Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসি কী জেগেই ঘুমাচ্ছে?

খুলনায় অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পাহাড়

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন জানেই না। হাইকোটের ‘তিন মাস স্থগিত’ আদেশের পর ইসির প্রথম প্রতিক্রিয়া ‘আমরা কিছুই জানি না’। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা ‘নির্বাচন স্থগিত’ আদেশ বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন। ওই আবেদন শুনানির দিন একই দাবিতে ইসি থেকে আবেদন করা হয়। ইসির আবেদন পেয়ে হাইকোর্টের প্রথম বক্তব্য ‘আপনাদের এতো বিলম্ব কেন?’ জাতীয় নির্বাচনের ৬ মাস আগে যে দুই সিটির নির্বাচন দেখার জন্য সারাদেশের মানুষ এবং ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকরা মুখিয়ে রয়েছেন; সেই নির্বাচনের আয়োজক ইসি কী স্থানীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না? নাকি ঘুমিয়ে থাকেন?
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিতের পর সবার দৃষ্টি এখন খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় শহরে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে সমান তালে। কিন্তু মূল প্রতিদ্ব›দ্বী নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণ বিধি লংঘনসহ নানাবিধ অভিযোগ তুলছেন। ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষ থেকে আইন শৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থীদের বাড়তি সুবিধা দিতে তাদের কর্মী সমর্থকদের গ্রেফতার-হয়রানীর অভিযোগ তোলা হয়েছে। এমনকি নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য ইসির নিয়োগকৃত পিজাইডিং অফিসারদের ফোন করে রাজনৈতিক পরিচয় ও পারিবারের রাজনীতি সম্পর্কে জানা হচ্ছে। যারা আওয়ামী লীগ অনুসারী নন তাদের সতর্কও করে দেয়া হচ্ছে। আবার ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট যারা হবেন তাদের হয়রানী করা হচ্ছে। ফোনে হুমকি, ভয়ভীতি দেখানো এবং বিএনপির কর্মীদের গ্রেফতারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর অভিযোগ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করছেন। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থীর পক্ষ্যে খুলনায় সন্ত্রাসী-অস্ত্রধারীদের আনাগোনার অভিযোগ তোলা হয়। দুই পক্ষ থেকে খুলনায় যেমন এই অভিযোগগুলো তোলা হয় তেমনি ঢাকায় দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ইসির সঙ্গে দেখা করে ওই সব অভিযোগ জমা দেন। কিন্তু ইসি যেন নির্বিকার, নীরব দর্শক। ইসির অবস্থা যেন পল্লীগীতির ওই শ্লোকের মতো ‘বন্ধু দেখিয়াও দেখলা না/ বন্ধু শুনিয়াও শুনলা না’। এ অবস্থায় ‘নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন করার সমর্থ আছে কিনা’ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। যা ইসির বিরুদ্ধে খুবই স্পর্শকাতর অভিযোগ। কারণ নির্বাচন সংক্রান্ত আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে ‘জাতীয় ও স্থানীয় যে কোনো নির্বাচনই হোক না কেন, নির্বাচনের সময় ওই এলাকার প্রশাসন পরিচালনার সব দায়-দায়িত্ব ইসির ওপর ন্যাস্ত থাকবে। খুলনা সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইসি কী সে দায়িত্ব পালন করছে? নাকি ‘নির্বাচন কমিশন সরকারের এজেÐা বাস্তবায়ন করছে’ বিএনপির অভিযোগ সত্য? দলবাজীর অভিযোগ তুলে গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত করার স্বার্থে বিএনপি কেএমপি কমিশনার মোঃ হুমায়ুন কবির ও গাজীপুরের এসপি হারুন অর রশীদকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিল। সে দাবির বাস্তবায়ন দেখেনি; বরং ইসি থেকে জানানো হয় তারা অভিযুক্তদের কর্মকাÐের ওপর কড়া নজর রাখবেন। বাস্তবে ইসির কোনো নজরদারী দেখা যাচ্ছে না।
‘ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে চিৎকার-চেচামেচি করে বা ডেকে জেগে তোলা যায়; কিন্তু জেগে থেকে যারা ঘুমিয়ে থাকার ভান করেন হাজারো চিৎকারে তাদের জেগে তোলা যায় না’। বহুল প্রচারিত এই প্রবাদটি আমাদের নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! কাজী রকীব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন বিগত নির্বাচন কমিশনের প্রতি দেশের মানুষের তেমন ভরসা-প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের অনেক প্রত্যাশা। নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর সে প্রত্যাশার পারদ আরো বেড়ে গেছে। সেই ইসি কী দেশবাসীর প্রত্যাশা পুরণ করবেন নাকি জেগে জেগে ঘুমিয়ে থাকবেন?
গাজীপুর সিটির নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পর সেখানকার পুলিশ প্রশাসন যেন ‘ছুঁ-মন্তর’ দিয়ে যাদুকরী কাজ করেছে। ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী সমর্থক ও আত্মীয়-স্বজনদের সাইজ করতে গাড়ী ভাংচুরের মামলা সাজিয়েছে। সেই ভাংচুর করা লেগুনাকে তারা যাদুর কাঠি দিয়ে আবার ভালও করেছে। ৬ মে আদালত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত করার দেড় ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের বাড়ির আশপাশে অভিযান চালায়। গ্রেফতার করে বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানসহ ১৩ জনকে। ৬ ঘণ্টা পর নোমানকে ছেড়ে দিয়ে পরের দিন বাকি ১২ জনসহ ১০৩ জনের নাম উল্লেখ করে টঙ্গী থানায় মামলা দায়ের করে। এজাহারে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও একশ থেকে দেড়শ জনকে। এঁদের অর্ধেকই ধানের শীষ মার্কার মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। এজাহার বলা হয় ৬ মে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে কিছু দুষ্টু লোক ময়মনসিংহ মহাসড়কের স্টার হেভেন রেস্তোরাঁর সামনে একটি লেগুনা (ঢাকা মেট্রো-গ-১১-৬০৮০) ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনাস্থল থেকে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ দেখে আরও একশ থেকে দেড়শ জন পালিয়ে যান। আলামত হিসেবে গাড়িটির ধ্বংসাবশেষ, কিছু কাচের টুকরা ও ১০টি ইটের টুকরা জব্দ করা হয়। কিন্তু পরের দিন স্থানীয় সাংবাদিকরা থানায় গিয়ে দেখেন সব গাড়ি পুরোপুরি অক্ষত। ভেতরে লেগুনার মালিক মোঃ আলামিন। তিনি বলেছেন, তার গাড়িতে কোনো ভাঙচুর হয়নি। পুলিশ ৬ মে লেগুনাটি রিক্যুইজিশন করে নিয়ে এসেছে। নির্বাচন ইস্যুতে গাজীপুরে এ ঘটনায় ইসি এখনো নীরব দর্শক।
এদিকে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতাকারী বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ১৯টি অভিযোগ জমা দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মধ্যে হলফনামার তথ্য গোপন, নিজ পেশা ও ব্যবসার প্রকৃত তথ্য গোপন, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার এবং কমার্স ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান, নর্থ ওয়েন্টার্ন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেডের পরিচালক গোপন করা ইত্যাদি। নৌকার প্রার্থীর পক্ষ্যে এমপিদের নির্বাচনী প্রচারণা এবং সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের নৌকার পক্ষ্যে প্রচারণায় বাধ্য করার অভিযোগ করেন। অন্যদিকে তালুকদার আবদুল খালেকও বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দুটি অভিযোগ এনেছেন। হলফনামার তথ্য গোপন করা এবং অনুষ্ঠানে রঙিন ব্যানার ব্যবহার করে ধানের শীষের প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। সব চেয়ে বড় অভিযোগ বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণায় যারা দায়িত্বপূর্ণ কাজ করছেন তাদের গণগ্রেফতার। ধানের শীষের প্রার্থীর অভিযোগ বিএনপির কয়েকশ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দলীয় কর্মীদের বাসায় বাসায় তল্লাসীর নামে ভয়ভীতি দেখানো এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। যারা ধানের শীষের পুলিং এজেণ্ট হবেন তাদের বেছে বেছে গ্রেফতার করা হচ্ছে। আসামী ধরার নামে ধানের শীষের কর্মী সমর্থকদের বাসা-বাড়ি তল্লাসী করা হচ্ছে। বিএনপির কর্মীদের আত্মীয়-স্বজনদের অশ্রাব্য গালিগালাজ ও জীবননাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। বিএনপির নেতাদের এই গণগ্রেফতার অভিযানসহ এ সবের প্রতিবাদে নির্বাচনী প্রচারণা ৫ ঘন্টা বন্ধ রেখেছিলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। পরবর্তীতে সংবাদ সম্মেলন করে পুনরায় প্রচারণা শুরু করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে খুলনায় নির্বাচন কাজেরত রিটানিং অফিসারকে জামায়াত-শিবির হিসেবে অবিহিত করেন।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ হলো তারা মেয়র প্রার্থীদের কোনো অভিযোগই যাচাই-বাছাই করে কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। আবার ২৮৯ জন প্রিসাইডিং অফিসারের তালিকা চূড়ান্ত করে তাদের নাম ফোন নম্বর পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। ওই তালিকা পেয়ে এখন ধানের শীষের নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখার পাশাপাশি পুলিশ ওইসব প্রিসাইডিং কর্মকর্তার যারা নৌকা অনুসারী নন তাদের ফোন করে হুমকি ধমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন সত্যিই কী খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে চায়? নাকি বিএনপির অভিযোগ অনুযায়ী ‘কারো নাচের পুতুলের ভূমিকা’ পালন করতে চায়? বাস্তবতা দেশের মানুষ বর্তমান ইসির প্রতি এখনো আস্থাশীল এবং নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করে। দেশের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো ইসিকে শক্ত ভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন ও নিরপেক্ষ ইমেজ সৃস্টি করতে হবে। ইসির সামনে এর বিকল্প কিছু নেই।



 

Show all comments
  • Moinuddin ১৩ মে, ২০১৮, ১:০৭ এএম says : 0
    নির্বাচন কালিন সময়ের মধ্যে প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা থাকলেও তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না
    Total Reply(0) Reply
  • আকাশ ১৩ মে, ২০১৮, ৩:১৭ এএম says : 0
    অবস্থা দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • ইব্রাহিম ১৩ মে, ২০১৮, ৩:১৭ এএম says : 0
    এগুলো বলে কোন লাভ নাই। তারা হলেন আদেশ পালনকারী ......................
    Total Reply(0) Reply
  • উজ্জল ১৩ মে, ২০১৮, ৩:১৮ এএম says : 0
    ওনাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না
    Total Reply(0) Reply
  • নেসার উদ্দিন ১৩ মে, ২০১৮, ৩:১৯ এএম says : 0
    আশা করি এই লেখাটি পড়ে ইসির একটু হলেও বোধদোয় হবে
    Total Reply(0) Reply
  • Daulot Hossain ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০০ পিএম says : 0
    EC KESO NA DEKHAR VAN KORSY
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shahinur Islam Shahin ১৩ মে, ২০১৮, ১২:০১ পিএম says : 0
    mone hoy
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