Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

চা’তেই যেতে পারি বহুদুর!

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৮, ৯:০৩ পিএম

চা’তে ছিলাম আমরা, চা’তেই আছি, চা’তেই যেতে পারি বহুদুর ! স্বপ্ন নয় সত্য, এই চায়ের সাথে প্রায় ১৭৯ বছরের গৌরবময় ইতিহাস আমাদের। ছিলাম উৎপাদন-রপ্তানীতে সেরাদের তালিকায়। উইকিপিডিয়া তথ্য মতে বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপি সিলেট টি নামে ছিল খ্যাত । কিন্তু এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা তুঙ্গে, সেকারনে রপ্তানী নামকাওয়াস্তে। এতে পিছে পড়া নয়, বরং অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটানোই মূখ্য সফলতা। ১৯৭০ সালে চায়ের উৎপাদন ৩০ মিলিয়ন কেজি, সেখানে অভ্যন্তরীন চাহিদা ছিল ১ থেকে দেড় মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ সালে উৎপাদন হয়েছে ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি, অভ্যন্তরীন চাহিদা ছিল ৮১.৬৪ মিলিয়ন কেজি, ২০১৭ সালে উৎপাদন ৭৮.৯৫ কেজি, অভ্যন্তরীন চাহিদা ৮৫.৯৩ কেজি। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ চা পান করছে বর্তমানে। চা পান করছেন পৃথিবীর ৭শ’ কোটি মানুষ প্রতিদিন অন্তত তিনশ কোটি কাপ। ২০১৭ সালের চা বোর্ড পরিসংখ্যান আলোকে জানা যায়, দেশের মানুষ ৪,২৯৬ কোটি কাপ চা পান করে। গড়ে বছরে একজন মানুষ চা পান করে ২৬৬ কাপ।চায়ের প্রায় সোয়া ২ হাজার কোটি টাকার বাজারও। গত ১০ বছরের উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই সময়ের ব্যবধানে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে দুই কোটি কেজি। অর্থাৎ বছরে গড়ে উৎপাদন বাড়ছে সাড়ে ৩ শতাংশ হারে। একই সময়ে চায়ের চাহিদা বেড়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ কেজি। বছরে চাহিদা বাড়ছে সাড়ে ৬ শতাংশ হারে। ১৯৮২ সালে চা রপ্তানি হয় ৩ কোটি ৪৪ লাখ কেজি। সবচেয়ে কম রপ্তানি হয় ২০১৬ সালে, ৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়তে থাকায় রপ্তানিও কমে গেছে। ২০১৬ সালের চা রপ্তানিতে বাংলাদেশ ছিল ৭৭তম।এছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে বিবেচনায় নিলে ২০২৫ সাল নাগাদ চায়ের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১২৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন কেজি এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ওই সময়ে চায়ের উৎপাদন হবে মাত্র ৮৫ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন কেজি। চায়ের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ১৫ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা। চা শুধু চা তে সীমাবদ্ধ নয়, চা বাগান বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকেও বিকশিত করেছে বহুলাংশে। প্রতিবছর দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সিলেট সহ পাহাড়ি অঞ্চলে এবং চা চাষ যোগ্য এলাকাতে ভ্রমণ করতে আসেন, যা দেশীয় অর্থনীতিতে রাখছে বাড়তি অবদান। তাই এই চা-তে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। চা ব্যবসা বনেদি ও অভিজাত, একই সাথে এ অর্থনীতির টেকসই বুনিয়াদ। আপন শক্তিতে এগিয়ে যেতে পারি এ চা নিয়েই। বহি:দেশীয় আগ্রাসী কোন হস্তক্ষেপ নয়, একান্ত নিজস্ব উদ্যোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করলে আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড অনেকাংশে হয়ে যাবে শক্তিশালী। দেশে ১৬৪ টি চা বাগানের ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে চা আবাদ হয়ে হচ্ছে। বৃহদায়তন চা চাষের বদলে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ এখন জনপ্রিয়। এতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগ্ওা, নীলফামারীতে চা চাষে ঘটছে বিপ্লব। ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে সেখানকার মানুষের জীবনমানে। চা চাষের উৎপাদন শুরু হয়েছিল বৃহত্তর সিলেট হয়ে হালদা ভ্যালিস্থ চট্রগাম পরবর্তীতে করতোয়া ভ্যালিসে। ২০১৬ সালের চায়ের বিগত উৎপাদন ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি। অনুকূল আবহাওয়া সহ কর্মমুখী পরিকল্পনার কারনেই এমনটি সম্ভব হয়েছিল। ২০১৭ সালে হয়েছিল ৭৮.৯৫ মিলিয়ন কেজি। নিলামের ধার্য কেজির মূল্যমান ২১৪ টাকা হারে ্এ উৎপাদিত চায়ের বাজার মূল্য ্ক্রমানুসারে ১,৮,২০,০৭,০০,০০০ (এক হাজার আটশ বিশ কোটি সাত লক্ষ) ও ১,৬,৮৯,৫৩,০০,০০০ (এক হাজার ছয়শত উনব্বই কোটি তেপান্ন লক্ষ) টাকা। উৎপাদন সফলতার নৈপথ্যে রয়েছে চা শিল্প উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথ নকশা’ শিল্প শীর্ষক একটি স্বল্প, মধ্যে ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা। ২০২৫ সালে উৎপাদন টার্গেট রাখা হয়েছে ৮৫ মিলিয়ন কেজি। কিন্তু সেই টার্গেট ২০১৬ সালেই অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে বাংলাদশে চা বোর্ড। এবারকার উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৬ মিলিয়ন কেজি। তবে সেই লক্ষ্যমাত্রার অধিক অথাৎ ৯০ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চা বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমদ। সুদূর অতীতকালে এদেশের মসলিন কাপড় কিংবা নিকট অতীতে পাট-চামড়া শিল্পের মতোই সুপ্রাচীন শিল্প ও বাণিজ্য খাত এই চা। উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জন্য সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। চলতি বছরের ১৮ ফ্রেবুয়ারী বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ চা প্রদর্শনী ২০১৮’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চায়ের বহুমুখী ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানের বিভিন্ন প্রজাতির মত খরা সহিষ্ণু বা অল্পবৃষ্টি সহিষ্ণু চা উৎপাদনের দিকেও সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চা কৃষি ভিত্তিক শ্রমঘন প্রতিষ্টিত একটি শিল্প। