পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
অভাবের তাড়নায় একমুঠো খাবার, সাহায্য-সহানুভূতির আশায় ছুটে গিয়েই হৃদয়বিদারক ঘটনা : এ যেন দেশে নীরব নিত্যঅভাব-অনটনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি
রফিকুল ইসলাম সেলিম : হায়রে জীবন! নিদারুণ অভাবের তাড়না! একমুঠো খাবার, এতটুকুু সাহায্য-সহানুভূতির আশা! মাহে রমজানের প্রাক্কালে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অভাবী মানুষ ইফতার ও সেহেরীর খাবার বিতরণের খবর পেয়েছিল। সেই খাদ্যসামগ্রী জোগাড় করতে ছুটে গিয়েই কয়েক মুহূর্তে ঘটে গেল হৃদয়বিদারক ঘটনা। ক্ষুধা নিবারণে সাহায্যের জন্য হাত পাততে গিয়েই প্রাণ গেল ১০ জনের। ইফতার ও সেহেরী সামগ্রী বিতরণের খবর পেয়ে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসে হতদরিদ্র হাজারো মানুষ। প্রচÐ ভিড়, তীব্র গরম আর হুড়োহুড়িতেই হিট স্ট্রোক এবং শ্বাসরোধে (সাবোকেশন) মারা গেলেন ১০ নারী। আহত এবং অসুস্থ হয়েছেন আরও অনেকে। যাদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। মর্মান্তিক এই ঘটনা দেশের হতদরিদ্র মানুষের নিরব নিত্যঅভাব-অনটনেরই যেন বাস্তব প্রতিচ্ছবি। গতকাল (সোমবার) চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত নলুয়া-ঘাটিয়াডাঙ্গা গ্রামে ঘটে যায় এ করুণ মৃত্যুর ঘটনা। গরীব-দুঃখী হাজারো মানুষ আশায় বুক বেঁধে রোজার আগে সেহেরী-ইফতারের খাদ্যসামগ্রী জোগাড় করতে গিয়ে মৃত্যুফাঁদে পড়ার এ ঘটনায় সাতকানিয়াসহ সমগ্র চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রসঙ্গত এরআগে গত ১৮ ডিসেম্বর নগরীর একটি কনভেনশন সেন্টারে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে প্রচÐ ভিড়ে পদদলিত হয়ে মারা যায় ১০ জন।
প্রতি বছরের মতো এবারও সেখানে ইফতার সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করেন কেএসআরএম (কবির স্টিল অ্যান্ড রি-রোলিং মিল লিঃ) গ্রæপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান। তার পক্ষ থেকে তার আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা ইফতার ও সেহেরী সামগ্রী বিতরণের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সকাল ১০টার আগেই সেখানে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে। এতে করে সবকিছু আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আয়োজকরা জানান, ইফতার-সেহেরী সামগ্রী সংগ্রহের জন্য কয়েকগুণ বেশি মানুষের সমাগম হবে তা আগে কল্পনাও করা যায়নি।
এদিকে এ ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের আয়োজনের ব্যাপারে নতুন করে নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে ও ফিরে এসে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরেআলম মিনা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, মানুষের অস্বাভাবিক ভিড় ও তীব্র গরমে হিট স্ট্রোক এবং শ্বাসরোধ হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই নারী এবং বয়স্ক। ঘটনাস্থলে ৯ জন এবং হাসপাতালে নেয়ার পর আরও ১ জনের মৃত্যু হয়। কেএসআরএমের মালিক মোহাম্মদ শাহজাহানের বাড়ির আঙ্গিনায় মসজিদ ও মক্তবের সামনে ছোট একটি মাঠে ইফতার ও সেহেরী সামগ্রী বিতরণের আয়োজন করা হয়। ওই মাঠের ধারণক্ষমতা বড়জোড় প্রায় ১০ হাজার হলেও সেখানে প্রায় ৩৫ হাজারের মতো মানুষের সমাগম হয় জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, সমগ্র সাতকানিয়া উপজেলা, পাশের উপজেলা চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া এমনকি পার্বত্য বান্দরবান জেলা থেকেও হতদরিদ্র লোকজন ছুটে আসে। আর এই কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি। তবে সেখানে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয়রা জানান, ছোলা, সেমাই, চিনি, পেঁয়াজের মত বিভিন্ন পণ্য মিলিয়ে ২০ হাজার মানুষের জন্য প্যাকেট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ জড়ো হন। বিতরণ শুরু করতেই প্রচÐ হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এতে বিপাকে পড়েন আয়োজকরা। অল্পক্ষণের মধ্যেই মানুষের ভিড় বেড়ে গেলে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কারণ এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো লোকবল ছিলনা সেখানে। মাঠে সামিয়ানা ও প্যান্ডেল টাঙ্গানো হলেও তা ছিল সীমিত এলাকায়। প্রচÐ রোদে আর মানুষের ভিড়ে মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনায় ইফতার সামগ্রী বিতরণ বন্ধ রাখা হয়। খবর পেয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, পুলিশ সুপার নূরেআলম মিনাসহ কেএসআরএমের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ছুটে যান।
নিহতদের পরিচয়
