বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামী খেলাফতের রাজধানী। এক কসাই পশু জবাই করে ফেরার পথে একটু নিরব জায়গায় প্রস্রাব করতে বসলো। সাথে তার রক্ত মাখা ছুরি। অল্প দূরেই পড়ে ছিল একটি যুবকের গলাকাটা লাশ। পথচারীরা লাশ দেখে বিষ্মিত। কে এই অজ্ঞাত পরিচয় যুবককে জবাই করে লাশ এখানে ফেলে গেছে? তারা কথা বলাবলির সময়ই দেখতে পেল অদূরেই একলোক রক্ত মাখা ছুরি হাতে প্রস্রাব করে উঠে চলে যাচ্ছে। আর যায় কই? লোকেরা কসাইকে ধরে খলীফার দরবারে নিয়ে গেল। হযরত আলী রা. তখন ইসলামী খেলাফতের প্রধান বিচারপতি। কসাইকে বন্দী করা হলো। সে যেভাবে বলা সম্ভব আদালতকে নিজের নির্দোষতা সম্পর্কে বলতেই থাকলো। আর ওদিকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। তাদের কথা যেহেতু আমাদের আর কারও সম্পর্কে সন্দেহ নাই, সুতরাং যাকে অকুস্থলে পাওয়া গেছে সেই অপরাধী। কসাই তার সপক্ষে কোনো প্রমাণই দিতে পারলো না। এটি ছিল একটি জটিল মামলা। কসাই এর পরিবার এত সম্পদশালী ছিল না যে, মৃতের আত্মীয় স্বজনকে রক্তপণ দিয়ে কসাইকে বাঁচাবে। হযরত আলী রা. এ চেষ্টা সফল করার জন্য উভয় পক্ষকে বোঝালেন, সরকারী কোষাগার থেকে রক্তপণ দেওয়ার প্রস্তাব করলেন, কিন্তু মৃত যুবকের বংশ ছিল ধনী ও অভিজাত। তারা কসাই এর মৃত্যুদন্ড ছাড়া আর কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। নবী করিম সা. এর চতুর্থ খলীফা মহাজ্ঞানী ও আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হযরত আলী রা. আইনের কারণে বাধ্য হয়ে কসাই এর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নির্দেশ দিলেন। যদিও কসাই পরিবারের অবস্থা তাকে খুবই পীড়া দিচ্ছিল। মৃত যুবকের বংশের অনমনীয়তাও ছিল বিব্রতকর। বিচারকের হাত পা থাকে বাধা। মনে না চাইলেও, অনেক কিছু বুঝলেও তাকে কাজ করতে হয় প্রমাণাদির আলোকে। যথারীতি মদীনার খোলা মাঠে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ব্যবস্থা হলো। লোকজন অনেক জমেছে, চারপাশে দর্শক মাঝখানে নিরাপরাধ কসাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। শিরোশ্চেছদকারী তরবারি উঁচিয়ে ধরেছেন, কোপ বসাবেন। ঠিক এই মুহূর্তে ভীড় থেকে একব্যক্তি বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলো, মুসলিম ভাইয়েরা এই কসাই খুনি নয়। খুন আমি করেছি। তরবারি নামিয়ে জল্লাদ নিরব। কসাই হতভম্ভ। বিচার বিভাগের লোকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিষয়টি হযরত আলী রা. এর কাছে গেলে তিনি বিচারকার্য দু’দিন পিছিয়ে দিলেন। আত্মস্বীকৃত ব্যক্তিকে আটক করা হলো। পরদিন আদালতে এ ব্যক্তি জবানবন্দীতে বললো, মৃত যুবকের সাথে তার শত্রæতা ছিল, তারা একে অপরকে হত্যা করতে চাইতো। ঘটনার দিন ভোরে সেই তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায়। বেচারা কসাই অবস্থার ফেরে পড়ে আটকে যায়। বাঁচার কোনো পথ তার ছিল না। হযরত আলী বললেন, তুমি তো বেঁচেই গিয়েছিলে। আর এক মুহূর্ত নিরব থাকলেই তো কসাই মারা যেত। মামলাও শেষ হয়ে যেত। তুমি কেন কথা বলতে গেলে। জবাবে খুনি যুবক বললো, আমি এমনিতেই একজনের খুনি। আমার সামনে আমার খুনের অপরাধে আরেকজন নিরপরাধ ও অসহায় মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে, এ বোঝা আমি কী করে বহন করবো। এ ভার আমি কী করে সইবো। দুনিয়ার বিচার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু যেদিন আল্লাহর সামনে আমাকে হাজির করা হবে, সেদিন আমার কী জবাব হবে। এসব ভেবে আমি চুপ থাকতে পারিনি। হযরত আলী রা. আজকের মতো আদালত মুলতবি করে দিলেন। পরদিন বিশিষ্ট সাহাবীদের নিয়ে তিনি পরামর্শে বসলেন। কোরআন ও হাদীসের আলোকে মত প্রকাশ করলেন বিশিষ্টজনেরা। নানারকম মতামত এলো। পরামর্শ শেষে তিনি যখন রায় দিবেন, তখন হযরত ইমাম হোসাইন রা. বললেন, আমার মতে কসাইকে তো বেকসুর খালাস দিতেই হয়। এমনকি সম্ভব হলে এই সত্য উচ্চারী যুবককেও প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া চলে। কারণ, কোরআনের বিধানেই তার মৃত্যুদন্ড হতে হয়। আবার কোরআনেরই আরেক আয়াতের আলোকে তার প্রাণ রক্ষাও করা যায়। যেখানে মহান আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি একটি মানুষ হত্যা করেছে, সে যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করলো। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি একটি প্রাণ রক্ষা করলো, সে যেন পুরো মানবজাতিরই প্রাণ রক্ষা করলো।- আল কোরআন। এখানে এই যুবক যেমন একটি প্রাণ নষ্ট করেছে, তেমনি বিবেকের তাড়নায় সত্য স্বীকার করে একটি অসহায় প্রাণকে রক্ষাও করেছে। এ ব্যাখ্যাটি উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামের মনে ধরলো। তারা হযরত আলী রা. কে এর আলোকে রায় দেওয়ার অনুরোধ করলেন। তখন মৃত যুবকের আত্মীয় স্বজনও এ বিষয়ে নমনীয় হয়ে গেল। হযরত আলী রা. কসাইকে তার সৌভাগ্যের জন্য মোবারকবাদ দিলেন এবং কোষাগার থেকে কল্যাণমূলক কিছু সহায়তাও দিলেন। হত্যা না করেও মৃত্যুদন্ড পাওয়া এবং অতঃপর গায়েবী মদদে মুক্ত হওয়া মূলত মহান আল্লাহকে ভয় পাওয়ারই ফল। যা মানুষকে সকল প্রকার অন্যায়, অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।