Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোটা সংস্কারের আন্দোলন, কর্মসংস্থান এবং মানবিক সমাজের প্রত্যাশা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

এক দশকের বেশী কাল ধরে দেশের রাজনীতিতে যে গুমোট আতঙ্ক, অধিকারের নিয়ন্ত্রণ এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চরম অবক্ষয় চলছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার দাবীর আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছে। কোটা সংস্কারের দাবী খুব নতুন বিষয় না হলেও গত এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন সারাদেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ার পর কার্যত তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তবে চুড়ান্ত বিচারে এবং ইতিবাচক অর্থে এই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি সরকারের হাতেই ছিল এবং আছে। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সব দল ও ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ থাকলেও আন্দোলন দমনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগ এবং সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনগুলো শুরুতেই আন্দোলন দমনে সব রকমের চেষ্টাই করেছে। অবশেষে জাতিয় সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা প্রথা বাতিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষনাটি ছিল কোটা সংস্কারের অপ্রতিরোধ্য আন্দোলনের আগুনে পানি ঢেলে দেয়ার মত। এর আগে সরকারের প্রতিনিধি, মন্ত্রী-এমপিদের আলোচনা এবং আশ্বাস কোটা সংস্কারের আন্দোলনের নেতাদের মন গলাতে পারেনি। তারা প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবী করেছিল। প্রধানমন্ত্রী তাদের সেই দাবীকে মূল্য দিয়ে জাতীয় সংসদে কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষনা দেয়ার পর কোটা আন্দোলনের বেশীর ভাগ অংশ চুপসে গেলেও কারো কারো মধ্যে তখনো সংশয় সন্দেহ কাজ করেছিল। কেউ কেউ প্রজ্ঞাপণ জারি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের মাঠ ত্যাগ না করার পক্ষেও অনড় ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণা প্রকাশিত হওয়ার পর ইতিমধ্যে প্রায় তিনমাস অতিবাহিত হয়েছে। এখনো কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ঘোষণার কোন প্রজ্ঞাপণ জারি হয়নি। এ কারণে ঈদুল ফিতরের পর তারা আবারো রাজপথে নেমে আসার পর কোটা আন্দোলন নিয়ে সরকার ও সরকারীদলের অবস্থান নতুন মাত্রায় জাতির সামনে ধরা পড়েছে। ঈদের আগেও কোটা আন্দোলনের নেতাদের নানা রকম পুলিশি হয়রানি চেষ্টার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা গেছে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী এবং কোটি সমর্থক ক্যাম্পাসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ায় শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে এ ধরনের আন্দোলন দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া কোটা সংস্কারের দাবীর যৌক্তিকতা কেউ অস্বীকার করতে পারেনা। উল্লেখ্য কোটা বিরোধিদের দাবী কোটা বাতিল করা নয়, মেধাবীদের জায়গা দিতে তা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা। কোন অযৌক্তিক দাবীর সাথে যত মানুষই সম্পৃক্ত হোক, তাতে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মত হওয়ার কোন কারণ নেই, থাকতে পারেনা। অনেকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেকটা রাগ করেই কোটা প্রথা বাতিলের ঘোষনা দিয়েছিলেন। রাগ, অনুরাগ থাকতেই পারে। এবং কোটার প্রজ্ঞাপণ জারিসহ চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে বিদ্যমান আইনী প্রক্রিয়ায় আরো সময় নেয়ারও সঙ্গত বাস্তবতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুনিদ্দির্ষ্ট ঘোষণা ও সময়সীমা নির্ধারণ করাই যথেষ্ট ছিল। তা না করে সরকারের একেক জনের একেক রকম বক্তব্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে সহায়ক ভ‚মিকা রেখেছে। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর ছাত্রলীগের মারমুখী, নির্মম, নৃশংস ভ‚মিকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
