বাংলা সন ও নববর্ষ
বাংলাদেশের একটি নিজস্ব সন আছে, যা ‘বাংলা সন’ হিসেবে অভিহিত। এই সনের প্রথম মাস বৈশাখের
মাহমুদ শাহ কোরেশী
যৌবন শুরুর বছরগুলোতে প্রায় এক দশক পাশ্চাত্যে অবস্থানের ফলে অনেক কিছু দেখা, শেখা ও উপভোগের সুযোগ হয়েছিল। সুযোগের সঙ্গে দুর্যোগ কিংবা কোনো কিছু না-পাওয়ার বেদনা যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তবে সেসব বিষয় এখন পরিত্যাজ্য। আমরা আনন্দের মুহূর্তকেই বেশি স্মরণ করি এবং বারবার উল্লেখ করি। লন্ডন ও প্যারিসে আমার বড়দিন ও নববর্ষ উদযাপনের যে অবিরাম সুযোগ ঘটেছিল, ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে তার অবসান ঘটল। অবশ্য এরপর বহুবার তিন মাস কিংবা তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়েছি বিভিন্ন দেশে কিন্তু সে দুটো মহোৎসবের সুন্দর্শন আর মেলেনি কোনোবার।
কিন্তু আল্লাহর কী ইচ্ছা এবার অর্থাৎ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে আমার ৮৬ দিনের এক দীর্ঘ সফর নির্ধারিত হলো আমার কনিষ্ঠ পুত্র শাজেল ও তার স্ত্রী চিত্রার কল্যাণে এবং এর মধ্যে অবকাশ মিলে গেল বিলাতেই বড়দিন ও নববর্ষের শুভ মুহূর্তও বেশ অতিবাহিত করবার। শুধু কি তাই? তার সঙ্গে যোগ হলো আমাদের বিবাহবার্ষিকী। ছেলে-বউয়ের বিয়ের দিন এবং দুই নাতির জন্মদিন পড়ে গেল। তাহলে বুঝুন বিলাতে আমাদের আনন্দিত দিন যাপনের সীমা- পরিসীমা কতদূর বিস্তৃত। এর ওপর আছে তাদের দুজনের মোটামুটি ভালো চাকরি করা, সুন্দর একটা অসম্ভব রকমের সুবিধাজনক ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হওয়া। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করে ১০ বছরের পাসপোর্ট পাওয়া তো আছেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে সুন্দর পরিবেশ ও আনন্দমুখর কয়েকটা সপ্তাহান্ত কাটানোর বিষয়টা তো ডাল ভাত। আমাদের দিক থেকে প্রথমবারের মতো পর্তুগাল দর্শন, ১০ বছর পর প্যারিস প্রদক্ষিণ, আর স্থানীয় হাইতেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে বক্তৃতাদানের মর্যাদা লাভ আমার গৌরবগাথায় আরো কিছু বার্তা হয়তো ভরে যাবে। অন্যদিকে আমার দেখভালের জন্য স্বয়ং আরোপিত দায়িত্ব নিয়ে অর্ধাঙ্গিনী মহোদয়াও যথেষ্ট উপভোগ করেছেন বলে আমার ধারণা। এ ছাড়া রয়েছে অধ্যয়ন ও গবেষণার দুরূহ কর্তব্য সমাপন। আল্লাহ মেহেরবান!
যা হোক, এবার আসল বিষয়ে আসি। অর্থাৎ বিলাতে বড়দিন ও নববর্ষ কীভাবে উদযাপন করলাম তার কিঞ্চিত বর্ণনা দেওয়ার প্রয়াস পাই।
আমার ছেলের পাশের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন এক প্রবীণ সিংহলী ড. দেশনায়ক ও তার আইরিশ স্ত্রী সু। এত ভালো প্রতিবেশী যে হতে পারে কেউ, তা কল্পনা করা যায় না। আসলে মনে হয়, দুটো পরিবার একই। যখন খুশি, যা খুশি একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করে। ‘বাইপাস’- করা সিংহলী বৌদ্ধ ভদ্রলোক (অবশ্য দীর্ঘজীবন কাটিয়েছেন ইংল্যান্ডেই); তার বড় গাড়ি নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক ‘ড্রাইভ’ করে গ্যাটউইক বিমানবন্দর থেকে আমাদের মালপত্রসমেত ক্রেফোর্ডের বাসায় নিয়ে আসা আবার একইভাবে বিদায় দেওয়া, তার বিশেষ কৃতিত্ব। তাদের অবিবাহিত দুই পুত্রের একজন থাকে স্পেনের একটি ভিলায়। অন্যজন কাছেই সেই কেন্টেই। কাছের ছেলে ছিল মহারানীর বাবুর্চি-গোষ্ঠীর একজন। তবে বর্তমানে ওই পেশা ছেড়ে দোতলা বাসের ড্রাইভার পদে চাকরি করছেন তিনি। যার যেমন খুশি। অবশ্য বড়দিন ও বর্ষপূর্তির রাতের বিশেষ খাবারের অনেক পদের রান্নাটি তিনি করে তার বাসা থেকে এই বাসায় দিয়ে গেছেন। তারা দুজন এবং আমরা ছ’জন তৃপ্তির সাথে তা খেয়েছি। চিংড়ি, হাস ও খাশির বিভিন্ন আইটেম আর কিছু সবজি ও সালাদের পদ।
