পরিস্থিতির ওপর ইসলামবিদ্বেষী শক্তিবর্গের তীক্ষ দৃষ্টি থাকলেও ‘আত্মভোলা’ মুসলমানগণ ‘কানে তুলো গুঁজে মুখে কসটেপ’ লাগিয়ে নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে বললে কি অযৌক্তিক হবে?
ওরা দেখছে ইসলামের নব উত্থান ঠেকাতে হলে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে এমনভাবে আঘাত করতে হবে, যাতে তারা একটু হলেও নড়েচড়ে উঠে এবং তাদের সেই স্বাভাবিক আবেগ উত্তেজনাকে সম্বল করে, মুসলিম অনৈক্যের সুযোগকে তারা কাজে লাগাবে। তাই দেখা যাচ্ছে দুনিয়ার বহু অমুসলিম দেশের নানা স্থানে বহু মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার হিড়িক এবং বিভিন্ন রাজ পরিবারের নারী-পুরুষসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাবলি ইসলামবিদ্বেষী ওই শক্তিবর্গের জন্য চক্ষুশূল হয়ে দেখা দিয়েছে। এ মোশরেক, ইহুদি-খ্রিষ্টান, মজুসি শক্তিবর্গ নানা দেশ থেকে মুসলিম বিতাড়ন, নিধন, মুসলমানদের মসজিদ-মাদরাসা ও মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো, মসজিদে আজান, নামাজ নিষিদ্ধ, মুসলিম মহিলা নির্যাতন, বোরকা-নিকাব পরা, গরু কোরবানি নিষিদ্ধ ইত্যাদি ইসলামবিরোধী ধ্বংসাত্মক তৎপরতা বহু আগে থেকেই চালু করা হয়েছে। এমনকি নানাভাবে ইসলাম নবী রাসূল (সা:) এবং আল্লাহর কালাম আল কুরআনের বিকৃতি-অবমাননা বিভিন্ন স্থানে অহরহ চলছে। গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব মুসলিম নিধনযজ্ঞ ও নির্যাতন তৎপরতা বিশ^বাসীর সামনে। উদাহরণত কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনার আভাস দেয়া যায়। যেমন- মিয়ানমারের বর্গি বৌদ্ধ অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর বিস্তারিত বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। অন্য দিকে আসাম থেকেও বাঙালি মুসলিম ‘খেদাও’ অভিযানের শিকার হয়ে শরণার্থীদের ঢল বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে এনজিও কর্তৃক ধর্মান্তর তৎপরতার অভিযোগও রয়েছে। মানবতার নামে এ অপতৎপরতা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা প্রভৃতি স্থানে আরো ব্যাপক আকার ধারণ করার মর্মান্তিক খবরাখবর ঘটনাবলি কারো অজানা নয়।
তথাকথিত সম্প্রীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবিদার দেশের নানা স্থানে মুসলিম ও মহিলা নির্যাতন অপমানের অবিশ্বাস্য ঘটনাবলি আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোর শোভা বর্ধন করছে। ভারতের ‘গুরুগ্রমে’ ৮৮টি স্থানে নামাজ পড়া সাম্প্রদায়িক বাধার মুখে বন্ধ হয়ে গেছে। আজান নিষিদ্ধ ও মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাবলি নতুন নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার খবরে জানা যায়, সেখানে ইমামকে হত্যা এবং মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হিজাব পরায় এক মুসলিম মডেল চাকরি হারিয়েছেন। অস্ট্রিয়ার বর্ণিত ঘটনা আরো প্রমাণ করে দিলো যে, সেখান থেকে মসজিদের ইমাম বিতাড়ন ও মসজিদ ধ্বংস ইত্যাদি অপতৎপরতার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভ‚তিতে মারাত্মকভাবে আঘাত করা উদ্দেশ্য।
ধর্মীয় সম্প্রীতি নিরাপত্তার প্রতীক শান্তিময় ইসলাম উত্তেজনা, অরাজকতা, অশান্তি, বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেয় না এবং অবৈধ জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে। আক্রান্ত না হলে ইসলাম আক্রমণ সমর্থন করে না। অস্ট্রিয়ার উস্কানিমূলক ভ‚মিকার প্রতিবাদে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সতর্কবাণী সেই দেশের ক্ষমতাধরদের কর্ণক‚হরে পৌঁছাবে কি না জানি না, তবে সতর্কবাণীটি অস্ট্রিয়া হৃদয়ঙ্গম করলে তা হবে শুভ বুদ্ধির পরিচায়ক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।