Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চেতনার মর্মমূলে নববর্ষ

প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

ইরানের নওরোজ উৎসব উপলক্ষে ঢাকাস্থ ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের যৌথ আয়োজিত আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের তথ্যমন্ত্রী। তিনি আলোচনাকালে ‘বাংলা নববর্ষ’ প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেছেন। যদিও তিনি আলোচনা শেষ করেছেন বদমায়েশ ও জঙ্গিত্বের মধ্য দিয়ে। নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে কোন কোন মহলের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিষয়ও তার আলোচনায় এড়িয়ে যায়নি। তিনি বলেছেন, পয়লা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তির সাথে ইসলাম ধর্মের কোন বিরোধ নেই। এগুলো পালনে মুসলমানিত্ব যায় না। কিন্তু কিছু মুর্খ লোক এটি বোঝে না, তারা এটিকে ধর্মের লেবাজ পরানোর চেষ্টা করে ও বিরোধ করে। ওই অনুষ্ঠানে নওরোজের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আয়োজকরা বলেছেন, প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সংযোজিত হয়েছে নানা ফর্মে। বোধকরি এটাই বর্তমান সময়ে নববর্ষকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানের মূল প্রসঙ্গ। নওরোজ শুধু ইরানে বা ফার্সি ভাষার দেশেই নয় পাকিস্থানের নববর্ষ অনুষ্ঠানকে নওরোজ বলা হয়। তারা তাদের রীতি ও আচারে এটি পালন করেন। ভারতবর্ষে মুঘল শাসনামলেও এক সময় পর্যন্ত নওরোজ পালিত হতো। ইরানে নওরোজ পালিত হবার মধ্য দিয়ে সেখানে বসন্ত বরণও হয়। বসন্তকেন্দ্রিক বর্ষ বরণের রীতি এ অঞ্চলে চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে। প্রতিটি দেশেই বর্ষ বরণের সাথে তাদের নিজস্ব কিছু রীতি-প্রথার সমন্বয় থেকে যায়। প্রতিবেশী ভারতে কার্যত কোন নববর্ষ পালিত হয় না। সেখানে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দী হলেও এ ভাষায় কোন নববর্ষ নেই। সেখানে একদিকে যেমনি বাংলা ভাষাভাষিরা পহেলা বৈশাখকে পালন করে আবার তেমনি অন্য ভাষাভাষীরা তাদের মতো করে পালন করে থাকে। সেখানে দোল অনুষ্ঠানের মধ্যে নববর্ষ পালনের প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। হিন্দু ধর্মের অনুষ্ঠান বিধায় একেই অনেকে নববর্ষ মনে করে থাকেন। প্রতিটি নববর্ষের মধ্যেই একটি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধান মেলে। যেমন যখন আমরা হিজরি সনের কথা বলি তখন আমাদের হৃদয়ে ভেসে ওঠে নির্যাতনের প্রতিবাদের সেই চিত্র যখন সত্য প্রচার করতে গিয়ে আল্লাহ্র রাসূল (সা.)কে নিজের জন্মভূমির মায়া পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। যখন ইংরেজি নববর্ষের কথা বিবেচনায় নেয়া হয় তখন তার সাথে উঠে আসে তাদের ভাষায় খ্রিস্টের কথা। আমরা যাকে হযরত ইসা (আ.) বলে সম্মান প্রদর্শন করি। তবে তার জন্ম দিনকে প্রধান বিবেচ্য করে যে সনের চালু করা হয়েছে সেটি আল্লাহ্র নির্দেশ মেনে করা হয়নি। যাই হোক ইংরেজি সন বললে মূলত সেই ইতিহাসই অমাদের সামনে উঠে আসে। তেমনিভাবে আমাদের নববর্ষের সাথেও যুক্ত রয়েছে আমাদের অতীতের। একথাও স্বীকার করতে হবে এখন আমরা যেভাবে আমাদের নববর্ষকে দেখছি এটি শুরু থেকেই এভাবে ছিল না। পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়েই এগুচ্ছে। আমাদের জন্য গর্বের একটু আলাদা