খাবারের আগে চলেছে দুপক্ষের উপহার বিনিময়। সে-এক আনন্দময় প্রহর। আমার ঢাকা এবং এভোরা (পর্তুগাল) থেকে তাদের দুজনের জন্য বিশেষ কিছু দ্রব্যাদি উপঢৌকনস্বরূপ নিয়ে গিয়েছিলাম। দুজনই এ জন্য খুব বিস্মিত।
বড়দিনের আগেই নাতি রাদের (ক্লাস নাইন) ছাদে বসে চার্লস ডিকেন্সের ক্রিসমাস বইটা পড়লাম। পড়লাম না বলে ল্যাপটপের প্লাস্টিকের কাচের পর্দায় দেখলাম বলাই ভালো। রাত ১১টায় শাজেল ও চিত্রা মাদাম সু ও আমাকে চার্চে নিয়ে গেল। আমি আসলে এই অভিজ্ঞতাটি আহরণ করতে চেয়েছিলাম। কারণ বহু আগে প্যারিসে নটর দাম (ঘঃৎব-উধসব)) ও পরদ্যর্লেওঁ (চড়ৎঃ ফ’ড়ৎষবড়হং)- দুটি গির্জায় অন্তত দুবার আমি এই প্রার্থনা সভায় শরিক হয়েছিলাম। এখন সেইন্ট অ্যান্ড সেলম’স-এর ডাটফোর্ড প্যারিসে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের অভিপ্রায় হলো। চার্চটি ছিল একটি মাঝারি আকারের চতষ্কোণ বাড়ি, ভেতরে সর্বত্র কাঠের কাজ, বহু বেঞ্চ, শ-পাঁচেকের জন্য আয়োজন। সম্ভবত সাড়ে তিনশ ভক্ত উপস্থিত। অধিকাংশই কালো, অল্প কয়েকজন বাদামি সাদা। পাদ্রী স্বয়ং আফ্রিকান। গায়ক-গায়িকারা ও কালো। পিয়ানো বাদক সম্ভবত ইংরেজ সাহেব।
বহু আনুষ্ঠানিকতার এবং বক্তৃতার মধ্যে গানের জন্য অসংখ্যবার ওঠা-নামা করতে করতে হাঁফিয়ে উঠলাম। সু আর আমি রয়েছি প্রার্থনায়। সু (প্রায় ৭০ বছর বয়সী রসিক ও ¯েœহশীলা মহিলা) আমাকে বললেন, আপনি বসে থাকতে পারেন। শেষের দিকে আমি বসেই থাকলাম। ওরা ফোরাসে ক্যারলা গেয়ে বলল, রাত সোয়া একটায় শেষ হলো প্রার্থনা-সভা। সু কয়েকজনের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করলেন এবং আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবার আমার ছেলে একা এসে আমাদের বাসায় নিয়ে গেল। ড. দেশ নায়ক তিন রকমের নাশতা তৈরি করে বসে আছেন। চমৎকার পানাহার সেরে শাজেল ও আমি কয়েক হাতের দূরত্বে আমাদের শয়নকক্ষে চলে এলাম।
পরদিন নাতি রাদকে নিয়ে বেকসলি হিথে গেলাম বাসে চড়ে। চমৎকার একটা শপিং মল আর চারদিকে ঘোরাফেরার অঙ্গন। বহু সাদা-কালো সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিংবা কেনা-কাটায় ব্যস্ত থাকছে। অনেক জিনিস খুবই কম দামে বিক্রি হচ্ছে। বর্ষপূর্তির রাত তথা ‘নিউইয়ার্স ঈভ’ হচ্ছে আরেক মহান রজনী। সেদিনও নানা উপহারে সমৃদ্ধ ডিনার অপেক্ষা করছে ড. দেশনায়ক ও সু-র বাসভবনে। সেখানে খেতে খেতে টেলিভিশনে লন্ডনের ক্রিসমাস উৎসবের দৃশ্য দেখতে থাকলাম। বহু আগে থেকে লাইন দিয়ে লোকজন এসে আতশবাজি নিক্ষিপ্ত হওয়ার জায়গায় এসে হাজির। হাজার হাজার মানুষের উৎসাহ-উল্লাসে ভরপুর লন্ডনের আকাশ-বাতাস। মাস দুয়েক আগে ক্রেফোর্ড এলাকায় একটা লোক-উৎসবের আয়োজনে আতশবাজির অনুষ্ঠানে আমরা উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু নববর্ষ উপলক্ষে রাত বারোটা থেকে শুরু করা আলো ছায়ার এই বহু বর্ণ রঞ্জিত লীলা খেলা ছিল অবর্ণনীয় সৌন্দর্য ও উত্তেজনায় ভরা।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি এবার সৌভাগ্যক্রমে পড়ল শুক্রবারে। যথারীতি শাজেল, রাদ ও সাদসহ মসজিদে জুমা পড়তে গেলাম। দূরত্ব আড়াই মাইলের মতো। চমৎকার একটি গির্জা কিনে নিয়ে স্থানীয় মুসলমানরা, বিশেষ করে সিলেটি ভাইয়েরা এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বেশ সুশিক্ষিত ইমাম স্বচ্ছ স্ট্যান্ডার্ড ইংলিশে তিনি ১৫/২০ মিনিট প্রাক-খুতবা বক্তৃতা করেন এবং বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণে খুতবা পাঠ করেন। কখনো দেশি ভাইদের জন্য বাংলায়ও কিছু বলেন। নামাজিদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক আফ্রিকান বা ইংরেজ। দোতলায় মহিলাদের সমাবেশ। ফেরার সময় সাপ্তাহিক পত্রিকা ফ্রি পাওয়া যায়। নতুন বছরের একটা দিনপঞ্জি এক পাউন্ডে কোকো কিনে নিলেন। তাতে নামাজ, সেহরি ও ইফতারের সময়সূচি দেয়া আছে। ব্যবস্থাপনা সুশৃঙ্খল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।