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) রেজাউল মাসুদ জানান, নিহত ১০ জনের মধ্যে ৯ জন নারীর পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেনÑ সাতকানিয়ার খাগরিয়া গ্রামের ছগির আহম্মেদের কন্যা হাসিনা আক্তার, একই গ্রামের আহম্মেদ শফীর কন্যা রাশিদা আক্তার, ঢেমশা গ্রামের মোঃ হাসানের স্ত্রী রিনা বেগম, এক বান্দরবান জেলার সুয়ালক গ্রামের মোঃ ইব্রাহীমের স্ত্রী নুর আয়েশা, লোহাগাড়া উপজেলার সালেহ আহম্মেদের কন্যা টুনটুনি, একই উপজেলার কলাউজান গ্রামের আব্দুল হাফেজের স্ত্রী জোছনা বেগম ও আলাউদ্দিনের কন্যা নুরজাহান, চন্দনাইশ উজেলার দোহাজারীর নুরুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও একই গ্রামের মোবারক হুসেনের কন্যা সাকী বেগম। আহতদের মধ্যে ২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাকিদের স্থানীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটি
এ ঘটনা তদন্তে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ঘটনা তদন্তে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীরকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটিকে ৭ কর্ম দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, কমিটিকে পুরো ঘটনা তদন্ত করে কারও গাফিলতি আছে কিনা তা চিহ্নিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের এবং আহতদের সাহায্য দেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কেএসআরএমের বক্তব্য
কেএসআরএমের পক্ষ থেকে প্রতি বছরের ন্যায় গরীব দুস্থদের মাঝে ইফতার ও যাকাত সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে সার্বিক সহযোগিতা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য স্থানীয় থানা ও প্রশাসনকে মৌখিকভাবে পুলিশ ফোর্স চেয়ে সহায়তা চাওয়া হয়। সেখানে মহিলা পুলিশসহ মোট ১শ’ জন পুলিশ সদস্য ও নিজস্ব ২শ’ জন সিকিউরিটি ও স্বেচ্ছাসেবক উপস্থিত ছিলেন। এসময় যেকোনো পরিস্থিতির প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স এবং ৩ জন ডাক্তার প্রস্তুত রাখা হয়। উক্ত সামগ্রী বিতরণ শুরু হলে লোক সংখ্যার চাপ বেড়ে গেলে এ সময় হুড়োহুড়িতে তীব্র গরম, হিটস্ট্রোক ও শ্বাসকষ্টে বেশ ক’জন মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের দ্রæত উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকালে ৯ জন এবং হাসপাতালে ১ জন মারা যান। এই ১০ জন সকলেই ছিলেন চল্লিশোর্ধ বয়স্ক নারী। এ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে কোম্পানীর পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা এবং অসুস্থদের জন্য সার্বিক চিকিৎসা খরচ বহন করার ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া নিহতদের পরিবারের সদস্য থাকলে তাদের চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান কেএসআরএম গ্রæপের পরিচালক শাহরিয়ার জাহান।
সুশৃঙ্খল পরিবেশেও হচ্ছে বিতরণ
চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোজা ও ঈদের আগে ঘোষণা দিয়ে মেজবান আয়োজন, জাকাত ও সাহায্য সামগ্রী বিতরণের রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। এসব আয়োজনে বিভিন্ন সময়েই ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনা। তবে ব্যতিক্রম নজিরও আছে। ১৯৯৪ সাল থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে রোজার আগে ও রোজার মধ্যেও ইফতার-সেহেরী সামগ্রী বিতরণ করে আসছেন চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র ও মোস্তফা হাকিম গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মনজুর আলম। হাজার হাজার মানুষের মাঝে এসব সামগ্রী বিতরণকালে কখনোই কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি কখনোই। এ প্রসঙ্গে গতকাল এম মনজুর আলম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আল্লাহর রহমতে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিবছর ইফতার সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে যারা হতদরিদ্র তাদের তালিকা করে আমরা খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আমরা ধাপে ধাপে বিভিন্ন এলাকায় সেহেরী ও রমজানের খাদ্যসামগ্রী বিলি-বণ্টন করি। তাছাড়া সাহায্য গ্রহীতারাও আন্তরিকতা ও শৃঙ্খলার সাথে এসে বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে কোন সমস্যা হচ্ছে না। এরজন্য আল্লাহ পাকের নিকট হাজারো শুকরিয়া। এম মনজুর আলমের মতো অনেকে নিরবেই সাহায্য এবং জাকাত বিতরণ করছেন।
পুলিশের নির্দেশনা
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, ঈদের আগে প্রতিবছরই ইফতার সামগ্রী কিংবা জাকাতের কাপড় দেয়াকে কেন্দ্র করে এ ধরনের ঘটনা ঘটছেই। তা রোধকল্পে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশকিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তা হলো সুশৃঙ্খলভাবে ইফতার সামগ্রী কিংবা জাকাত বিতরণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে হবে এবং অনুমতি নিতে হবে। এসব সামগ্রী বিতরণে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টা সর্বাগ্রে বিবেচনায় রেখে একদিনে এক জায়গায় বিতরণ না করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকায় ইফতার ও জাকাত সামগ্রী বিতরণ করার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, এসব নির্দেশনা মেনে জাকাত বিতরণ করা হলে পুলিশ তাতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।