Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাঙা বেড়িবাঁধ অরক্ষিত উপকূল

উপকূলবাসীর এক আওয়াজ- রিলিফ চাই না, স্থায়ী বাঁধ চাই

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই বেড়িবাঁধ এখন ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। এতে করে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলভাগ। করাল গ্রাসের মুখে ২২টি জেলার সাড়ে ৪ কোটি উপকূলবাসীর জানমাল। তাদের জীবন-জীবিকা, ফল-ফসল, কৃষি-খামার এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ কম-বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ, কুতুবদিয়া-মহেশখালী, চকরিয়া-পেকুয়া থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী-আনোয়ারা-স›দ্বীপ, পতেঙ্গা-কাট্টলী-হালিশহর, সীতাকুÐ-মীরসরাই হয়ে বৃহত্তর নোয়াখালী-ভোলা-বরিশাল, বৃহত্তর খুলনা পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে বেড়িবাঁধ ভাঙাচোরা ও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ভাঙা বেড়িবাঁধ উপচে গিয়ে সাগরের লোনাপানি এপাশ-ওপাশ ঢেউ খেলছে। এ কারণে অরক্ষিত উপকূলবাসীর হতাশা ক্ষোভ-অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস যদি আঘাত হানে তাহলে কোটি মানুষের জানমাল, সহায়-সম্বল কীভাবে রক্ষা পাবে তা নিয়ে উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে ভয় ও শঙ্কা। মে মাস থেকে জুনের মাঝামাঝি বর্তমান সময়টা হচ্ছে বঙ্গোপসাগরে নি¤œচাপ, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস সৃষ্টির মৌসুম। চলতি মে মাসে সাগরে নি¤œচাপ থেকে ঘনীভূত হয়ে একটি ঘূর্ণিঝড় রূপ নেয়ার আশঙ্কার কথা জানানো হয় দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে ৮৮২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা নাজুক বা নড়বড়ে। এরমধ্যে শতকরা ৩৮ ভাগ জায়গায় বাঁধের চিহ্নই মুছে গেছে। ৪৫ ভাগ বেড়িবাঁধ ভাঙাচোরা, নড়বড়ে। এরফলে বঙ্গোপসাগরের কিনারে নিয়মিত জোয়ার-ভাটায় প্লাবিত হচ্ছে ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ সংলগ্ন গ্রাম-জনপদ, হাট-বাজার, ক্ষেত-খামার ও ফসলি জমি। ভাঙাচোরা, ক্ষতবিক্ষত ও নড়বড়ে বেড়িবাঁধ শুকনো মৌসুমের উপযুক্ত সময়ে সংস্কার, মেরামত ও পুনঃর্নিমাণ করা হয়না। অথচ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসে দুর্যোগের মৌসুম যখন ঘনিয়ে আসে তখনই তড়িঘড়ি করে বেড়িবাঁধের জোড়াতালি মেরামত কাজ সারানো হয়। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও জোড়াতালি মেরামতের নামে প্রতিবছর চলে সীমাহীন দুর্নীতি। এতে কাজে অনিয়ম, কারচুপি ও শুভঙ্করের ফাঁকি যেন ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে। মেরামত ও সংস্কার কাজে সুষ্ঠু মনিটরিং ও কাজের মান যথাযথ তদারকি হচ্ছে না। অসৎ ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরনো সিন্ডিকেটের যোগসাজশে যথেচ্ছ সরকারি অর্থের লুটপাট চলছে। এতে করে নিম্নচাপ, জলোচ্ছ¡াস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রথম ধাক্কাতেই বেড়িবাঁধ সাগরে বিলীন হয়ে যায়। এভাবে শত শত কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। এরপর নতুন করে টেন্ডার, আবার বাজেট ও অনিয়ম-কারচুপির মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ লোপাট ও কারচুপি-অনিয়ম। সমুদ্র উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি সত্তে¡ও স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেই।
একদিকে পরিকল্পিত, মজবুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত না হওয়া অন্যদিকে ‘মোরা’ ‘রোয়ানু’ ‘সিডর’ ‘আইলা’ ‘নার্গিসে’র মতো বছর বছর সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের আঘাতে বিশাল সমুদ্র উপকূল হয়ে পড়ছে ক্ষতবিক্ষত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের ঘন ঘন আঘাতে ভয়ে-শঙ্কায় কাতর উপকূলবাসী। জনবসতি, ফল-ফসল ছাড়াও সমুদ্র বন্দর, জ্বালানি স্থাপনা, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ, পর্যটনকেন্দ্র, লবণশিল্প, চিংড়িসহ মৎস্যসম্পদ, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা স্থাপনা, বিমান বন্দরসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। অজস্র প্রাকৃতিক সম্পদরাজির ধারক দেশের বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগ অরক্ষিত থাকায় কোটি মানুষের ভীতি-শঙ্কা বেড়েই চলেছে। উপকূলবাসীকে দুর্যোগের পর রিলিফ সামগ্রী দেয়া হয়। তবে উপকূলের সবখানে দীর্ঘদিন যাবত একই আওয়াজ- ‘আমরা রিলিফ চাই না, মজবুত স্থায়ী টেকসই বাঁধ চাই’।
সুদূর অতীতকাল থেকেই দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস আঘাত হানে। দুর্যোগে অগণিত প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু ঝড়-জলোচ্ছ¡াসের পরও যারা বেঁচে যায় তাদের যেন মরণদশা। কেননা নিয়মিত প্রবল জোয়ার-ভাটায় বসতভিটা, ধানি জমি, ফাউন্দি ক্ষেত, লবণের মাঠ, চিংড়ি ঘের, পুকুর কিংবা দোকানপাট বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকায় অনিশ্চয়তার শঙ্কা থেকে কখনোই মুক্তি মিলে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জালোচ্ছ¡াস এবং এরপর সংঘটিত আরও ৬/৭টি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের পর এ যাবত দেশী-বিদেশী আর্থিক বরাদ্দে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুÐ, স›দ্বীপ, পতেঙ্গা, কাট্টলী, হালিশহর, কক্সবাজার সদরসহ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলাসহ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ চলে। কিন্তু মানসম্মত কাজ হয়নি; বরং কারচুপি-অনিয়ম, শুভঙ্করের ফাঁকির কারণে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। বেড়িবাঁধ টেকেনি কোথাও। ফেরেনি উপকূলবাসীর ভাগ্য। বেড়িবাঁধের মতো অপরিহার্য ‘প্রতিরক্ষা দেয়াল’ নড়বড়ে ভাঙাচোরা অবস্থায় থাকায় দুর্যোগে বিপদই উপকূলবাসীর সঙ্গী। স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, অধিকাংশ স্থানেই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার কাজে উপযুক্ত তদারকি, যাচাই, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বালাই নেই।
বেড়িবাঁধ সাগরের পেটে চলে যায়। নতুন টেন্ডারে কাজ আসে। নামেমাত্র কাজ করেই বিল তুলে নিয়ে সটকে পড়ে ঠিকাদার। পেছনে দুর্নীতিবাজ কর্তাদের যোগসাজশ। বেড়িবাঁধের কাজ পালাক্রমে বছর বছর এভাবেই চলছে। তাছাড়া বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার ও মেরামতের সময় তা যথেষ্ট উঁচু করা হয় না। সামুদ্রিক জোয়ারের চেয়ে উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ না হওয়ায় জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে ফসলি জমি ও লোকালয় ভাসিয়ে দিচ্ছে। যথেষ্ট উঁচু ও মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ না করার কারণে দুর্যোগের সময় তা উপকূলীয় জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হচ্ছে না। এতে করে বলতে গেলে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বেড়িবাঁধ।
এদিকে সমুদ্র উপকূলীয় বেড়িবাঁধের বেহালদশা প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, রেডক্রিসেন্ট ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক এজেএম গোলাম রাব্বানী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বঙ্গোপসাগরের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধের সংস্কার ও মেরামত কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। এ কারণে সামুদ্রিক জোয়ারের পানি উপকূলীয় জনপদে প্রতিদিন নিয়মিত প্রবেশ করে, আবার বের হয়। উপকূলবাসীর জানমাল, প্রাকৃতিক সম্পদ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, উপকূলীয় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরী। এরজন্য সরকারের সমন্বিত একটি কর্মপরিকল্পনা অপরিহার্য।

