বাংলা সন ও নববর্ষ
বাংলাদেশের একটি নিজস্ব সন আছে, যা ‘বাংলা সন’ হিসেবে অভিহিত। এই সনের প্রথম মাস বৈশাখের
এমাজউদ্দীন আহমদ
নববর্ষের এই দিনে সবার জন্যে রইলো শুভেচ্ছা, প্রাণঢালা শুভ নববর্ষ। এই জনপদ জীবনের জয়গানে মুখর হয়ে উঠুক, সকল প্রতিবন্ধকতার জটিল জাল ছিন্ন করে জীবন বলিষ্ঠ হয়ে উঠুক, সুষ্ঠু জীবনবোধ প্রতিষ্ঠিত হোক- এই দিনে তাই আমাদের কামনা। সমাজের সকল স্তরে ধনী-নির্ধন-নির্বিশেষে, মানবতার বিজয় ঘোষিত হোক। তাই হোক এই দিনের শ্লোগান। জীবন মানেই যে যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের কাক্সিক্ষত পরিণতি যে বিজয়, তা যেন সবার অহঙ্কারে পরিণত হয়- তাই হোক এই দিনের কামনা।
কিন্তু কামনা করলে কি হবে, যে পরিবেশে জীবন আমাদের কাজ ক্লান্ত, শ্রান্ত, নিঃশেষ প্রায়, সে পরিবেশও রয়েছে সমগ্র স্মৃতিজুড়ে। পুরনো বছরটা শেষ হয়েছে বটে, কিন্তু শেষ হয়নি বছরব্যাপী যন্ত্রণার রেশ। বৈশাখ এসেছে বটে, কিন্তু চৈত্রের দাবদাহের চ-তার অনুভব এখনো শেষ হয়নি। চারপাশে যেসব হিংস্র হায়েনা প্রশান্ত জীবনের মাংস-মেদকে খুবলে খুবলে রক্তাক্ত করেছে, তাদের আস্ফালন এখনো থামেনি। এখনো তাদের পৈশাচিক উল্লাসে চারদিক থমথমে। পয়লা বৈশাখ তাই সেই চিরন্তন প্রশ্ন নিয়েই উপস্থিত হয়েছে আমাদের দোরগোড়ায়। কীভাবে জীবন জীবন্ত থাকবে? কীভাবে মানুষ পৌঁছবে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে ? রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে আহ্বান জানিয়েছেন তার গেরুয়া বস্ত্রাঞ্চল দ্বারা এসব হিংস্র হায়েনা শ্বাপদদের ঢেকে দিতে।
“তোমার গেরুয়া বস্ত্রাঞ্চল
দাও পাতি নভস্তলে বিশাল বৈরাগ্যে আবরিয়া
জরা মৃত্যু ক্ষুধা তৃষ্ণা, লক্ষ কোটি নরনারী হিয়া
চিন্তায় বিকল-
দাও পাতি গেরুয়া অঞ্চল।”
কাজী নজরুল ইসলাম সম্ভবত এমনি পরিস্থিতিতেই সবাইকে পথের দিশা দিয়ে লিখেছেন :
“চারিদিকে এই গু-া এবং বদমায়েশির আখড়া দিয়ে
রে অগ্রদূত চলতে কি তুই পারবি
আপন প্রাণ বাঁচিয়ে ?
পারবি যেতে ভেদ করে এই বক্র পথের চক্রব্যুহ ?
উঠবি কী তুই পাষাণ ফুঁড়ে বনস্পতি মহীরুহ ?”
চিরন্তনী এসব প্রশ্ন নিয়ে পহেলা বৈশাখ এসেছে আমাদের ঘরে ঘরে। ডাক দিয়েছে সকলকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যের মূলধনকে সচল করে জীবনযুদ্ধে জয়লাভের প্রেরণার ডালা সাজিয়ে।
জীবন মানে অন্ন-বস্ত্রের মতো পার্থিব সম্ভার যেমন, পরিশীলিত মন-মানসিকতার অলঙ্কারস্বরূপ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও তেমনি। দুই-এ মিলেই জীবন এবং জীবনের সৌন্দর্য। আমাদের সমাজের উভয় ক্ষেত্রেই হিংস্র শত্রুর দৃপ্ত পদচারণা। একদিকে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অসহায়ত্ব জীবনটাকে যেমন করে তুলেছে ন্যুব্জ, অন্যদিকে ছোঁয়াচে দাদ-পাঁচড়ার অপ-সংস্কৃতিও জীবনবোধকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। বিশেষ করে যে তারুণ্যের মধ্য দিয়ে আমরা হাজার বছর বেঁচে থাকতে চাচ্ছি, তাকে পরাশ্রয়ী এবং নির্ভরশীল করে চলেছে। নববর্ষের এই শুভ মুহূর্তে সেদিকেও দৃষ্টিপাত হওয়া ভাল সকলের।
আদান-প্রদানে দোষ নেই; বরং আদান-প্রদানের মাধ্যমেই জীবন সমৃদ্ধ হয়। যে ক্ষেত্রে আমার ঘাটতি রয়েছে অন্য জন বা অন্য স্থান থেকে উদারভাবে গ্রহণ করে আমরা তা পূরণ করতে পারি। কিন্তু আমি কিছু না দিয়ে শুধু গ্রহণ করলে, সে হাত হয়ে উঠবে ভিক্ষুকের এবং ভিক্ষুকের হাত কোনো সময় মর্যাদাপূর্ণ নয়। যিনি দিতে পারেন, তিনিই শুধু অপরের নিকট থেকে গ্রহণ করতে পারেন। এ কারণেই আত্মসম্মানসম্পন্ন ব্যক্তি বা জাতি নিজেদের অতীত অবস্থানে গৌরববোধ করে। এবং অতীত ঐতিহ্যের গৌরবময় স্মৃতি স্মরণ করে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে নিরস্ত হয়। এই দিনে আমাদের, বিশেষ করে, আমাদের তরুণ-তরুণীদের, একথা স্মরণে রাখা ভাল।
পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজে নববর্ষের মতো দিন শুধু উৎসবের। আমাদের সমাজে এটা একদিকে যেমন উৎসবের, অন্যদিকে তেমনি সচেতনভাবে অতীত দর্শনের। কৃষি উৎপাদন-মৌসুমের প্রাচুর্যের ভিত্তিতে গড়া নববর্ষের আনন্দ একদিকে যেমন মিষ্টিমুখ করার, অন্যদিকে তেমনি সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনের চারপাশে নিজস্ব ঢং-এ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে জীবনটাকে এক উপভোগ্য কলায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগও। এজন্য এই দিনে উৎসব যতটুকু তাৎপর্যপূর্ণ, অন্যদিকে আত্মসচেতন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনমুখী হওয়াও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার ঞযব জবঢ়ঁনষরপ গ্রন্থের তৃতীয় ভাগে বলেছেন, “স্টাইল, শ্রুতিমধুর, আবেদনপূর্ণ আকর্ষণ ও সুমধুর ছন্দের সৌন্দর্যের ভিত্তি হল সরলতা” (‘ইবধঁঃু ড়ভ ংঃুষব ধহফ যধৎসড়হু ধহফ মৎধপব ধহফ মড়ড়ফ ৎযুঃযস ফবঢ়বহফ ড়হ ংরসঢ়ষরপরঃু.’)। আমাদের সমাজে কিন্তু পরনির্ভরশীলতা ও অনুকরণপ্রিয়তার যে মচ্ছব শুরু হয়েছে, তাতে ভয় হয় নববর্ষের সহজ-সরল ও সনাতন রূপকে কৃত্রিমতার রং চড়িয়ে যারা জাতীয় এই দিনটাকে বিজাতীয় স্টাইলে পালনে উদ্যত, আমাদের তরুণ-তরুণীরা তাতে যেন গা ভাসিয়ে না দেয়।
এই দিনটির আবেদন সমগ্র সমাজের নিকট, বিশেষ করে, যারা উৎপাদনশীল উদ্যোগে নিয়োজিত হয়েছে, তাদের নিকট সবচেয়ে বেশি। উৎসব হিসেবে দিনটিকে পালন করেন সাড়ম্বরে প্রধানত সমাজে উৎপাদনকারীদের উৎপাদনে জোরপূর্বক ভাগ বসানো ব্যক্তিবর্গ। ভয়টা একারণেই বেশি। পয়লা বৈশাখের ভোরে সিল্কের শাড়ি ও পাজামা-পাঞ্জাবি পরা কিছু পান্তাভাত এবং ইলিশ মাছ ভাজা নিয়ে তারা বসে পড়েছেন : এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর জীবনে যেন প্রথমবারের মতো পাওয়া অমৃত নিঃশব্দে গলাধকরণ করেছেন পরম তৃপ্তির সাথে। খাওয়া শেষ করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে এপ্রান্তে ওপ্রান্তে দৃষ্টিকটু দৃশ্যের অবতারণা করছেন। অনেকের নিকট এটা হলো নববর্ষের উদযাপন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ স্থানে সকালে পান্তাভাত খেয়ে যারা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দিনের শেষে শ্রান্ত দেহে বাড়ি ফিরেও পেট ভরে খাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না, নববর্ষের অনুষ্ঠানটি আসলে তাদেরই। কিন্তু তাদের কথা ভাবি কী ? কে ভাবে তাদের কথা ? তাই কৃত্রিমতা দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের ভ-ামি এবং প্রতারণাকে চাপা দেবার চেষ্টা হয় অনেক সময়। নববর্ষের মতো শুভদিনেও তাই ভ-ামিই প্রধান হয়ে ওঠে।
এই সমাজের প্রায় অর্ধেকই বসবাস করেন দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে। জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক এখনো রয়ে গেছেন নিরক্ষর। তারুণ্যের বিরাট এক সংখ্যা বেকারত্ব অথবা আধা-বেকারত্বের অভিশাপে অভিশপ্ত। সরকার আসছেন, সরকার যাচ্ছেন, কিন্তু এই দারিদ্র্যপীড়িত, নিরক্ষর, অসহায় ও বঞ্চিতদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আসেনি। নববর্ষের এই দিনে সমাজের এই বৃহত্তর অংশে, বিশ্বখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়ারের (ডরষষরধস ঝযধশবংঢ়বৎব) কথায়, ‘হতভাগ্যদের জীবনের অন্য কোনো ওষুধ নেই, শুধু আশা ছাড়া।’ [ঞযব সরংবৎধনষব যধাব হড় ড়ঃযবৎ সবফরপরহব নঁঃ ড়হষু যড়ঢ়ব, -গবধংঁৎব ড়ভ গবধংঁৎব, ঢ়ধৎঃ ওওও খরহব ৩] নববর্ষের এই শুভদিনে এই হতভাগ্যদের জীবনে আশা ছাড়াও কিছু প্রাপ্তি ঘটুক- এটা কামনা করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।