কোটা সংস্কার দাবীর দ্বিতীয় ধাপের আন্দোলনকারীদের উপর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থী অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের উপর ছাত্রলীগের বেধড়ক হামলার পর ছত্রভঙ্গ আন্দোলনকারিদের উপর নির্মম আক্রমনের প্রতিবাদ আরো বেশী সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীর মধ্যে সংক্রমিত হতে দেখা গেছে। এই সংক্রমণ যতটা না মাঠের লড়াইয়ে তার চেয়ে অনেক বেশী দেখা গেছে ভার্চুয়াল জগতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কোটা আন্দোলনকারিদের উপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের উপর আরো বেশী নির্মম-নৃশংস হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজশাহীতে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর আক্রমনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মধ্য দিয়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলন এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী চরিত্র নতুন মাত্রায় আলোচিত হচ্ছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের শ্লীলতাহানী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুলকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পঙ্গু করে দেয়ার ভিডিও ক্লিপিংসগুলো যেন কোন অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার নির্মম দৃশ্যকল্প। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এসব শিক্ষার্থীদের বেশীরভাগই প্রধানত মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে এ-প্লাস বা গোল্ডেন জিপিএ লাভ করে আসা একেকটি সন্তানের উপর পরিবারের মনোযোগ, বিনিয়োগ ও প্রত্যাশা অনেক বেশী। একটি সরকারী চাকুরী যেন সোনার হরিণ। প্রথমত: পদের শতকরা ৫৬ ভাগই কোটার দ্বারা সংরক্ষিত। শুধুমাত্র কোটাধারিদের মধ্যেই প্রতিযোগিতার সুযোগ। সাধারণ মেধাবীরা সেখানে অবাঞ্ছিত। কোটার বাইরে থাকা বাকি ৪৪ ভাগ পদের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন দেশের কোটি কোটি চাকুরী প্রত্যাশী। সেখানেও অঘোষিতভাবে জারি করা আছে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা, পুলিশ ভেরিফিকেশন, রাজনৈতিক পরিচয়, গোপণ লেনদেন ইত্যাদি ডিঙ্গিয়ে সরকারী চাকুরী পাওয়ার পর একেকজন সরকারী কর্মকর্তা আর সাধারণ মানুষ থাকেন না। চাকুরী অর্জন, পদায়ণ, পদন্নোতির ধাপগুলো পার হতে হতে তারা একেকজন অতিমানব অথবা মানবেতর প্রাণীতে পরিনত হন। কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মাধমে সরকারী চাকুরীতে সাধারণের প্রবেশের পথ আরো সহজ ও প্রশ্বস্ত করা সম্ভব হলে জনপ্রশাসনের কাছে জনগনের প্রত্যাশিত সেবার মান আরো অনেক বাড়তো। কোটা ব্যবস্থার বাড়াবাড়ির ফলে মেধাবীরা সরকারী চাকুরী বঞ্চিত হওয়ার কুপ্রভাব ক্রমেই প্রবলতর রূপ লাভ করেছে। গত এক দশকের বেশী সময় ধরে দেশে কাঙ্খিত বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংকিং সেক্টরে কেলেঙ্কারি ও লুটপাটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বেহাত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সযোগও ক্রমে সঙ্কুচিত হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপ লাঘবে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করা সম্ভব না হলেও বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে ধুকে মরা এবং দেশে ভাল চাকুরী, কর্মসংস্থান বা কাঙ্খিত জীবনমান উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় দেশত্যাগ করে অভিবাসি হওয়ার মধ্য দিয়েই স্বপ্ন পুরণের পথ বেছে নিয়েছে দেশের লাখ লাখ যুবক। অন্যদিকে গার্মেন্টস শিল্পসহ দেশের রফতানীমুখী শিল্পে নিয়োজিত শ্রমশক্তির এক বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে ভারতীয় শ্রমিকরা। ভারতীয় শ্রমিক নিয়োগের অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, এসব সেক্টরে দেশে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলো থেকে পাস করা লাখ লাখ শিক্ষার্থী চাকুরী পাচ্ছেন না সেখানে দেশের সীমিত কর্মসংস্থানের উচ্চ বেতনের পদগুলোতে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে ভারতীয়দের। এভাবেই বছরে দেশ থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ভারতে চলে যাচ্ছে। দেশের প্রায় এক কোটি অভিবাসি শ্রমিক বিদেশ থেকে বছরে যে ১৪-১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠায়, বৈধ-অবৈধ কয়েক লাখ ভারতীয় শ্রমিকের মাধ্যমে তার প্রায় অর্ধেকই এভাবে ভারতে চলে যাচ্ছে। কোটা প্রথা সংস্কারের পাশাপাশি এখন ভারতীয় শ্রমিক বিতাড়নের একটি দাবীও সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে আসতে শুরু করেছে।
