Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দেবে কে?

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০১৮, ১২:০০ এএম

হোসাইন আহমদ হেলাল : বায়ু ও শব্দদূষণে রাজধানী ঢাকার আকাশ-বাতাস ভয়াবহ হয়ে ওঠছে। বিশাল এ শহরের কোথাও নেই স্বস্তি। বস্তিবাসী থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত কেউই রক্ষা পাচ্ছে না এ ভয়াবহ দু’দূষণ থেকে। শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, রোগী, ছাত্র-ছাত্রী, পথচারী, চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র-বড় ব্যবসায়ী কারো রক্ষা নেই, সবাই আক্রান্ত, অসুস্থ এবং অস্বস্তি যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে। মনে করা হচ্ছে তাদের স্বস্তি দেয়ার কেউ নেই। এ যন্ত্রণা থেকে কবে মুক্তি পাবে তাও কেউ জানাতে পারছেন না। নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাস রাজধানী কোথাও নেই। চোখ-মুখের জ্বালা-যন্ত্রণায় এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়া এখন নিত্যসময়ের ব্যাপার হয়ে পড়েছে। নির্মম হলেও সত্য দূষিত বাতাস ও শব্দ দূষণের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠছে। সৃজন পরিবর্তনের এ সময় এমনিতেই মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তার ওপর শব্দ সন্ত্রাস ও বাতাসের বিষে মানুষের সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্যবিদ এবং ভুক্তভোগী জনসাধারণ।
মানুষের জীবনের পরিসর ও ব্যস্ততা বাড়ছে। উন্নয়নের কাজও চলছে নানাভাবে। রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচলও বেড়েছে। শব্দদূষণ বাড়ছে। এর সাথে যোগ হচ্ছে, নানা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে শব্দযন্ত্র বা মাইক্রোফোনের ব্যবহার, দেশে হর্ণ মাইক ব্যবহার হচ্ছে এবং উদ্যোক্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে অনুষ্ঠানস্থল ছাপিয়ে মাইকের ব্যবহার ছড়িয়ে দিচ্ছেন আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। অনাক্সিক্ষত এ শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী, সাধারণ মানুষ। অতিসম্প্রতি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে অনিয়ন্ত্রিত শব্দ বন্ধ করা নিয়ে একজন অসুস্থ বৃদ্ধ খুন হয়েছেন। এসব অনিয়ন্ত্রিত শব্দে দূষণকে শব্দসন্ত্রাস আখ্যা দিয়েছে একটি সেমিনারে বক্তারা। শব্দ নিয়ন্ত্রণে আইন তৈরি হয়েছে, তা ছাড়া অত্যাধুনিক শব্দযন্ত্র আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাখারও ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু দেশে সাধারণভাবে শব্দ সম্পর্কে সচেতনতা কম। মানুষ অহেতুক উচ্চস্বরে কথা বলে, অকারণে হর্ন বাজাচ্ছে, অনুষ্ঠানে ছাড়াও অসময়ে মাইক বাজাতে থাকে। পাড়া-প্রতিবেশী, ছাত্র-ছাত্রী, রোগী, শিশু-বৃদ্ধ কারো কথাই বিবেচনায় নেয় না। উচ্চশব্দে শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা সিটি কলেজের একজন শিক্ষক (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) ইনকিলাবকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোর কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা। বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর প্রচার ও বিক্রি, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের সভা, সমাবেশে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রচারণায় শব্দদূষণে কেবল শিক্ষার্থীরাই নয় সাধারণ মানুষও কষ্টে আছেন। যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দের কথা বলে লাভ নেই। মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়া শর্তেও সরকার এটি কার্যকর করছেন না। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়তই শব্দদূষণ ও ধুলো-বালির শিকার হয়ে বেশির ভাগই অসুস্থ থাকছে। স্কুল-কলেজে বেশিরভাগ সময়ে তাদেরকে অনুপস্থিত থাকতে হচ্ছে।
গ্রিন রোড এলাকার একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, পুরো রাজধানীজুড়ে শব্দ ও বায়ুদূষণের অস্বাভাবিক যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে, বিভিন্ন রাস্তা, অলিগলিতে অসংখ্য রড কাটাসহ ইট-পাথর ভাঙার কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে সারা বছরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। সড়কের ওপর মেশিন বসিয়ে ইট-ভাঙার কারণে যানজট ও পাথচারী, চাকরিজীবী, স্কুল, কলেজগামী ছাত্রছাত্রীরা যথা সময়ে পৌঁছতে পারছে না, কে দেবে এসব জবাব। সবাই ক্ষমতায় টিকে থাকতে, ক্ষমতায় যাইতে অস্থির হচ্ছে এটাও মানুষের জীবনযাত্রায় আরও একটি কষ্ট।
ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের ছাত্রী নাসরিন সুলতানা বলেন, গভীর রাতে শব্দদূষণে ঘুমাতে পারছি না। দিনের বেলায় সম্পর্কে কি আর বলবো। বসবাস অযোগ্য হয়ে ওঠছে ঢাকা। একই সাথে একজন শিশু শিক্ষার্থী তানবির বলেন, শব্দ সহ্য করতে পারি না। কানে ব্যথা হচ্ছে, ধুলোতে নাক মুখ জ্বলছে, স্কুলে যেতে ইচ্ছে হয় না।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের, শিশুদের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিঁটখিটে হওয়া, আলসার, বিরক্তির সৃষ্টি হয়। এতে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, শব্দের প্রধান উৎস গাড়ির অহেতুক হর্ন, ভবন নির্মাণ, নানা জাতের কাটার যন্ত্র এবং সর্বোপরি মাইক, তবে গায়ে হলুদ, বিয়ে জন্মদিনে এবং ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিলে এবং নামসংকীর্তন জাতীয় অনুষ্ঠান এবং মুক্তমঞ্চ ও প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আওয়াজ এবং প্রচারের মাধ্যমে বন্ধ করা যায়। এতে মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির কারণ হ্রাস পাবে। শব্দনিয়ন্ত্রণের আইন তৈরি হয়েছে, তাছাড়া অধ্যাধুনিক শব্দযন্ত্রে আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাখারও ব্যবস্থা রয়েছে।
গ্রিন লাইফ হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের ইনকিলাবকে বলছেন, বায়ুদূষণের অর্থ বাতাসে ভাসমান কণা ও বিষাক্ত গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিÑ সহনশীলতার বাইরে চলে যাওয়া। বর্তমানে বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে গিয়েছেÑ তা রীতিমতো ভয়ের ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণের ফলে যে শুধু শ্বাসনালী বা ফুসফুসে আক্রান্ত হতে পারে, তা নয়, বায়ুদূষণ শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ, অঙ্গপ্রতঙ্গের ওপরেও প্রভাব ফেলে। বায়ুর বিষাক্ত উপাদান ফুসফুস থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সে জন্য শ্বাসরোগ থেকে হৃদরোগ পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি স্থায়ীভাবে হার্টের অসুখ ও ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও হওয়া সম্ভব। তিনি আর বলেন, ধুলি-কণার মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে গড়ে হওয়া উচিত ১০০ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু বায়ুদূষণের কবলে পড়া এলাকা এ মাত্রা অত্যাধিক। কোথাও ৩ গুণ কোথাও ৪ গুণের ও বেশি থাকে।
বায়ুদূষণের অত্যতম উৎসব হচ্ছে নির্মাণকার্য, কয়লা জৈব জ্বালানি। নির্মাণসামগ্রী যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে নাÑ সেখানে যেখানে উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখা হচ্ছে। এর ফলে বাতাসও দূষিত হয়। শুধু তাই নয়, নির্মাণের জন্য সহায়ক ইট থেকে যে ধুলো বের হচ্ছে এটি খুবই বিষাক্ত। রাস্তার ধুলোবালি ও নির্মাণ সামগ্রীর ধুলো গাছ-পালা, ফল ও ফুল বাগান দূষণের কবলে পড়ছে। শুধু বায়ুদূষণের অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে।
মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ডা. কামালুর রহিম জানান, ঢাকা শহরের রাস্তার খোঁড়াখুড়ি, নির্মাণ সামগ্রী ও শব্দধূষণের বিষয়ে জরুরি আইনগত পদক্ষেপ না নেয়া হলে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়বে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেছেন, শব্দদূষণের আইন রয়েছে। এ বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। সরকার প্রয়োগ করছে না কেন? সিটি কর্পোরেশন জরুরি ভূমিকা না রাখলে হাইকোর্টের নজরে এনে রীট করা হবে।
আইনে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ)Ñ বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত কর শব্দের মান মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য একমাস কারাদÐ বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদÐ বা উভয় দÐ এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদÐ বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদÐ বা উভয়দÐে দÐিত হওয়ার বিধান রয়েছে, এ আইন বাস্তবায়ন করবে কে? কে দেবে নগরবাসীর স্বস্তি?



 

Show all comments
  • তপন ৭ জুন, ২০১৮, ২:৩১ এএম says : 0
    এগুলো দেখার কী কেউ নেই ?
    Total Reply(0) Reply
  • আরজু ৭ জুন, ২০১৮, ২:৩১ এএম says : 0
    দেশে আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