Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুঁতি-পাথরে তৈরি ব্যাগ-শোপিসে সচল জীবন সংসার অসাধারণ নকশায় মুগ্ধ সবাই ক্রমেই বাড়ছে চাহিদা

প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকু- (চট্টগ্রাম) থেকে
হাতে তৈরি পুঁতি ও পাথরের ব্যাগ-শোপিস, নানারকম ফল, অলংকার কিংবা সাদা কাঁথায় আঁকা অসাধারণ নকশাগুলো দেখে বিস্মিত না হয়ে পারেন না কেউ। অনেকেই মনে করেন এগুলি মেশিনে তৈরি। প্রকৃত পক্ষে দৃষ্টিনন্দন এ হস্তশিল্পগুলির ¯্রষ্টা হালিমা ও খালেদা নামক দু’বোন। সীতাকু-ের উত্তর বাঁশবাড়িয়া গ্রামের রহমতের পাড়ার মৃত ফসি উদ্দিন মেম্বারের এই দু’মেয়ের হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠে এরকম অসংখ্য প্রকার শিল্পকর্ম। ফলে তৈরির সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে যায় এসব সরঞ্জাম। এতে কিছু টাকা আয় হয়। তাতেই চলছে তারা ৪ বোন সংসার ও পড়াশুনা। সংসারে বাবা-মা, বড় ভাই কেউ নেই তাদের। ফলে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে এ পরিবারের সবাই জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। সংসার বাঁচাতে যার যার মত করে লড়াই করছেন সবাই। উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস ও স্থানীয় সূত্রে হালিমা, খালেদার অসাধারণ হস্তশিল্পের কথা জেনে সরেজমিন সবুজ গাছপালা বেষ্টিত ছায়াঘেরা ঐ বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির ঘরের সর্বত্রই তাদের হাতের নানান কারুকার্য শোভা পাচ্ছে। এছাড়া তৈরি অবস্থায় রয়েছে বেশ কিছু শিল্পকর্ম। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জীবন সংগ্রামী খালেদা ও হালিমা বেগম প্রতিবেদককে জানান, তারা মোট ৭ বোন। এদের মধ্যে ৩ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। অন্যদের নিয়ে তাদের দিন কাটছিলো ভালোই। সুখের সংসারে প্রথম আঘাত আসে ২০০০ সালে। তখন তারা খুব ছোট। হঠাৎ-ই মা আয়েশা বেগম মারা যান। সেময় তার ছোটবোন সাজেদার বয়স মাত্র দেড়-দুই বছর। এতে বাবা ভেঙে পড়লেও সংসার চালিয়েছেন ঠিকই। ২০০৭ সালে হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় মারা যান বাবা ফসি উদ্দিনও। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েন তারা। মা-বাবা-বড় ভাইহীন সংসারে একদিকে বেঁচে থাকা আর অন্যদিকে ৪ জনের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া দারুণ এক চ্যালেঞ্জ হলেও এগিয়ে যেতে থাকেন আলেয়া বেগম, হালিমা বেগম ও খালেদা বেগম ও সাজেদা। এদের মধ্যে আলেয়া বিএ পাস করে যোগ দিয়েছেন আনসারে। বর্তমানে শেখ জামাল মহিলা ফুটবল দলে খেলছেন তিনি। পাশাপাশি বিএড অধ্যয়নের চেষ্টা করছেন। বাড়িতে থাকা ৩ বোনের মধ্যে হালিমা ও খালেদা হস্তশিল্পী। তারা বাজার থেকে পুঁতি ও পাথর কিনে বহুরকম ব্যাগ-শোপিস, নানারকম ফল, নারীদের অলংকার কিংবা সাদা কাঁথায় অসাধারণ নকশা এঁকে তা বাজারে বিক্রি করেন। এ সময় একটি দুটি করে সরঞ্জাম তৈরি করতেন। তাদের হাতের ছোঁয়া অসাধারণ হয়ে উঠা শিল্পকর্মগুলি দেখে সবাই কিনতে আগ্রহ শুরু করায় ধীরে ধীরে কাজ বাড়তে থাকে। বর্তমানে গ্রামে প্রচুর বিক্রি করার পাশাপাশি সীতাকু-ের ইকবাল স্টোর ও কল্পতরু দোকানেও সরবরাহ করা