এই মুহূর্তে দেশের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। গত বছর বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৮ লাখ মানুষ নতুন করে চাকুরী প্রার্থীর তালিকায় যুক্ত হচ্ছে আর বছরে প্রায় ৫ লাখ তরুন চাকুরীর জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।একদিকে বাংলাদেশের মেধাবী তরুণরা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত শিক্ষা ও গবেষনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চমক লাগানো উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকরাও বিদেশের মাটিতে উন্নয়ন কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করে চলেছে। এই জনশক্তিকে দেশের উন্নয়নে সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতি অনেক আগেই মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্ভব ছিল। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর ও অকার্যকর করে তোলার মধ্য দিয়ে আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে যেমন দুর্বল করে ফেলা হয়েছে, পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের বাজারকেও ভারতীয় শ্রমিক ও জনশক্তি নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। ভারতীয় বাংলাভাষি শ্রমিকরা যখন আমাদের ফ্যাক্টরী ও কর্পোরেট কোম্পানীগুলোতে উচ্চ বেতনে কাজ করে কোটি শ্রমিকের কষ্টার্জিত ডলারের এক বড় অংশ ভারতে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তখন আমাদের বেকার যুবকরা ১০-১৫ হাজার টাকা বেতনের একটি চাকুরীর জন্য জুতার তলা ক্ষয় করে ব্যর্থ হচ্ছে। এই বেকার ও হতাশ তরুনদের একটি অংশ জীবন বাজি রেখে অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, মাদকাসক্ত অথবা মাদক ব্যবসায় সহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ভুয়া পাসপোর্ট ও আইডি কার্ড নিয়ে কোন কোন সেক্টরের সরকারী চাকুরীতে বিদেশী নাগরিকরা যোগ দিচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নও ইতিপূর্বে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসেছে। আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। দেশেও বিনিয়োগের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় লাখ লাখ শিক্ষিত সংক্ষুব্ধ চাকুরী প্রার্থী, আগামী বছরগুলোতে সরকারী চাকুরীর বাজারে প্রবেশের প্রত্যাশায় বুক বাঁধা তরুনরা কোটা প্রথা সংস্কারের আন্দোলনে সক্রিয় অথবা নৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, দেশে যে পরিমান বেকারত্ব ও চাকুরী প্রত্যাশী মানুষ আছে সরকারী চাকুরীর সুযোগ তার তুলনায় অনেক কম। এ ক্ষেত্রে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নাই। সম্প্রতি ঘোষিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। বাজেটে বরাবরের মত বিনিয়োগ সহায়ক কিছু পদক্ষেপের কথা বলা হলেও দেশে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ না থাকায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এসব পদক্ষেপ তেমন কোন কাজে আসছেনা। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে দেশের একজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড, এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন,দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আসে বেসরকারী খাত থেকে। কিন্তু চলতি এই অর্থবছরে বেসরকারী বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। আগামী অর্থবছরেও বিনিয়োগ বাড়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বেনা। বিনিয়োগ বাড়াতে যে ধরনের সংস্কার ও উৎসাহমূলক পদক্ষেপ দরকার, এই বাজেটে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। এমনকি প্রস্তাবিত উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিয়েও অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।
দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নেই, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নেই, সরকারী বাহিনীগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। একইভাবে সরকারীদলের ছাত্র সংগঠনসহ অংগ সংগঠনের নেতাকর্মীরাও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে পুরো সমাজকে বিচ্যুত করেই ক্ষান্ত হচ্ছেনা, নিজেদের মধ্যে মারামারি- খুনোখুনি করার সাথে সাথে মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক সমাজের উপর বর্বর অমানবিক আঘাত হেনে চলেছে। আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বিলুপ্তির ঘোষণাকে আমরা কোটা সংস্কারের দাবীর প্রতি তার সমর্থন হিসেবেই ধরে নিতে পারি। তাহলে কোটা বিলুপ্তির গ্যাজেট প্রকাশের দাবীর শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে গায়ের জোরে দমনের এই ঘৃন্য ব্যবস্থা কেন? কোটা আন্দোলনকারিদের উপর ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশের গ্রেফতার ও দমনাভিযানের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচিকে আরো নজিরবিহিন ত্রাস ও সহিংসতা দিয়ে দমনের পন্থা কেন নেয়া