Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নদীতে নেই ইলিশ

০ বজ্রপাতের প্রভাব শব্দ-দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য সংকট

হোসাইন আহমদ হেলাল : | প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৮, ১১:৪০ পিএম

০ আন্ধারমানিকসহ প্রজনন কেন্দ্রগুলো রক্ষা জরুরি
০ সাড়ে ৫ লাখ জেলে পরিবারে দিন কাটছে অনাহারে
০ চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে বার্মা ও থাইল্যান্ডের মাছ
নিষেধাজ্ঞার দু’মাস পার হলেও ইলিশ সমৃদ্ধ পদ্মা-মেঘনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে মিলছে না ইলিশ। অতিমাত্রায় বজ্রপাত, কম মাত্রায় বজ্রপাত, নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, নদী ভরাটের কারণে ইলিশের খাদ্য প্ল্যান্টুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে প্রজনন ও পরিভ্রমণের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে ভরা মৌসুমেও ইলিশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। অনাহারে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে সাড়ে ৫ লাখ জেলে পরিবার। বাংলার মিঠা পানির ইলিশ না মিললেও বার্মা ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত ইলিশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ইলিশে বিখ্যাত চাঁদপুরেও চাহিদা মত মিলছেনা পদ্মা-মেঘনার ইলিশ, যা মিলছে তা আকাশ ছোঁয়া দাম, মৎস গবেষক, মৎস কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও জেলেদের সাথে পৃথক পৃথক আলাপকালে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা সুনীল ঘোষ ইনকিলাবকে জানান, ইলিশ প্রনোদনামূলক মাছ। এ মাছ স্রোতের প্রতিকূলে পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করে। স্রোতের কারণে ইলিশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ঝড় বৃষ্টিপাতের সময় নদীর পানি ঘোলা হয়ে ইলিশের খাদ্য তৈরি হয়। তখন নদীর স্র্রোত থাকে সাগরের দিকে। ইলিশ আসে নদীতে পরিভ্রমণ ও খাদ্য গ্রহণ করতে। তিনি বলেন, দু’বছর থেকে অতিমাত্রায় বজ্রপাতের প্রভাবে বৃষ্টি কম হচ্ছে, নদীর পানি গরম ও ফুলে উঠে। এ বছর এত বেশি বজ্রপাত হয়েছে, সে হারে বৃষ্টিপাত খুব কম হয়েছে। সমুদ্রের সাথে বজ্রপাতের সম্পর্ক রয়েছে, এছাড়া নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌকা, জাহাজ, ট্রলার বেশি চলাচল করায় পানিতে শব্দ দূষণ হচ্ছে। জ¦ালানি তৈল, ময়লা আবর্জনায় পানি দূষিত হচ্ছে। নদীতে পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ডুবো চর জেগে উঠছে। এসব কারণে নদীর স্রোত দুর্বল হয়ে যায়, পানি প্রবাহ কম থাকে। ইলিশ মাছ স্বাভাবিক ভাবে পরিভ্রমণ করতে পারছে না এবং খাদ্য তৈরি না হওয়ায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহর বন্দরের দূষিত পানি নদীতে ধাবিত হওয়ায় মারাত্মকভাবে পানি দূষিত হচ্ছে। নদীর পাড়ে ইট-ভাটা হওয়ার কারণেও নদী দূষণ হচ্ছে। নদীর নাব্য রক্ষা করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কাগজ-কলমে নয় সঠিক গবেষণার মাধ্যমে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম. নিয়ামুল নাসের ইনকিলাবকে জানান, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক সম্পদের একটি হচ্ছে ইলিশ মাছ। ইলিশ উৎপাদন, ইলিশের জন্য পরিবেশ তৈরি করা, ইলিশ আহরণের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে আরোও গুরুত্ব আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করতে হবে। না হয় এ সম্পদ হারিয়ে যাবে। আন্ধারমানিকসহ ইলিশ প্রজনন কেন্দ্রগুলো সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে, গভীর