হয়। খালেদা বেগম জানান, বড় বোন হালিমাই প্রথম হস্তশিল্পের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি শুরু করেন তিনিও। বর্তমানে পুঁতি, পাথর, প্লাস্টিকের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নকশি কাঁথা তৈরি করেন। এসব সরঞ্জামের মধ্যে বেশি চলে নানারকম ব্যাগ, রকমারি ফল, ফল রাখার ঝুড়ি, ফুলদানি, গাছ, কাগজের তৈরি বেশ কয়েকরকম শোপিস, নকশিকাঁথা, ওয়াল ম্যাড, ফেব্রিক্সের ও সেলাই কাজ করা কাভার ইত্যাদি। তিনি বলেন, এখন চারিদিকে পরিচিত হয়ে যাওয়ায় এলাকার বহু মানুষ এসে এগুলি কিনে নিয়ে যায়। তৈরির পরপরই বিক্রি হয়ে যায়। তবে তৈরি করতেও সময় লাগে অনেক। সে কারণে লাভ খুব একটা বেশি না। মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা আয় হয়। ঈদ-কোরবানসহ বিভিন্ন উৎসবে চাহিদা বেড়ে যায়। এর সাথে যোগ হয় আলেয়ার উপার্জনের কিছু অংশ। এতেই চলে ৪ জনের সংসার। ছোটবোন সাজেদা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে। তার পড়াশুনায় ক্ষতি হতে পারে মনে করে হস্তশিল্প বা কোন কাজে লাগাননি। সংসার চালানো, ছোট বোনকে পড়ানোর পাশাপাশি নিজেরাও পড়াশুনা করছেন হালিমা, খালেদা। খালেদা মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার্থী আর হালিমা মাস্টার্সে ভর্তি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই খরচ যোগাতে তাদেরকে এখন দিনরাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অবশ্য সংগ্রামী এই বোনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সীতাকু-ের বেসরকারী এনজিও সংস্থা ইপসা ও উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। খালেদা বলেন, ইপসা ও যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ শাহ আলমের সহযোগিতা না পেলে আমরা এত কাজও শিখতে পারতাম না কাজের মূল্যায়নও হতো না। কাজের প্রতি তার আগ্রহ দেখে ইপসা তাদের অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে স্টল স্থাপনের মাধ্যমে উৎসাহিত ও সহযোগিতা করেছে। পরে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা দিয়েছেন প্রশিক্ষণ। ঋণ প্রদানও করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যতক্ষণ সম্ভব ঋণ না করেই চলতে চান তারা। তাই সে ঋণ নেননি। সংগ্রামী এই বোন জানান, বাইরের বড় বড় বাজারগুলিতে তাদের পরিচিতি নেই। তাদেরকে যদি সেখানে বাজারজাত করার মত সুযোগ করে দেওয়া হয় তাহলে উপকৃত হবেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার মোঃ শাহআলম প্রতিবেদককে বলেন, আমরা সবসময় উদ্দ্যমী যুবক-যুবতীদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। খালেদা-হালিমাদের হস্তশিল্প দেখে আরো দক্ষ করে তুলতে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি। ঋণও দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যদি পরিশোধ করতে না পারে এই ভয়ে তারা ঋণ গ্রহণ করেনি। আগামী দিনেও যদি তারা সহযোগিতা চায় তিনি সহযোগিতা করবেন বলে জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুঁতি-পাথরে তৈরি ব্যাগ-শোপিসে সচল জীবন সংসার অসাধারণ নকশায় মুগ্ধ সবাই ক্রমেই বাড়ছে চাহিদা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