হল? কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাহস করা হলেও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের হাড় ভেঙ্গে দেয়ার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উপরন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি স্তম্ভকেই দুর্বল ও অকার্যকর করে তোলা হচ্ছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সঙ্গত কারণেই শুরুতে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে ছাত্রলীগসহ সব রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণ ছিল। এর সাথে দেশের বর্তমান ও আগামীর শিক্ষিত যুব সমাজের মৌলিক স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে। আর যে আন্দোলন দমনে পুলিশি হয়রানি, গ্রেফতার ও রিমান্ডের মত ঘটনার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে দাঁড়াতেই না দেয়ার যে বাস্তব দৃশ্যের অবতারনা হয়েছে তাতে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজের দাবী দূরের কথা নিজেদের সভ্য সমাজের অংশিদার বলেও দাবী করতে পারিনা। তবে আচমকা হামলা করে কোন ন্যায্য দাবীর আন্দোলনকে দাবিয়ে রাখার মত উদ্ভট চিন্তার ফল সংশ্লিষ্টদের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য। এতদিন কোটা আন্দোলনে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাই অংশগ্রহণ করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের কোটা আন্দোলনের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার পর তা দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা, গ্রেফতার-নির্যাতন ও রাজশাহীতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তরিকুলের পা ভেঙ্গে দেয়া বিরুদ্ধে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমনা শিক্ষকরাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এই সমাবেশে অংশগ্রহন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামাল বলেন, ‘১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় অধিকাংশ মানুষই ছিল দর্শক। তারা মনে করেনি পলাশীর যুদ্ধে বাঙালীরা জিতবে। এ কারণেই পলাশিতে বাঙ্গালী পরাজিত হয়ে দুইশ বছর বৃটিশের গোলামী করেছি। আজও তাই দেখছি। কোটার মত ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অধিকাংশরাই দর্শক। বলে রাখছি, এই কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সবাই যদি অংশ না নেন তবে আমরা ফের পিছিয়ে যাবো।’ সরকারী চাকুরীতে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠি ও অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায়না। এ কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের সাধারণ দায়িত্ব। তবে সরকারী চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-পুতিদের কোটা সমাজে একটি মিশ্র বিতর্কিত প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবারের জন্য সম্মানী ভাতাসহ নানা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে মতবিরোধ নেই। যেখানে দেশের লাখ লাখ মেধাবী যুবক কাঙ্খিত সরকারী চাকুরী না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধার ভুঁয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অসংখ্য মানুষ নানা পদে চাকুরী বাগিয়ে নিয়েছে। মেধা ও কর্মদক্ষতায় নি:সন্দেহে প্রতিযোগিতামূলক মেধাবীদের চেয়ে কোটাধারীরা অনেক পিছিয়ে থাকার কথা। আজকের আমলাতন্ত্র, জনপ্রশাসন বা পাবলিক সার্ভিসে সেই অদক্ষতা ও মেধাহীনতার ছাপ সুস্পষ্ট। বেসরকারী বিনিয়োগ ও ব্যক্তি উদ্যোগে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর, পুঁজিবাজার, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাসহ সর্বত্র যে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তাতে জাতির অনেক সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কোটা, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষবাণিজ্যের কারণে সরকারী চাকুরীতে সৎ ও মেধাবীদের প্রবেশের সুযোগ খুব সীমিত হয়ে পড়ায় মেধাবী শিক্ষিত প্রজন্ম হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে যোগ্য ও মেধাবী মানবসম্পদকে বঞ্চনা ও হতাশার মধ্যে ঠেলে দিয়ে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জাতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন পুরণ অসম্ভব। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে সুশাসন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রথমেই কোটা ব্যবস্থার সময়োপযোগি সংস্কার প্রয়োজন।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোটা সংস্কার

২৭ আগস্ট, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