Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২১ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

লক্ষাধিক কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে

মালয়েশিয়ায় রি-হিয়ারিং কর্মসূচি

| প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম


শামসুল ইসলাম : মালয়েশিয়ায় কর্মরত লক্ষাধিক নিবন্ধিত বাংলাদেশী কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে যথা সময়ে পাসপোর্ট হাতে না পাওয়া এবং মালয়েশিয়ার মাইজি কোম্পানীর ব্যর্থতার দরুণ এসব অভিবাসী কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষিত রি-হিয়্যারিং কর্মসূচি’র আওতায় এসব অবৈধ কর্মী বৈধত লাভের জন্য মাইজিকে হাজার হাজার রিংগিট দিয়ে নিবন্ধিত হয়েছিল। মাইজি ইমিগ্রেশন থেকে নিবন্ধিত কর্মীদের সাক্ষাতের সময় নিয়ে দিতে পারছে না। অপেক্ষমান হাজার হাজার নিবন্ধিত কর্মী মাইজি’র বিভিন্ন অফিসে ধরণা দিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়া সরকারের রি-হিয়্যারিং কর্মসূচি’র নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। এতে প্রায় ৫ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী কর্মী নিবন্ধিত হয়। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন কর্র্তৃপক্ষ নিবন্ধিত এসব কর্মীদের অবৈধতা লাভের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ছয় মাসের সময় বেধে দেয়। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ মাস থেকে দশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার ৩২ জন কর্মী জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় চাকুরি নিয়ে গেছে। সিন্ডিকেট চক্র ছাড়া সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি’র মাধ্যমে মালয়েমিয়ায় কর্মী যাওয়ার সুযোগ পেলে এ সময়ের মধ্যে ৫ লক্ষাধিক কর্মী স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে চাকুরি লাভ করতো।
এদিকে, মালয়েশিয়ার মাইজি কোম্পানী মৌখিকভাবে প্রবাসী নিবন্ধিত কর্মীদের বলছে আগামী ৩১ মে’র মধ্যে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত ফিঙ্গার নেয়ার শেষ সময়সীমা বেধে দিয়েছে। ইমিগ্রেশন থেকে বৈধতা লাভের চূড়ান্ত ফিঙ্গার নেয়ার জন্য সাক্ষাতের তারিখ দিতে পারছে না। নিবন্ধিত হাজার হাজার বাংলাদেশী কর্মী চূড়ান্ত ফিঙ্গার দিয়ে বৈধতা লাভের জন্য প্রতিদিন মালয়েমিয়ার পুত্রাজয়াস্থ ইমিগ্রেশনে ভিড় জমাচ্ছে। কিন্ত ইমিগ্রেশন এসব কর্মীদের ফিঙ্গার দেয়ার সময় দিতে পারছে না। ফলে তারা ইমিগ্রেশন থেকে নিরাশ মনে কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছে। শিগগিরই এসব অপেক্ষমান নিবন্ধিত কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ না পেলে তাদের দেশে ফিরে আসতে হবে। কুয়ালালামপুর থেকে গতকাল মঙ্গলবার ’ভে-স্ট মার্কেটিং এসডিএন বিএইচডি’ (৭৬৯২২৪-এ)-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ রুহুল আমিন এতথ্য জানিয়েছেন। প্রবাসী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রুহুল আমিন মালয়েশিয়ায় নিবন্ধিত অপেক্ষমান লক্ষাধিক অবৈধ কর্মীর বৈধতা লাভের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের সময়সীমা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভিন্ন এজেন্টের প্রতারণা, হাই কমিশন থেকে সময়মতো পাসপোর্ট ইস্যু না হওয়ায় নিবন্ধিত প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীরা বৈধতার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
মালয়েমিয়া সরকার ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি থেকে দেশটিতে অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার সুযোগ হিসেবে কয়েকটি ক্রাইটেরিয়ার মাধ্যমে বৈধকরণের প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রথমে রি-হিয়্যারিং এবং পরবর্তীতে এর সঙ্গে (যাদের কোনো কাগজপত্র নেই) যুক্ত হয় ই-কার্ড প্রোগ্রাম। ই-কার্ড এর প্রক্রিয়া শেষ হয় গত ৩০ জুন। নিবন্ধিতদের মধ্যে নাম ও বয়স জটিলতায় কমপক্ষে ৫৫ হাজার কর্মী ভিসা পাননি। আগেই জানানো হয়েছিল নিবন্ধিত কর্মীদের ভিসাসহ বৈধতার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিবন্ধন শেষ হওয়ার পর পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে তাদের ভিসাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ দিয়েছে দেশটির ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
যারা ই-কার্ডের আওতায় নিবন্ধিত হয়েছে তাদেরকে রি-হিয়্যারিং এর মাধ্যমে বৈধ হতে হবে এবং রি-হিয়্যারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে যারা নিবন্ধিত হয়েছেন এবং যারা এখনও নিবন্ধন করেননি তাদের দ্রæত মাই-ইজি, ভুক্তিমেঘা ও ইমান এ তিন কোম্পানির মাধ্যমে গত ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বৈধতার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দেশটির অভিবাসন বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ হাই কমিশন কর্তৃপক্ষ বারবার তাগিদ দিয়ে আসছিল
