বাংলা সন ও নববর্ষ
বাংলাদেশের একটি নিজস্ব সন আছে, যা ‘বাংলা সন’ হিসেবে অভিহিত। এই সনের প্রথম মাস বৈশাখের
মাহমুদ শাহ কোরেশী
ষাটের দশকে দীর্ঘ সময় প্যারিসে অতিবাহিত করার সুযোগ ঘটে আমার। কিন্তু সে সময় আমরা অল্প দু-চারজন মাত্র সে দেশে কিছুটা ব্যতিক্রমী পরিবেশে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকি। তাই ছুটিহীন নববর্ষ উদযাপনের কোনো প্রয়াস গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। হয়তো রাতে দু-তিন বন্ধু মিলে দেশি রান্নাবান্না করে সংক্ষিপ্ত আকারে উৎসব পালন করা হতো।
তবে একবার প্যারিসেই পয়লা বৈশাখ পালন বেশ জাঁকজমকভাবে করা সম্ভব হয়েছিল। সেটা ১৯৭৭ সালের কথা। আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা। সেটা সম্ভব হয়েছিল আমার ভারতীয় বাঙালি বন্ধুদের কল্যাণে।
ঢাকা থেকে আমি সরাসরি গিয়েছিলাম উত্তরের শহর স্তামবুর্গে, একটি ভাষাবিষয়ক সম্মেলনে। ফরাসি ভাষার শিক্ষকদের বিশ্বমিলনমেলা। তবে তার মধ্যে প্রথমবারের মতো একটা এশীয় কমিটিও গঠিত হলো। ঘটনাচক্রে আমার ইন্দোনেশীয় ও জাপানি দুই বন্ধুর প্রচেষ্টায় আমাকেই সভাপতির পদে নির্বাচিত করা হলো। এদিকে দীর্ঘ ১০ বছর পর প্যারিসে ইউনেস্কো থেকে আমার অনূদিত ‘পয়েম মিস্তিক বেঙ্গালি’ (বাংলা মরমি কবিতা) বইটি প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং বলাবাহুল্য, ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম। ভারতীয় বন্ধুদের মধ্যে ড. পাইন আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল সেই নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে। মনে পড়ে, এ উপলক্ষে ওরা একটা বিশেষ বাড়ি ভাড়া করেছিল। ওদিকে পাইন এর ক’বছর আগেই আমাকে বলে রেখেছিল যে, পরবর্তীকালে প্যারিসে এলে আমি যেন বাংলাদেশের প্রকাশিত কিছু বইপত্র নিয়ে আসি। তাই নিয়ে গিয়েছিলাম সেবার। বলাবাহুল্য, ফরাসি মুদ্রায় দামও দিয়ে দিয়েছিল ওরা। যা হোক, মজার ব্যাপার হচ্ছে, ষাটের দশকের হারানো বন্ধুদের অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে। লক্ষ্য করলাম সে সময় বাংলাদেশের বন্ধুরা যেখানে পড়াশোনা কিংবা টেকনিক্যাল ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিল, পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুরা চাকরি নিয়ে কিংবা বিয়ে করে সেখানে থেকে গিয়েছিল। যাদের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে, তাদের দুজন হলো ড. দীপ্তেন্দু বসু ও তার স্ত্রী ক্লোদ। অন্যজন অজিত দাস। তার স্ত্রী, নাম ভুলে গিয়েছি। অনুষ্ঠানের শুরুতে দীপ্তেন্দু বরাবরের মতো বেশ কয়েকটি রবীন্দ্র সংগীত গাইল। কয়েকজন ভারতীয় তরুণ-তরুণী গান ও নৃত্য পরিবেশন করল। বেশ জমজমাট সান্ধ্য অনুষ্ঠান বটে। এর মধ্যে বন্ধুরা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইল। আমি সংক্ষেপে একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটালাম। পরে বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দিলাম। রুচিপূর্ণভাবে হলঘর সাজানো ইত্যাদির কথা দিয়ে সর্বশেষে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কিছু রান্নার নমুনা পরিবেশিত হলোÑ খিচুড়ি, বেগুনভাজা, ডিম-মুরগি ভুনা, পায়েস ইত্যাদি।
এরপর দীর্ঘকাল আর যোগাযোগ থাকেনি। কেননা, আশির দশকে আমি প্যারিস গিয়েছি একবার মাত্র। ১৯৮২ সালে আফ্রিকা যাওয়া-আসার মাঝখানে ৩ রাত কাটিয়েছি। ১৯৯১ সালে অবশ্য সস্ত্রীক এক মাসের জন্য সেই আলোকদীপ্ত অনন্য নগরীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তখন ছিল শীতের সময় আর সতীর্থ ছিল স্বদেশী বন্ধুজন। তবে পুরনো বন্ধুদের নিয়ে বিদেশ বিভ‚ঁয়ে আকস্মিক পয়লা বৈশাখ উদযাপনের কথা বিস্মৃত হওয়া সম্ভব ছিল না। কোনোমতে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।