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রপ্তানি আয়, আমদানি বিকল্প দ্রব্য উৎপাদন এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টিতে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাসকরণের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বহুদিনের এবং সুদূর প্রসারী। বাংলাদেশ চা এস্টেট স্টাফ এসোসিয়েশন সহ-সভাপতি আক্তার হোসেন মিন্টু বলেন, বৃটিশ আমলের সংখ্যা অনুযায়ী এখন্ও বাগানগুলোতে চা শ্রমিকদের সংখ্যা। সিলেটের প্রবীন ট্রি-প্লান্টার ও চা গবেষক মো: শাহজাহান আখন্দ বলেন, চা তে সম্ভাবনা অশেষ। কিন্তু আমরা সে মতে অনেকটা এগুতে পারছি না। প্রযুক্তিতে ভারত নির্ভর। অথচ অল্প মূল্যে সেই প্রযুক্ত আমরাই তৈরী করতে পারতাম। এছাড়া চা শিল্পে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে একটি অশুভ চক্র। যারা প্রতিভাধর চা গবেষকদের মূল্যায়ন করে না। চা শ্রমিকদের কর্ম সংস্কৃত্ওি কর্ম আচরন নিয়ে গবেষণা করেছেন ড. রজত কান্তি ভট্রাচার্য। তার মতে, চা শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে পাইলট কোন প্রকল্প্ও নেই। যাতে কাজের প্রতি তাদের অভ্যন্তরীন প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের কর্ম প্রতিযোগিতায় মূল্যয়ান হলে তারা সেরা শ্রম দ্ওেয়ায় মনোযোগি হত। সম্ভাবনার মধ্যে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা তারর্পও বহুবিধ ব্যবহার ও রকেমফের জাত-স্বাধ চা তে। সাতকড়া চা, রোজ টি, আলগ্রে টি, পাইনাপেল টি, জিনজার টি, জিরা টি, মিন্ট টি, লেমন টি, তুলসী টি, গ্রীন টি, অর্থডক্স টি, মসলা টি ও জেসমিন টি আমাদের অনন্য সংস্করণ। চা শিল্প বিকাশে একটি ভিশন ও মিশন নিয়ে কাজ শুরু করছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানীর জন্য চা অধিক উৎপাদন একই সাথে চা বাগানের চা চাষ যোগ্য জমি চিন্থিত করণ পূর্বক এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা, ক্ষুদ্র চা চাষে উ’ৎসাহে প্রদান, চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি ্ও মানোন্নয়ন চায়ের অভ্যন্তরীন চাহিদা পূরণ ও চা রপ্তানী হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে চায় বাংলাদেশ চা বোর্ড। চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চের চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র টি-প্লান্টার জি এম শিবলি জানান, এবার প‚র্বের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে সারাদেশে প্রায় ৮৬ মিলিয়ন এর উপর চা উৎপাদন হতে পারে। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী, ধারাবাহিকভাব খরা, উচ্চ তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি এখন লক্ষনীয়। বিশিষ্ট চা গবেষক এম আর খান চা বাগানের মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেরীতে হলেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে, চা বাগানগুলোর জন্য সু:সংবাদ, কিন্তু অতিবৃষ্টি অব্যাহত থাকলে সর্বনাশ্ও হতে পারে। হবিগঞ্জ পারকূলি চা এস্টেট বাগানের ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন, অনুকূল-প্রতিকূল আবহ্ওায়ার মধ্য্ওে উৎপদন নিয়ে প্রতিযোগিতায় রয়েছি আমরা। চা-শিল্পের উপর গবেষণাকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ফোরাম ফর দ্য ফিউচার’ এর প্রকাশিত ব্রিটিশ ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশ (বিবিসি)কর্তৃক প্রচারিত চা শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ক্রমবর্ধমান নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন সহ নানাবিধ কারণে আজ চা শিল্পের অস্তিত্ব মারাত্মক হুমকীর মুখে। ‘ফোরাম ফর দ্য ফিউচার’ এর গবেষণায় দেখা যায়, চা শিল্পের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে অন্য কারণগুলো। বাংলাদেশ চা সংসদদের এক সূত্র মতে ‘‘চা এমন একটি পণ্য, যার উৎপাদন রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয় । গত দু'বছর চায়ের উৎপাদন যে ব্যাপকভাবে বেড়েছে, তার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ১০ বছর আগে। একটি চারা চা গাছ থেকে চা পেতে সময় লাগে ১০ বছর। বাংলাদেশ চা বোর্ড উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমদ, জলবায়ুর বৈরীতা সর্বত্র। এরর্পও ২০১৬ ্ও ২০১৭ সালে আমাদের চা উৎপাদনে ইতিহাসের রেকর্ড অর্জন আমাদের। সরকার চা শিল্পের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অতি আন্তরিক। তাই সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চা নিয়ে আমাদের মহা-পরিকল্পনা। কারন চা-তে এগিয়ে যেতে চাই বহুদুর আমরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