বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রতিবছর মুসলিমদের ঘরে ঘরে ঈদ আনন্দ আসে আবার চলে যায়। বিদায় রমজানের পদধ্বনির সাথে সাথে সর্বত্র আনন্দ কোলাহলের যে ঢেউ শুরু হয়ে যায় ঈদের পরেও তার রেশ থেমে থাকেনা। ঈদের আনন্দ উৎসবকে আসলে প্রধাণত ; দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত; ঈদের জমাত পর্যন্ত প্রথম পর্ব এবং তারপর থেকে দ্বিতীয় পর্ব।
রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির ঐশী বার্তা নিয়ে যে রমজানের আগমন, বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তাকে স্বাগত জানায় বিভন্ন ভাবে। এক শ্রেণীর মোনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী, মজুদদার চক্র নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি করে, ইফতার সামগ্রী ভেজাল ও বিষাক্ত বস্তু মিশ্রিত করে এবং পরিমাণে কারচুপি করে অবৈধ মোনাফা লাভের মাধ্যমে ঈদের আনন্দ সঞ্চয় করতে থাকে। আরেক ক্রেতা সাধারণ, যাদের নানা ধরণের বৈধ অবৈধ ভাবে অর্জিত অর্থ সম্পদের অধিকারী লোক রমজানকে স্বাগত জানায় কেনাকাটা সূচনার মাধ্যমে। পক্ষান্তরে অসহায়, বঞ্চিত, এতিম, মিসকিন, দরিদ্র, অভাবীদের এক বিশাল অংশ বিশেষত: শিশু কিশোর দল তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বেচা কেনা বা কেনা বেচায় ব্যস্ত এ উভয় শ্রেণীর রোজাদার ও ‘রোজাখোরের’ ঈদের আনন্দ প্রস্তুতি দেখে ওই মাসুম অসহায়দের মনের অবস্থা কি হতে পারে তা ভেবে দেখার বিষয়। ওরা ব্যক্ত করতে না পারলেও অবলোকন করে। প্রত্যেক পরিবারের আপন স্বজনরা শিশু কিশোর, কিশোরী ও সদস্যবর্গকে নামি দামি মার্কেটে বাজারে ঘুরে ঘুরে জিনিস পত্র কিনছে, শিশুদের জামা কাপড়, জুতা, খেলনা ইত্যাদি পছন্দ অপছন্দ আকর্ষণীয় অনেক কিছু কিনে দিচ্ছে এবং ঈদের কেনা কাটা করে ব্যাগ ভর্তি করে বাসায় ফিরছে। কিন্তু এতিম মিসকিন এ অসহায় শিশুদের প্রতি তাকিয়ে দেখারও কেউ নেই। তাদের ঈদ আনন্দের কথাও কারো ভাবনায় নেই। হ্যাঁ, অনস্বীকার্য, ঈদের দিন ঈদগাহের আশে পাশে কিংবা মসজিদের সামনে বয়স্ক, অভাবী নারী-পুরুষদের সারিতে বাটি হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের ফিতরা বা যাকাতের ক্ষুদ্রাংশ ভিড়ের মধ্যে কেউ পায়, কেউ পায় না। এ অসহায়দের ‘ঈদ চিত্র’ অংকন করা সহজ নয়।
জ্ঞাতব্য যে, মাসুম, কম বয়স্ক বাচ্চা বা যখন বাপকে হারিয়ে ফেলে অর্থাৎ পিতার মৃত্যু হয়, তখন তাদের জন্য দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। ইতিহাস হতে জানা যায় যে, ইসলামের পূর্বে জাহেলী যুগে যাদের অন্তরে খোদা ভীতি ছিল না তারা এতিমদের সাথে সর্বপ্রকারের দুর্ব্যবহার ও অন্যায় আচরণ করত। তাদের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন চালাত, তাদের অধিকারসমূহ হরণ করত। আজকের যুগেও তারা এ অভিশাপ হতে মুক্ত হতে পারেনি। তবে ইসলাম এ সম্পর্কে বিস্তারিত নিদের্শনাবলি দিয়েছে। কোরআন এর বহু স্থানে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে এসব নির্দেশের বিবরণ রয়েছে। কোরআন এ যেখানেই এতিমদের কথা বলা হয়েছে, পাশাপাশি মিসকিনদের কথাও বলা হয়েছে। এসব আয়াত একত্রিত করা হলে এতিম ও মিসকিনের স্বতন্ত্র পরিচয় ফুটে উঠবে। হাদীসেও এতিম ও মিসকিন সম্পর্কে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দেশনাবলী রয়েছে। একই সাথে আরও বিভিন্ন শ্রেণীর দান, সদকা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এখানে আমরা বিশেষভাবে এতিম, মিসকিন ও অসহায় দরিদ্র, অভাবীদের কথা বলতে চাই। কোরআন এ যাদের অধিকার সমূহ সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