বিষয় হচ্ছে, বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। এই ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই আর আমাদের নববর্ষের প্রতিষ্ঠার লড়াই মোটামুটি অভিন্ন। ইতিহাস মোটামুটি এরকম যে এর আদি নাম বাংলা নববর্ষ ছিল না। শুরুটা হয়েছে রাজ আনুকূল্যেই। মোগল স¤্রাট জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবর এই নতুন সন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মূলত কর আদায়ের সুবিধার্থে। এটা বলে রাখা দরকার মোগল শাসন পরিচালিত হতো ইসলামী মতে এবং ইসলামী পঞ্জিকা মোতাবেক। এখানে একথাও বলে রাখা দরকার ভারত বর্ষে মোগলদের অনেক আগে থেকেই ইসলামী আইন চালু ছিল। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজয়ের মধ্যদিয়ে ভারতে তিনশত বছরের সুলতানী শাসনের অবসান ঘটেছিল। মোগলরাও ক্ষমতায় এসে তুরস্কের সনদ গ্রহণ করেছিল। যার অর্থ হচ্ছে তারাও ইসলামী আইনের বিধান মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্মত ছিলেন। স¤্রাট আকবর ক্ষমতাসীন হয়ে কর আদায়ের সাথে ইসলামী পঞ্জিকার সাংঘর্ষিকতা অনুভব করলেন। অবশ্য এ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। সেটি আমাদের আজকের আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়। যাই হোক, তিনি কর আদায়ের সুবিধার্থে ইসলামী আইনের সাথে সমন্বয় করে ফসলি সন চালু করার সিদ্ধান্ত নেন এই ফসলি সনই পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বলে পরিচিতি লাভ করে। মূলত দিনটিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তার ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দেয়ার স্বার্থে। ১৫৫৬ সাল মোতাবেক ৯৬৩ হিজরীতে স¤্রাট আকবর হিমুকে পরাজিত করেন। হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে হিমু নিজেকে বিক্রমাদিত্য উপাধীতে ভূষিত করে মোগলদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করলে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি স¤্রাট আকবরের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেন। দিনটি ছিল ৫ নভেম্বর। এই দিনটিকে স্মরণীয় রাখতেই বাংলা সনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সে বিবেচনায় বাংলা সনের ইতিহাসের সাথে যে বিজয়গাথা যুক্ত হয়েছে তাকে পালনের সাথে বিবেচনায় না নেয়ার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে আজকে আমরা যেভাবে যে তারিখে দিনটি উৎযাপন করছি আদিতেও কি সেভাবে ছিল। প্রশ্নাতীতভাবে বলা যায়, তেমনটি ছিল না। কেন নেই এনিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। তবে মোটামুটি সহজ ভাবে বলা যায়, যারা ও যে প্রয়োজনে চালু করেছিলেন তাদের শাসন থেকে বিদায় হবার পর যারা এসেছে তারা যেসব মৌলিক পরিবর্তন করেছে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে কর ব্যবস্থা। তথাকথিত আধুনিক ও শোষণমূলক কর ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে সংগত বিবেচনা থেকেই বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব লাঘব পায়। এখন অমরা শুনছি বা অনেকেই বলছেন শকাব্দই বঙ্গাব্দ। সেই সূত্র ধরেই নতুন আলোচনা। সে যাই হোক আমরা যে নববর্ষ পালন করছি সেটি আমাদের ভাষার টিকে থাকার সংগ্রামের সাথেই মিলে মিশে রয়েছে। সে কারণেই আমাদের সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নববর্ষের সংস্কৃতিকে মনে করা হয়। বোধকরি একারণেই হয়ত তথ্যমন্ত্রী এ দিবস পালনের প্রসঙ্গ টেনে মুসলমানিত্বসহ নানা প্রসঙ্গ টেনেছেন। এখানে একথাও বলা দরকার বাংলা নববর্ষ কথাটা আমরা পেয়েছি ইংরেজদের কাছ থেকে। তারা বাৎসরিক ছুটির তালিকায় এ কথাটা লিখত। এর মধ্যে এ প্রশ্নও উঠতে পারে এটি যদি বাংলা নববর্ষ হয় তাহলে আমাদের নববর্ষ কোনটি? থাক সে কথা।
