Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আগাম বন্যার কবলে সিলেট

| প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০১৮, ১২:০০ এএম

সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৮ নদী ১৩ স্থানে বিপদসীমার ওপরে : ডুবে যাচ্ছে উত্তর-পূর্বের হাওড় অঞ্চল : ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টি আরও ৩ দিন : উজানের ঢলে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা : নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে ধীরে ধীরে উন্নতির সম্ভাবনা
শফিউল আলম : আগাম বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট বিভাগ। বিশেষজ্ঞগণ জানান, আবহাওয়ার অস্বাভাবিক মতিগতির ফলে অসময়ে অতিবৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে এই আকস্মিক বন্যা। উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে এবং বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গত ১০/১২ দিন ধরে টানা মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছ। বৃষ্টির পানি গড়াচ্ছে ভাটির দিকে নদ-নদী, খাল-বিল-ছরা, হাওড়ের সর্বত্র। বর্ষারোহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন এখনও বেশ দূরে। তবে বাংলাদেশ ও সন্নিহিত অঞ্চলের আকাশে ঘনঘোর কালো বজ্রমেঘের ঘনঘটা তৈরি হয়। এ কারণে বৈশাখী খরতপ্ত আবহাওয়ার স্বাভাবিক রূপ পাল্টে গিয়ে বর্ষাকালীন পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
গতকাল (মঙ্গলবার) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে জানা যায়, দেশের নদ-নদীসমূহের চারটি অববাহিকার অন্যতম মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত বৃহত্তর সিলেটের প্রধান দু’টি নদী সুরমা-কুশিয়ারাসহ ৮টি নদ-নদী ১৩টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে গত সোমবার সুরমা ও কুশিয়ারাসহ উত্তর-পূর্বের ৬টি নদ-নদী ৯টি পয়েন্টে, গত রোববার ৪টি নদী ৬ পয়েন্টে এবং গত শনিবার সর্বপ্রথম দুই নদীর পানির সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করে। এভাবে ক্রমেই বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের নদ-নদীগুলোর পানি বেড়ে যেতে থাকে। গতকাল ভারতের উজানের ঢল আরো বেড়ে গিয়ে সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ৮টি নদী ১৩টি স্থানে বিপদসীমার উপরে বয়ে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীর ডুবে যাচ্ছে উত্তর-পূর্বের বিরাট হাওড় অঞ্চল।
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে জানা গেছে, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল, মণিপুর প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত আরও অন্তত ৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগের গাণিতিক মডেলের পূর্বাভাস মতে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলাসমূহের এবং এর সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরার অনেক এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতের উক্ত অঞ্চলে ১১ ও ১২ মে বৃষ্টিপাত কম হতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, হাওড় অঞ্চলের নদ-নদীগুলো পুরোপুরি বন্যা কবলিত হয়েছে। হবিগঞ্জের হাওড়ে কোথাও কোথাও পানি ঢুকে গেছে। আগামী ২ দিনে সিলেট ও মৌলভীবাজারে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। সুনামগঞ্জে ২দিনে পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। বিপদসীমার নিচে থাকলেও কুমিল্লার গোমতী নদীতেও পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা এবং কিশোরগঞ্জে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান বন্যা একটি আকস্মিক বন্যা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একই সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়ে অতিবৃষ্টিই এই বন্যার কারণ। আগামী ২ দিনেও বর্ষণ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস রয়েছে। এতে করে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। প্রসঙ্গত গত ৫ মে শনিবার একমাত্র দৈনিক ইনকিলাব ‘আগাম বন্যার আশঙ্কা’ শীর্ষক প্রধান সংবাদ প্রকাশ করে, যা এখন বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে।
এদিকে পাউবো’র বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে নদ-নদীর প্রবাহ ও বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে গতকাল সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বে প্রধান নদী সুরমা কানাইঘাট পানির সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার, সিলেটে ২২ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদী ৪টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরমধ্যে অমলশীদে ৮৯ সেমি, শেওলায় ১০৭ সেমি, মারকুলিতে ৭০ ও ফেঞ্চুগঞ্জে ৬৭ সেমি বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।
তাছাড়া মনু নদী মৌলভীবাজার জেলায় ৪৫ সেমি উপরে, খোয়াই নদী হবিগঞ্জ জেলার বাল্লায় ৭ সেমি ও হবিগঞ্জে ৭০ সেমি উপরে, সুতং নদী সুতং রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে ৮৩ সেমি উপরে, কংস নদী নেত্রকোনা জেলার জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে ৩৮ সেমি উপরে, কালনী নদী আজমিরিগঞ্জে ১২৩ সেমি উপরে, বাউলাই নদী খালিয়াজুড়িতে বিপদসীমার এক সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সোমেশ্বরী নদী কলমাকান্দায় ও কুশিয়ারা নদী শেরপুর-সিলেট পয়েন্টে বিপদসীমার কাছাকাছি সতর্ক স্থানে রয়েছে। এছাড়া সারিগোয়াইন ও ধলাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদ-নদীগুলোর পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে ১০ মে পর্যন্ত টানা মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেই অতিবৃষ্টির পানি পাহাড়ি ঢলের আকারে দেশের উত্তর-পূর্বে ভাটির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলেও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণে বাড়ছে নদ-নদীর পানির সমতল। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গত তিন দিনে সিলেট বিভাগে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে- জকিগঞ্জে ১৬২ মিলিমিটার, মনু রেলসেতু পয়েন্টে ১২৭ মিমি, মৌলভীবাজারে ১৬৩ মিমি, কমলগঞ্জে ২১১ মিমি, হবিগঞ্জে ১০৭.৫ মিমি এবং নেত্রকোনা জেলার জারিয়াজঞ্জাইলে ১২০ মিমি।