 



 

Show all comments
  • Syed Nurul Alam ২৩ মে, ২০১৮, ১২:১৮ এএম says : 0
    দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের সম্পদ ও মানুষের জানমাল সুরক্ষা করতে হলে টেকসই এবং স্থায়ী বেড়িবাঁধ অত্যন্ত জরুরী।
    Total Reply(0) Reply
  • চন্দন সরকার ২৩ মে, ২০১৮, ১২:৩৭ এএম says : 0
    উপকূলীয় জনসাধারণের জানমাল, কৃষি, ফসল, জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে মজবুত বা স্থায়ী বেড়িবাঁধের কোন বিকল্প নেই। বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Redwan Ahmed ২৩ মে, ২০১৮, ১:০৫ এএম says : 0
    মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ চাই। ভাঙা বেড়িবাঁধের কারণে লবণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। উপকূলীয় জনগনের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • A K Azad Amin ২৩ মে, ২০১৮, ৩:১৪ এএম says : 0
    উপকূল রক্ষায় চাই শক্ত বেড়ী বাঁধ।
    Total Reply(0) Reply
  • Jubair Ahamed ২৩ মে, ২০১৮, ২:১৪ পিএম says : 0
    দুর্বৃৃত্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে, ন্যায় বিচার নিশ্চত করা হউক
    Total Reply(0) Reply
  • Khalid Hasan ২৩ মে, ২০১৮, ২:৪৫ পিএম says : 0
    উপকূলীয় স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা জরুরী। এরজন্য সরকারের সমন্বিত একটি কর্মপরিকল্পনা অপরিহার্য।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বেড়িবাঁধ

৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