নববর্ষ প্রতিটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিতেই পালিত হয়ে থাকে। নানা উপাদানে সুষমাম-িত হয় এ ধরনের অনুষ্ঠান। এর সাথে যুক্ত থাকে নানা ধরনের মিথ। আর্থ সামাজিক বাস্তবতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভৌগলিক নানা বোধ-বিশ্বাসের সংমিশ্রণ থেকেই যায় এ ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে। সময়ের পরিবর্তনে এরও পরিবর্তন সাধিত হয়। নববর্ষ উৎযাপন একটি আনন্দ বিষয়ক ঘটনা তাই এর পালনের সাথে মানসিক সম্পর্কের ব্যাপার এড়িয়ে যাবার কোন অবকাশ নেই। প্রথানুযায়ি কাল বৈশাখী থাক বা না থাক দেশের মানুষের মনে যে গুমোট কালো মেঘ জমে আছে বা থাকে তাকে বিদূরিত করার মানসিকতা থেকেই পালিত হয় নববর্ষ। সাধারণত যে ধরনের গ্লানি, অপবাদ ঘুচাতে নববর্ষে মানুষ একান্ত চিন্তায় নিবিষ্ট হয় আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তবতা তার থেকে আলাদা। গণতন্ত্রের উৎসব ভোটের অধিকার ফেরত পাবার দাবি করার কারণে গোটা দেশে সরকারি বাহিনীর যে তা-ব চলেছে এবং চলছে তাতে মানুষ আনন্দ করতে কার্যত ভুলেই গেছে। নববর্ষের আগে ভোটের নামে রক্তের যে হলি খেলা হচ্ছে সেটাই যেন সকলের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। তবু আজ নববর্ষ। কালের অমোঘ নিয়মে পালিত হবে জাতীয় সংস্কৃতির এই দিনটি। বসবে মেলা। জারি-সারি গানে মুখরিত হবে গ্রাম থেকে শহর। বাংলা ভাষাভাষি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এ দিনটি আজ পালিত হলেও ভারতের পশ্চিমবাংলায় হবে একদিন পর। এভাবেই দিবসটি পালনে আলাদা সংস্কৃতির জানান দেয়। দিনটি শুভ হোক অন্তত বিগত বছরের নিপীড়ন, নির্যাতনমুক্ত একটি বছরের প্রত্যাশা সকলের মনে। দিনের প্রথম সূর্য যাতে মুক্তির বারতা নিয়ে আসে সেটাই কাম্য।
আমাদের নববর্ষের ভিত্তিতে হিজরি সাল হলেও এর গণনা ধরা হয় সৌর বর্ষ হিসেবে। আবার ইংরেজী সালের মতও নয়। রাত ১২টা নয় বরং সূর্যোদয়ের সময় থেকে দিনের শুরু। সে বিবেচনায় নববর্ষের সংস্কৃতিতেও নানা প্রভাব বিদ্যমান। শুরু থেকেই শুধু বাংলায় নয়, মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অর্থাৎ বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রেক্ষিতে নববর্ষের সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায় এবং তা কেমন হওয়া উচিত এ প্রশ্নের সন্তোষজনক সমাধান অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রসঙ্গত এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৯৬ সালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার হওয়ায় বাংলাদেশ এখন যে ক্যালেন্ডার ব্যবহার করছে তার সাথে ভারতের পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানের সুনির্দিষ্ট পার্থক্য নির্দেশক। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্জিকাকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও পুরোহিত ও জ্যোতির্বিদদের বিরোধিতার কারণে তা করা যায়নি। এই না হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় অনুরূপ বা কাছাকাছি বাংলা হওয়া সত্ত্বেও দুই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিগত পার্থক্য রেখাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে।
