বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী : ইসলাম শান্তির ধর্ম। অশান্তি-বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টিকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। সমাজ জীবনে শান্তি ও শৃংঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ওপর ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। অশান্তি-বিশৃংঙ্খলা তথা ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টিকে আল কোরআনে হত্যার চেয়েও গুরুতর পাপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ পাপ আমাদের সমাজের র›েদ্ব্র র›েদ্ব্র প্রবিষ্ট হয়ে আছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন ও গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা একটি ফেতনা-অশান্তি সমাজে অসংখ্য ফেতনা-অশান্তি ও হাঙ্গামা জন্ম দিতে পারে। তাই ফেতনা-বিশৃংঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টির বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর অবস্থান।
অমুসলিম সম্প্রদায়কে তবলিগ করার জন্য ইসলামের যে নির্দেশ, অন্যান্য কারণ ছাড়াও এর একটি কারণ এই, একজন মুসলমান যে জিনিসটি সত্য মনে করে সে সম্পর্কে অপর লোককে অবহিত করা তার মানবিক দায়িত্ব। মানব কল্যাণ ও সৌভ্রাতৃত্বের এটা একটি অপরিহার্য দিক। এই প্রেরণা অনুভ‚তি নিয়েই মুসলমানরা ইসলাম প্রচারে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা দুনিয়াময় ইসলাম প্রচারে সক্ষম হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে ‘কোলো লিন্নাছে হোসনান’। অর্থাৎ (হে লোক সকল) তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম কথাবার্তা বলো। (সূরা বাকারা) অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রæতাহেতু সুবিচারের অন্যথা করো না, তোমরা সুবিচার কর, এটাই ধর্মভীরুতার নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তদ্বিষয়ে অভিজ্ঞ। (সূরা মায়েদা)
পবিত্র কোরআন ছাড়াও অসংখ্য হাদীস এমন আছে, যাতে হযরত রসূলে করীম (সা:) স্বীয় অধিকারসমূহ পালন করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মহানবী (সা:) বলেছেন, এই সাওয়াব বা পুণ্যের সীমারেখা এতই প্রশস্ত ও ব্যাপক যে, এতে প্রত্যেক জীবনধারী বস্তু অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী অংশীদার। তিরমিজী শরীফে হযরত আবুজর (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা:) বলেছেন, ‘তোমরা যেখানেই অবস্থান করো না কেন আল্লাহকে স্মরণ রাখবে, মন্দের পরিবর্তে ভাল করবে এবং মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করবে।’
হযরত আবু হোরায়রা (রা:) বর্ণনা করেছেন, ‘একদা হুজুর (সা:) পাঁচটি বস্তুর উল্লেখ করলেন। এর একটি ছিল এই যে, তোমরা সকলে প্রত্যেক লোকের জন্য তাই কামনা কর, যা তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম মনে কর। তবেই তোমরা সত্যিকারের মুসলমান হতে পারবে। (তিরমিজী) তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর মুখ ফিরাও না, তোমরা সকলেই আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পর তোমরা ভ্রাতাস্বরূপ হয়ে যাও। (বোখারী) মহানবী (সা:) আরও বলেছেন, প্রত্যেক তরল বস্তুর সাথে সদাচরণ করাতে সওয়াব রয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তু যার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে, এর সাথে উত্তম ব্যবহারে পুণ্য অর্জণ হয়। (বোখারী) এতে প্রমাণিত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র মানব মÐলীর কল্যাণ সাধনের প্রেরণা অন্তরে পোষণ না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষ সত্যিকারের মুসলমান হতে পারবে না এবং সে মহানবী (সা:) এর দরবারেও নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করার অধিকার রাখবে না।
ইমাম কাজী আবু ইউসুফ তাঁর ‘কেতাবুল খেরাজে’ লিখেছেন যে, একদা হযরত ওমর (রা:) দেখলেন যে, একজন অন্ধ বৃদ্ধলোক তাঁর দরজায় এসে ভিক্ষা চাইছে। হযরত ওমর (রা:) পেছনে এসে তার হাত ধরে ফেললেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, তোমার ভিক্ষা চাওয়ার প্রয়োজন হল কেন? অন্ধ বৃদ্ধ লোকটি উত্তর করল, করের বোঝা হতে মুক্তি সাধন, প্রয়োজন পূরণ করা এবং উপরন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে আমি ভিক্ষাবৃত্তি আরম্ভ করেছি। উত্তর শ্রবণ করে হযরত ওমর (রা:) বৃদ্ধ ভিক্ষুককে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন এবং গৃহ হতে কিছু দান করে আবার তাকে বায়তুল মালের রক্ষকের নিকট প্রেরণ করলেন এবং নির্দেশ পাঠালেন যে, এই বৃদ্ধ লোক ও তার মত অন্যান্যদের প্রতি যেন দৃষ্টি রাখা হয়। নির্দেশনামায় হযরত ওমর (রা:) বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমরা ইনসাফ করব না যদি আমরা তার যৌবনের উপার্জন ভোগ করি এবং বৃদ্ধ বয়সে তার সাহায্য করা ভুলে যাই।
পবিত্র কোরআনে দানÑখয়রাত করার যে অনুমতি দান করা হয়েছে, তা ফকির-মিসকিনদের জন্য যারা মুসলমান এবং যারা গ্রন্থধারী দরিদ্র মিসকিন, তাদের ওপর কর ধার্য না করার কথা বলা হয়েছে। এভাবে ইসলাম মুসলিম ও অমুসলিমের প্রশ্নের চিরতরে মীমাংসা করে দিয়েছে। ‘কিতাবুল আমওয়াল’ -এ উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত আবু ময়সরা বিন মায়মুন এবং ওমর বিন শোরাহবিল ফেতরার অর্থ দ্বারা খ্রীষ্টান পাদ্রীদের সাহায্য করতেন। বোখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা:) এর জমানায় হযরত (সা:) তাঁর মোশরেক ভ্রাতাকে তোহফা (উপঢৌকন) দিতেন। স্বয়ং নবী করীম (সা:) কোন কোন লোকদেরকে তাদের মোশরেক মাতা-পিতার সাথে আত্মীয়সুলভ ব্যবহারের অনুমতি দান করেন। (মুসলিম)
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা:) মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন; ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মোমেন হবে না যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অপর মানুষের জন্যও পছন্দ করবে এবং যতক্ষণ না সে মানুষকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসবে’। ইসলামের এই ধর্মীয় ও মানবিক আদর্শ প্রচারের কথা কেবল মুখে উচ্চারণ করলেই কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না, প্রত্যেকের বাস্তব জীবনেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।