ও মিঠা পানির মাছ ইলিশ, মেঘনার অববাহিকায় গভীর মিঠা পানিতে ইলিশ ডিম ছাড়ে। গত কয়েক বছর ইলিশ সমৃদ্ধ এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়া, পলি দিয়ে নদী ভরাট হওয়া, দূষণমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ইলিশের অনেক প্রজননের ও পরিযায়নের ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ইলিশ কেন মিঠা পানির ১৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অর্ধেকের বেশি মাছ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ইলিশ মাছ সারা বছর আহ্রিত হয়, অন্য মাছ ঋতু ভিত্তিক, প্রকৃতিতে ইলিশের প্রয়োজনীয়তা অনেক। বাংলাদেশে মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রকল্প পরিচালিত গবেষনায় দেখা যায়, বর্তমানে ইলিশের আহরণ মাত্রা ০.৬২, যা অতি আহরণের লক্ষণ। এই অতি আহরণ দু’ইভাবে হচ্ছে, অবৈধ ভাবে ডিমওয়ালা মা ইলিশ এবং জাটকা ইলিশ ধরে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশকে ডিম পাড়ার সুযোগ করে দিতে পারলে এবং ইলিশের নূন্যতম আহরণ দৈর্ঘ্য ২০ ইঞ্চি রাখা যায় তাহলে ১ লাখ টন বেশি উৎপাদন হবে।
ড. এম. নিয়ামুল নাসের আরোও বলেন, ‘ইলিশ অনবায়নযোগ্য মৎস সম্পদ এদের সংরক্ষণে রাষ্ট্রকে অতি যত্মবান হতে হবে। কানাডার আতলান্টিক মহা-সাগরে বিখ্যাত কড মাছ অতি আহরণে নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে যেন ইলিশ আহরণে সেটি না হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ঐতিহ্যবাহী ইলিশ সংরক্ষণে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জলবায়ু, পরিবর্তনের প্রভাব, অতিমাত্রায় বজ্রপাত হওয়ার কারনেও নদ-নদীতে ইলিশের বিচরণ কমতে পারে, তবে এ বিষয়ের মৎস বিভাগের জরুরি এবং গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।’
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, আব্দুল মতলব ইনকিলাবকে জানান, ‘রুপালী ইলিশের প্রজননকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত “আন্ধারমানিক” নদী বাঁচানোর জোর দাবি জানান। প্রায় ৪৫ কিলোমিটার জুড়ে এ প্রজনন কেন্দ্রে কয়েক বছর আগেও ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের দেখা মিলত। পলি জমে নদীতে ভরাট হয়ে গেছে, তাছাড়া নদী দূষণ হচ্ছে, দ্রæত নদী খনন করে আন্ধারমানিক ইলিশ প্রজনন কেন্দ্রটি রক্ষা করতে হবে।’
চাঁদপুর মৎস গবেষনা ইনিষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, ‘নদীতে এখনো ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসার মত পানি বাড়েনি, পানির স্রোত ধারাল হয়নি, চর-ডুবোচরের কারণে নদীর গভীরতা কমে গেছে। পানির প্রবাহ কাঙ্খিত নয়। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ মেঘনায় এসে ইলিশের খাদ্য নষ্ট হচ্ছে, খাদ্য না থাকলে মাছ আসবে না।
দৈনিক ইনকিলাবের চাঁদপুরের স্টাফ রির্পোটার, বি.এম হান্নান জানান, ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য সরকার প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে বহুমুখী ব্যবস্থা করেছে, কিন্তু ইলিশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিপদে পড়ছে ইলিশ নির্ভর জেলেরা, নদীতে ইলিশ মাছ না থাকায় দুর্বিষহ জীবন কাটছে জেলেদের, চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছ ঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক খন্দকার জানান, ‘অন্যান্য বছর এ সময়ে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ত, কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

৫ মার্চ, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