আজ (বুধবার) সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক জায়গায়, রংপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া ও বিজলী চমকানোসহ হালকা বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের পূর্বাঞ্চলে মাঝারী ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ ও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। এর পরের ৫ আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের নদ নদীর পানি বৃদ্ধি
সিলেট থেকে ফয়সাল আমীন জানান, তুলনামুলক বৃষ্টিপাতের হার চলতি বছর (মার্চ-মে) কম হচ্ছে সিলেটে। গত ২ বছর বৃষ্টিপাতের হার অত্যাধিক ছিল সিলেট-ময়মনসিংহ তথা দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে। তবে উজানে পাহাড়ি ঢলে নদ নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বরাবরের মতো এতে নি¤œাঞ্চলে পানি জমে উঠেছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক নয় বলে জানিয়েছেন আবহ্ওায়াবিদ আবু সাঈদ। বৃষ্টিপাতের কারনে কৃষকদের বেরো ধান (বিশেষ করে সুনামগঞ্জ জেলায়) গোলায় তোলা ব্যাঘাত ঘটলেও আগামী ২দিন আবহ্ওায়া শুষ্ক থাকবে এমনটি-ই নিশ্চিত করেছেন তিনি। তিনি আর্ওো জানান, মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে স্থাণীয় বৃষ্টিপাতের গড় হিসাব ও প্রভাবে আগাম বন্যার কোন আশংকা নেই, উজানের পাহাড়ী ঢল ভিন্ন বিষয়। তারপরও আগাম বন্যার সর্তকতা ও পূর্বাভাস দিয়েছে, বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরন কেন্দ্র। সূশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্ষা মৌসুমে (জুন-জুলাই-আগষ্ট-সেপ্টেম্বর) বৃষ্টিপাত বা উজানের পাহাড়ি অপ্রত্যাশিত ঢলে বিগত বছরগুলোতে বন্যা লক্ষনীয় ছিল দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে। কিন্তু সেই অগ্রিম হিসাব ভবিষ্যতের উপর নির্ভরশীল। তবে ২০১৬ সালে ( মার্চ-এপ্রিল-মে) সিলেট অঞ্চলের বৃষ্টি পাতের পরিমান ছিল ১৮৭৯ মি:মিটার, ২০১৭ সালে ২০১৯ মি: মিটার কিন্তু চলতি বছর মাত্র ৭‘শ মি: মিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত বছর মার্চ থেকেই টানা বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিল এ অঞ্চল। কিন্তু এবার মার্চের বদলে এপ্রিল থেকে বৃষ্টির দেখা মিলেছে। আবহ্ওায়া অফিস সূত্র জানায়, সিলেট অঞ্চলে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে গড় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ১১৪৬ মি:মিটার প্রত্যাশিত। কিন্তু সে তুলনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৫‘শ মি:মিটার কম বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেটঁ অঞ্চলে। উত্তর পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা,মিজোরাম, অরুনাঞ্চল, মনিপর প্রদেশে পাহাড়ি অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে হালকা ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এতে করে উজানের পাহাড়ি ঢল সুরমা কুশিয়ার হয়ে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি ঘটেছে। ফলশ্রæতিতে মেঘনা বেসিনের নদীগুলোর কয়েকটি স্থানে বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটে‘র হাইড্রোলজী বিভাগের তথ্য মতে,কুৃশিয়ারা অমলশীদে বিপদসীমার ৮৯ সে:মিটার, কুশিয়ারা ফেঞ্চুগঞ্জে ৬৭ সে:মিটার, সুরমা কানাইঘাটে ৩৪ সে:মিটার, সুরমা-মেঘনায় মারকুলি ৭০ সে:মিটার, কুশিয়ারা শ্ওেলায় ১০৭ সে: মিটার. সুরমা সিলেটে বিপদসীমার ১৮ সে: মিটার ্ও হবিগঞ্জে খোয়াই বিপদসীমার ৭০ সে: মিটার, খোয়াই ব্রিজ ৭সে: মিটার , মৌলভীবাজারে মনু ৪৫ সে: মিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আবহ্ওায়া সংশ্লিষ্টদের সূত্র মতে, আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৬ টা থেকে আগামী ৭২ ঘন্টায় উজানে বৃষ্টিপাত ১০০ মি:মিটার হ্ওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, একই সময় সিলেটে ৬০ মি:মিটার, হবিগঞ্চের আংশিক ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সব বিভিন্নস্থানে ১০০ মি:মিটার বৃষ্টিপাত হ্ওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সকাল থেকে সিলেটের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে, মাঝে মধ্য হালকা বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিলেটে আজ এবং গতকাল গড় বৃষ্টিপাত ৪৮ মিলি মিটার।

 



 

Show all comments
  • Tomal Abir ৯ মে, ২০১৮, ১২:৪৭ এএম says : 0
    আগাম বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারকে সহসাত ব্যবস্থা নিতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • বজলুল হক ৯ মে, ২০১৮, ১:১৪ এএম says : 0
    Government need to all preparedness to reduce flood affects sudden in Sylhet region.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিলেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