কোরআন এর আলোকে:
পবিত্র কোরআন এর ৩০ পারায় ৯৩ নং সূরা ‘দোহা’ এ রসূলুল্লাহ (সা:) কে সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা সান্তনা স্বরূপ বলেন; ‘তিনি কি তোমাকে এতিম অবস্থায় পাননি, আর তোমাকে আশ্রয়দান করেন নি? তিনি তোমাকে পেলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, অত:পর তিনি পথের নির্দেশ দিলেন। তিনি তোমাকে পেলেন নি:স্ব অবস্থায়, অত:পর অভাব মুক্ত করলেন। সুতরাং, তুমি এতিমদের প্রতি কঠোর হইওনা এবং প্রার্থীকে ভর্ৎসনা করোনা।’ (আয়াত ৬-১০)
বর্ণিত আয়াত গুলোতে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে এবং রসূলুল্লাহ (সা:) কে তার এতিম অবস্থার কথা স্মরণ করে দিয়ে তাদের প্রতি কঠোর আচরণ না করার নির্দেশ দান করা হয়েছে। তাছাড়া একই পারার ১০৭ নং সূরা ‘মাউন’ এর প্রথম হতে ০৩ নং আয়াত পর্যন্ত এতিম ও মিসকিনদের কথা পর পর বলা হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা:) কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন;
‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে? সে তো সেই যে এতিমকে রূঢ় ভাবে তাড়িয়ে দেয় এবং সে অভাবগ্রস্থকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না।’
মুসলমানদের সাথে এতিমদের সম্পর্ক: সূরা বাকারার ২২০ নং আয়াতে আল্লাহ রসূলুল্লাহ (সা:) কে সম্বোধন করে বলেন; ‘দুনিয়া ও আখেরাত সম্বন্ধে লোকে তোমাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, তাদের জন্য ভালো ব্যবহার করা উত্তম। তোমরা যদি তাদের সাথে একত্র থাকো তবে তারাতো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে হিতকারী এবং কে অনিষ্টকারী।’ এতিমদের মাল কি করা উচিত: সূরা ‘নিসা’ এর ০২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,
‘এতিমদেরকে তাদের ধন সম্পদ সমর্পণ করবে এবং ভালোর সাথে মন্দ বদল করবে না। তোমাদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করো না, নিশ্চই এটা মহাপাপ। তোমরা যদি আশংকা কর যে, এতিম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন অথবা চার। আরা যদি তাদের সম অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে তোমাদের মনে ভয় থাকে, তাহলে একটিই বিয়ে করবে।’ উদাহরণ স্বরূপ এতিম সংক্রান্ত কয়েকটি মাত্র আয়াত পেশ করা হল, আরও অনেক আয়াত রয়েছে। কোরআনে বর্ণিত এতিম সংক্রান্ত আয়াতের সংখ্যা বহু। এসব আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে; এতিমদের সাথে মুসলমানদের কি সম্পর্ক, এতিমদের অর্থ-সম্পদ কি করা উচিত এবং তাদের লালন-পালনে মুসলমানদের কি করা দরকার, ওদের মাল আত্মসাৎ করার পরিণতি, মুসলমানদের ওপর অসহায় শিশু ও এতিমদের অধিকার সমূহ প্রভৃতি। সূরা ‘দোহা, বাকারা, নিসা এবং সূরা বনি ইসলাইলে বর্ণিত এসব আয়াতে বিশদভাবে এতিমদের কথা এবং তাদের অধিকারগুলোর বিবরণ রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।