একটি সুসংহত মার্কিন সমাজ গড়ে তুলতে ইমার্সন বলেছিলেন, ‘নিজেরা স্বাধীন জাতি হিসেবে দাবি করবো অথচ কৃষ্টি, সাহিত্য, সংস্কৃতি বাধা হয়ে থাকবে অন্যের কাছেÑ এভাবে-স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। এ পথে জাতীয় মুক্তিও সম্ভব নয়।’ বোধকরি আজকের বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও এ প্রসঙ্গ ভেবে দেখা দরকার, আমরা যা করছি তার কতটা আমাদের নিজস্ব এবং নিজস্ব বলতে কি বোঝায়। আর সেই সাথে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া দরকার, স্বকীয়তা বাদ দিলে শেষ পর্যন্ত যে পরিণতি দাঁড়াবে তা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার সমর্থক হবে কি না। নববর্ষকে আমাদের সংস্কৃতির একটি বড় উদাহরণ হিসেবে সকল মহলই স্বীকার করছে। আমাদের সালকে আমরাই বরণ করবো। প্রশ্ন হচ্ছে, বরণ পর্বটা কিভাবে হবে। ধূপ, ধুনো দিয়ে, নাকি সৃষ্টিকর্তার কাছে সকলের জন্য শুভ কামনা করার মধ্য দিয়ে। যেহেতু নববর্ষকে ফসলি সাল হিসেবে শুরু করা হয়েছে সেদিক থেকে কৃষি থেকে সংস্কৃতির যে আলোচনা রয়েছে নববর্ষে তার চমৎকার সদৃশ্য রয়েছে। আমাদের অর্থনীতি এখনো প্রধানত কৃষি নির্ভর। সে কারণে নববর্ষের সংস্কৃতিকে কৃষি, কৃষক রক্ষার বিবেচনায় পালিত হলে সেটাই উত্তম হতো। ফসলের সাথে কৃষকের একটা নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। শহরে যারা নববর্ষ পালন করেন তাদের আলোচনায় না গিয়েও গ্রামের কৃষি ব্যবস্থার যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন, প্রত্যেক মুসলিম কৃষকই জমিতে বীজ বপনের আগে, প্রথম চাষ শুরু করার আগে নামাজ পড়ে যাত্রা করেন, আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন, পরিবারের ছোট-বড় সকলকে নিয়ে কৃষক নিজেও দোয়া করেন। কোথাও কোথাও মিলাদেরও আয়োজন করা হয়। আবার পশ্চিম বাংলার প্রতিটি কৃষি ব্লকে পাম্পিং মেশিনের সাথে দেবীর মূর্তি অথবা ছবি রয়েছে। সেখানকার সরকার যাই বুঝিয়ে থাকুন না কেন, সাধারণ চাষিরা এটা মানতে রাজি নয় যে, দেবতা ছাড়া কেবলমাত্র পানি, সার, বীজ, কীটনাশক, ফসল বাড়িয়ে দিতে পারে। সুতরাং ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেও কৃষি সংস্কৃতিতেও সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য কেবলমাত্র কৃষির মধ্যেই সীমাবদ্ধ তেমনটা মনে করার চেয়ে এটাই উত্তম যে, কৃষি, পরিবার এবং সামাজিক গ-িতেও এই সামাজিক পার্থক্য সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্যমান।
শুধু একটি ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক অন্যান্য বিধি-বিধানেও নানা ধরনের অপসংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব পড়ছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। কেবলমাত্র পুরোহিতদের প্রভাবই আমাদের সংস্কৃতি বিশেষ করে নববর্ষের উৎসবে পড়েছে তেমনটা নয়, এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ভোগবাদি অপসংস্কৃতির বিরূপ প্রভাবও নানাভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাত্রকিছু দিন আগেও রাত ১২টার পর নববর্ষ পালনের প্রবণতা ছিল। যা মূলত ৩১ ডিসেম্বরের অনুকরণে করা হতো। এখন তা পুরোপুরি কেটে গেছে, এমনটা বলা যাবে না। প্রেক্ষিত আচার, আচারণ এমনকি নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষে যে বিশেষ প্রবণতা কাজ করে তা প্রায় সবারই জানা। পাশ্চাত্যের স্বাভাবিক সময় যাই ঘটুক, ওই এক বিশেষ রাতে পরিমিত জ্ঞানহীন মদ্যপানে মাতাল হয়ে যাওয়া এবং তজ্জনিত নানা ঘটনার খবর প্রায় সকলেরই জানা। মূলত সাংস্কৃতিতে দুর্বৃত্তায়নের কারণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন না থাকা এবং কোন কোন মহলের পরিকল্পিতভাবে জাতীয় সংস্কৃতির ধ্বংসে ইন্ধন দেয়া। বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়নের বখরাভোগী শ্রেণি জাতীয় সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে প্রকৃত সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশ কার্যত বিপজ্জনকভাবে রুদ্ধ করে দেয়ার অপ্রতিরোধ্য অপচেষ্টায় রয়েছে বিধায় আগ্রাসী বা ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রসার সম্ভব হচ্ছে। এটা হতে পারছে, কারণ পাঠ্য বই থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই ইতিহাস, ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রকৃত জাতীয় সংস্কৃতির কালচার বলতে গেলে নেই। অন্যভাবে বলা যায়, আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ার কারণে অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশের পর অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে।
সাংস্কৃতির আগ্রাসনের মাধ্যমে পরাভূত করার প্রবণতাও অস্বীকার করা যাবে না। সেই সাথে বুঝে না বুঝে একশ্রেণির মিডিয়ার নানা প্রোগ্রাম আর অন্যদিকে প্রতিরোধ প্রক্রিয়া সক্রিয় না থাকায় জাতীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা অথবা সংস্কৃতির প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আজকের দিনে এ কথা সকলেরই স্মরণে থাকা সংগত যে, সুস্থ রাজনীতি, রাজনৈতিক পরিবেশ, সৌহার্দ্য ছাড়া নববর্ষের মত উৎসব পালন প্রায় অসম্ভব।
নববর্ষ পালনের রীতিতে কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে এ বছর। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে। সরকারে ভাষায় নিরাপদ করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে মুখোশ নিয়েও। আমাদের ধারণা পরিবর্তন আনতে হবে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয় করার বিবেচনা থেকে যে সনের যাত্রা যে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাকে সেই নিগড়ে বন্দীর প্রবণতার বিরুদ্ধে মুক্তির গান গেয়েই প্রকৃত নববর্ষ পালন সম্ভব। যুগ যুগ ধরে নদী, সাগর, মহাসাগরের ¯্রােত পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে কিন্তু একে অপরের সাথে মিলে যাচ্ছে না বা একে অপরকে গ্রাসও করছে না। প্রকৃতির এই নিয়ম আমাদেরকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বকীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এটাই শত শত বছর ধরে আমাদের জনগণের অন্তরে চিরজাগরুক রয়েছে। আমাদের ভাষা বাংলা, আমাদের দেশ বাংলাদেশ, আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চেতনায় সমৃদ্ধ। এ সবই আমাদের স্বকীয়তার প্রতীক। এই স্বকীয়তার পরিচিতিই আমাদের রাজনৈতিক পরিচয়। আজকের দিনে সেকথা সকলেরই খেয়াল ও বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য।
লেখক : সাংবাদিক কলামিষ্ট।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চেতনার মর্মমূলে নববর্ষ
আরও পড়ুন