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় প্রচুর বিদেশি কর্মী বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কাজ করছেন। দেশটিতে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ ইন্দোনেশিয়ার, ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ নেপালের, ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বাংলাদেশের, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ মিয়ানমারের, ভারতের ৫ দশমিক ১ শতাংশ, ফিলিপাইনের ৩ দশমিক ১ শতাংশ, ২ দশমিক ৫ শতাংশ পাকিস্তানের এবং থাইল্যান্ডের রয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য দেশের ৪ শতাংশ কর্মী কাজ করছে মালয়েশিয়ায়। যারা আকাশ পথে দেশটির ইমিগ্রেশন পার হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর অবৈধ হয়েছে এবং ৬ মাস অতিবাহিত হয়েছে কেবলমাত্র তারাই এ কর্মসূচির আওতায় বৈধ হতে পারছে। এ ছাড়া যারা অবৈধভাবে সাগরপথে দেশটিতে প্রবেশ করেছে তাদের জন্য চালু ছিল ই-কার্ড (এনফোর্সমেন্ট কার্ড) প্রোগ্রাম। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ দেশটিতে অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত রেখেছে। মালয়েশিয়ায় রি-হিয়্যারিং কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যাওয়া কোনো অভিবাসী কর্মী ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে তার ১০ হাজার রিংগিত জরিমানাসহ এক বছর জেল হতে পারে। সচেতনতার অভাব, প্রতারণার শিকারসহ নানা কারণে এখনো প্রায় ২ লাখ অবৈধ বাংলাদেশী কর্মী রি-হিয়্যারিং কর্মসূচির’ বাইরে রয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক সূত্র এতথ্য জানিয়েছে। এরপরও থামছে না ট্যুরিস্ট ও ভিজিট ভিসার নামে দেশটিতে পাড়ি জমানোর সংখ্যা। গত বছর ‘বাংলাদেশ নাইটস’ নাম দিয়ে পরিকল্পিতভাবে আদম পাচারের অভিযোগে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুনকে গ্রেফতার করেছে মালয়েশিয়া পুলিশ। এ ঘটনার পর দেশটির সব বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগ কড়া নজরদারি আরোপ করেছ। এ ছাড়া মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারে মাঠে রয়েছে দেশটির গোয়েন্দা পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেখানে বৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি করেছেন জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সভাপতি নাজমুল ইসলাম বাবুল ও সহ-সভাপতি শাহ আলম হাওলাদা। জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতৃদ্বয় বলেন, দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশী রি-হিয়্যারিং কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এসব দালাল চক্রের বিরুদ্ধে হাই কমিশনকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া কুয়ালালামপুরসহ দেশটির কোনো না কোনো এলাকায় প্রায়ই পুলিশি অভিযানে বাংলাদেশিসহ অবৈধ বিদেশিরা ধরা পড়ছে। পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্পে। এ পর্যন্ত কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মী বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রয়েছেন বলে জানা গেছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আটকৃতরা টিকিটের টাকা ও হাইকমিশন থেকে আউট পাস সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে তাদের সেখান থেকে পাঠানো হচ্ছে সেন্ট্রাল জেলে।
বিএনপি মালয়েশিয়া শাখা’র (একাংশের) সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সালহ উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, সচেতনতার অভাব এবং মধ্যস্বত্ব্যভোগি দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে বহু অসহায় অবৈধ নিবন্ধিত বাংলাদেশী কর্মী বৈধতা লাভ করতে পারেনি। প্রতারণার শিকার হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশী কর্মীর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। আতঙ্কিত এসব অবৈধ কর্মীরা বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠাতে পারছে না। এক প্রশ্নের জবাবে কাজী সালাহ উদ্দিন বলেন, রি-হিয়্যারিং কর্মসূচির নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত লাখ লাখ কর্মীদের বৈধকরণের সময়সীমা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের স্বার্থে মালয়েশিয়ায় দালালদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবী জানান।
গতকাল মালয়েশিয়ার পেনাং থেকে বিএম ফ্লাইট ট্যুও এন্ড ট্রাভেল এসডিএন এিইচডি ও এম এম এইচ রির্সোস এসডিএন বিএইচডি’র পরিচালক মো: মোশাররফ হোসেন বলেন, দালাল চক্রের মাধ্যমে টাকা দিয়ে অবৈধ প্রচুর বাংলাদেশী প্রতারণার শিকার হয়ে রি-হিয়্যারিং কর্মসূচির মাধ্যমে নিবন্ধিত হয়ে হাজার হাজার কর্মী এখনো বৈধতা লাভ করতে পারেনি। তিনি বলেন,
আমার কোম্পানীর নিবন্ধিত শতাধিক কর্মী এখনো বৈধতার সুযোগ পায়নি। তিনি বলেন, মধ্যস্বত্ব্যভোগি দালালদের বিরুদ্ধে হাই কমিশন কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় অসহায় অবৈধ কর্মীরা অহরহ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। নিবব্ধিত কর্মীদের বৈধতা লাভের সুবিধার্থে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইমিগ্রেশনে ফিঙ্গার দেয়ার সময়সীমা বর্ধিতকরণে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লক্ষাধিক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